মৃত্যুঞ্জয় রায়: বিভিন্ন ফসলের মধ্যে শাকসবজিতে বহু রকমের পোকামাকড় আক্রমণ করে। কেননা, শাক সবজিও আছে বহু প্রকার। এক এক সবজিতে এক এক পোকা আক্রমণ করে। যেমন বেগুনের ডগা ও ফলছিদ্রকারী পোকা শুধু বেগুন ফসলেই আক্রমণ করে। আবার একই পোকা অনেক সবজিতে আক্রমণ করে। যেমন জাব পোকা, জ্যাসিড, মাকড়, লেদা পোকা ইত্যাদি। তাই শাক সবজির পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে কৌশলী না হলে সফলভাবে সেসব শত্রু পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না।
সাধারণত: এ দেশের সবজি চাষিরা শাক সবজির পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে বিষাক্ত কীটনাশকের উপর বেশি নির্ভর করে থাকেন। এখনো এ দেশে বিভিন্ন ফসলের মধ্যে সবজিতে সবচেয়ে বেশি কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। সবচেয়ে বেশি কীটনাশক দেয়া হয় বেগুন, শিম, বরবটি ইত্যাদি ফসলে। কখনো কখনো তাতে পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ হয় বটে, কিন্তু তার ক্ষতিকর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের উপর।
যত্রতত্র কীটনাশক ব্যবহারের ফলে একদিকে পোকামাকড়ও যেমন সেসব কীটনাশকের প্রতি ধীরে ধীরে প্রতিরোধী হয়ে ওঠে অন্যদিকে চাষি ও সবজি ভোক্তারা কীটনাশকের বিষাক্ততায় আক্রান্ত হয়ে নানারকম অসুখ-বিসুখে ভোগে। এ অবস্থা কাম্য নয়। তাই বিষের হাত থেকে ফসল, পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যকে রক্ষা করতে সবজি চাষিদের এখন প্রাকৃতিক উপায়ে শাক সবজির পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে জোর দেয়া উচিত।
প্রকৃতিতেই এসব শক্রু পোকাদের শায়েস্তা করার নিদান লুকিয়ে আছে। আছে বিভিন্ন বন্ধু পোকা ও মাকড়সা, উপকারী রোগজীবাণু। ক্ষেতে কোনো বিষ না দিলে এরা বেঁচে থাকে এবং প্রাকৃতিক নিয়মেই শত্রু পোকাদের মেরে ফেলে। এছাড়া আছে বিভিন্ন কীটবিনাশী গাছপালা। এসব গাছপালা থেকে উদ্ভিদজাত কীটনাশক তৈরি করে আক্রান্ত ক্ষেতে প্রয়োগ করলে তাতে শত্রু পোকা নিয়ন্ত্রণ হয় অথচ সেসব প্রাকৃতিক কীটনাশক বন্ধু পোকাদের কোনো ক্ষতি করেনা।
বিভিন্ন পরীক্ষা নীরিক্ষার ফলাফলে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে শাক সবজির জাব পোকা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি এখানে তুলে ধরা হলো। আশা করি সবজি চাষিরা ক্ষেত জরিপ করে পোকামাকড়ের অবস্থা বুঝে এসব পদ্ধতি প্রয়োগ করে বিনা বিষে সবজির পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।
সবজির জাব পোকা : জাব পোকা সবজি ফসলের একটি মহা শত্রু পোকা। শিম, বরবটি, মটরশুটি, মরিচ, টমেটো, ঢেঁড়শ, বেগুন, কুমড়া, কপিসহ প্রায় সব সবজিতেই এ পোকা আক্রমণ করে থাকে। এমনকি লেবু ও পেয়ারা গাছেরও জাব পোকা ক্ষতি করে। জাব পোকারা দলবদ্ধভাবে সাধারণতঃ পাতার নিচের পিঠে থাকে। পোকাগুলো দেখতে খুব ছোট ছোট, রঙ সবুজ থেকে কালচে সবুজ। জাব পোকা যেখানে থাকে সেখানে পিঁপড়াও ঘুরে বেড়ায়। তবে শুধু পাতা নয়, এরা কচি ফল ও ফুলেও আক্রমণ করে। সেখান থেকে রস চুষে খায়। ফলে পাতা, ফুল, ফল বিকৃত হয়ে যায়, বৃদ্ধি থেমে যায়। পূর্ণাঙ্গ ও বাচ্চা দু’ অবস্থাতেই এরা ক্ষতি করে। এ ছাড়া জাব পোকা সবজির ভাইরাস রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। বিনা বিষে এ পোকাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে নি¤œলিখিত ব্যবস্থাদি নেয়া যেতে পারে-
১. শুকনো গোবর গুঁড়ো করে সবজি গাছের জাব পোকা আক্রান্ত অংশে ছিটিয়ে দিতে হবে।
২. একইভাবে কাঠের ছাই ছিটিয়েও উপকার পাওয়া যায়।
৩. একটি মাটির পাত্রে গো মূত্র রেখে ১৪-১৫ দিন পচাতে হবে। পরে তার সাথে ১০ গুন পানি মিশিয়ে ক্ষেতে স্প্রে করতে হবে।
৪. সম পরিমাণ রসুন ও কাঁচা মরিচ বেটে তা ২০০ গুন পানির সাথে মিশিয়ে জাব পোকা আক্রান্ত ক্ষেতে ছিটালে ভাল উপকার পাওয়া যায়।
৫. সেচ দেয়ার সময় সেচের পানির সাথে সেচ নালায় সামান্য পরিমাণ ক্যাস্টর অয়েল মিশিয়ে দিলে উপকার পাওয়া যায়।
৬. ধুপের ধোঁয়া দিয়ে জাব পোকা তাড়ানোর কথা শোনা গেছে। পরীক্ষা করে বিষয়টি যাচাই করা যেতে পারে।
৭. সাবান পানি স্প্রে করেও জাব পোকা দমন করা যায়। পরিমাণ হল প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৪০ গ্রাম গুঁড়া সাবান।
৮. আতা, শরিফা, রসুন, নিম, তামাক ইত্যাদি গাছ গাছড়া থেকে বালাইনাশক তৈরি করে জাব পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহার করা যায়। এসব গাছের কাঁচা পাতা বেটে রস করে পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত গাছে স্প্রে করা যায়। শুকনো তামাকপাতা সারারাত পানিতে ভিজিয়ে সেই পানি ছেঁকে তার সাথে দশগুণ পানি মিশিয়ে আক্রান্ত গাছে সোপ্র করা যায়। ১০০-২৫০ গ্রাম রসুনের কোয়া বেটে রস করে তা ১০ লিটার পানির সাথে মিশিয়ে আক্রান্ত গাছে স্প্রে করা যায়।
৯. হলদে রঙের আঠা ফাঁদ পেতেও পাখাযুক্ত জাব পোকাদের আকৃষ্ট করে মারা যায়। একটা ছোট স্বচ্ছ প্লাস্টিকের বয়েমের ভেতরে হলুদ রঙ করে সেটা একটা কাঠির মাথায় উপুর করে আক্রান্ত ক্ষেতে টাঙিয়ে দেয়া যায়। এর ভেতরে গ্রীজ বা আঠালো পদার্থ লেপে দিলে পাখাওয়ালা জাব পোকারা হলুদ রঙে আকৃষ্ট হয়ে বয়েমের ভেতরে ঢুকে আঠায় আটকে মারা পড়বে। এতে ক্ষেতে জাব পোকার সংখ্যা ও বিস্তার কমে যাবে।