ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা) : চিংড়ি ঘেরে ব্যাপক ভাইরাস সংক্রমণে রফতানিমুখী চিংড়ি শিল্প এখন চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। ভরা মওসুমে বাগদা চিংড়ির ঘেরে ব্যাপক ভাইরাস সংক্রামণে সর্বস্বান্ত হতে বসেছে চাষিরা। ক্ষতিগ্রস্ত চিংড়ি চাষিরা এখন লাভ তো দূরের কথা, ব্যাংক, ঋণদানকারী সংস্থা এবং পোনা ডিপোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের দায় দেনা পরিশোধের চিন্তাতেই দিশেহারা হয়ে পড়ছেন । উপকূলীয় এলাকার ঘেরগুলোতে ভাইরাস সংক্রমণে ব্যাপক হারে মারা যাচ্ছে চিংড়ি। এতে সাদা সোনা খ্যাত গলদা ও বাগদা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন চাষিরা। চাষিদের অভিযোগ, মৎস্য বিভাগ থেকে সঠিক চিংড়ি পরিচর্যা নিয়ে খামারিদের পরামর্শ না পাওয়ায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। তবে চিংড়ি চাষিদের এ অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা মৎস্য বিভাগ বলছে, চাষিরা ধারন ক্ষমতার অধিক রেনু পোনা চাষ করার ফলে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, চিংড়ি চাষের অন্যতম ক্ষেত্র বাগেরহাট জেলার, মংলা রামপাল উপজেলায় ১০টি ইউনিয়নের সর্বত্রই ভাইরাস সংক্রামণের কারণে চিংড়ি ঘেরে ব্যাপকভাবে সংক্রমণ লেগেছে। প্রায় ৯০ শতাংশ চিংড়ি ঘেরেই ভাইরাস সংক্রমণ ঘটেছে বলে দাবি চিংড়ি চাষিদের।তাদের অজান্তেই অত্যন্ত সন্তর্পনে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাছে সংক্রমণ ভাইরাস লেগেই তাদের মারাত্মক সর্বনাশ হয়ে গেছে বলে তারা জানান।
চিংড়ি চাষিদের কাছ থেকে জানা গেছে, ভাইরাস সংক্রমিত মাছ পানির তলদেশে মাটির সাথে লেগে থাকে। পরে জাল টেনে কিংবা হাতিয়ে মরা মাছের খোলস পাওয়ার পর মাছের মড়কের ব্যাপারে আঁচ করা গেছে।
অনেকে জানান, যেসব মরা চিংড়ি পাওয়া গেছে সেগুলোর মাথা, পিঠ, লেজসহ সর্বাঙ্গে সাদা ও খয়েরী গুটি গুটি স্পট দেখা গেছে। এ বছর পোনার দাম তুলনামূলকভাবে কম থাকায় চিংড়ি চাষিরা বিপুল উৎসাহে প্রচুর পোনা ঘেরে ছাড়ে। কিন্তু ফলন উঠানোর সময়ে তারা চরম বিপত্তির শিকার হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অনেকে হতাশায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছেন।
মৎস্য বিভাগ জানায়, জেলার শুধুমাত্র মংলা উপজেলা, প্রতিবছর দেশের দুই লাখ ৩০ হাজার ঘেরে একলাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন রফতানিযোগ্য গলদা ও বাগদা চিংড়ি উৎপাদন হয়। এর বেশিরভাগই মোংলা বন্দর সংলগ্ন এ উপকূলীয় এলাকার চিংড়ি ঘেরগুলো থেকে উৎপাদিত হয়। কিন্তু ভাইরাসসহ নানা রোগে এখন এ এলাকার ঘেরের চিংড়ি মরে যাচ্ছে।
চাষিদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, ভাইরাসের সংক্রমণে অনেকের ঘেরের চিংড়ি মরে গেছে। পুঁজি হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তারা। এ অবস্থার জন্য মৎস্য বিভাগ থেকে সঠিক পরামর্শ না পাওয়ার অভিযোগ করেন তারা।
উপজেলার চিলা ইউনিয়নের চাষি হরিপদ মন্ডল বলেন, ভাইরাসে বারবার আমরা মার খাচ্ছি; ধ্বংসের পথে। কিন্তু এ পর্যন্ত উপজেলা মৎস্য বিভাগ থেকে কোনও সহযোগিতা পাইনি, এমনকি পরামর্শ পর্যন্ত না।
বুড়িরডাঙ্গা ইউনিয়নের আরেক চাষি শেখর মন্ডল বলেন, ‘ব্যাংক থেকে লাখ লাখ টাকা লগ্নি করেছিলাম। পুঁজি হারিয়েছি। ভাইরাসে ঘেরের সব চিংড়ি মরে গেছে। এখন ব্যাংকের টাকা কীভাবে শোধ করবো, বুঝতে পারছি না। ভাইরাস যতদিন ধ্বংস না হবে, লাভের আশা আর করছি না।
মোংলা বাজারের চিংড়ি আড়তদার মো. মোসলেম মিয়া ও শাজাহান ফকির জানান, তারা প্রতিবছর চাষিদের কয়েক লাখ টাকা দাদন (অগ্রিম) দিয়ে চিংড়ি চাষ করান। কিন্তু ভাইরাসের সংক্রমণে এবার সব চিংড়ি মরে গেছে। ভাইরাস সংক্রমণ ও চিংড়ি মরার পেছনে চাষিদের ‘অপরিকল্পিতভাবে চা‘ কে দায়ী করে উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা এ জেড তৌহিদুর রহমান বলেন, ‘ঘেরে অতিরিক্ত চিংড়ি চাষের জন্য ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে।
অপরদিকে পরিবেশ সংশ্লিষ্ঠরা জানান, চিংড়ির মড়ক মানেই সবক্ষেত্রে ভাইরাস সংক্রমণ বলা চলে না। উপজেলার অধিকাংশ ঘেরে মাছ মরছে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে। কয়েকটি সুনির্দিষ্ট কারণস্বরূপ তিনি মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততা (যার সহনশীল মাত্রা ৭ পিপিটি ছাড়িয়ে বর্তমানে ১৫-২০ পিপিটি পর্যন্ত উঠেছে) তাপমাত্রার তারতম্য, ঘেরের পর্যাপ্ত গভীরতার অভাব, পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন এসিড ও খারের মাত্রা স্বল্পতা, মাছের অধিক ঘনত্ব, নদী, খাল আবদ্ধ রেখে মাছ চাষ করার কারণে ঘেরে স্বাভাবিক জোয়ারের পানি সরবরাহ বন্ধ, অক্সিজেন ঘাটতি, অপরিচ্ছন্নতা, খাদ্য সংকট প্রভৃতিকে মাছের মড়কের জন্য দায়ী করে পরিবেশ বান্ধব চিংড়ি চাষ, মৎস্য ঘেরে জোয়ারের পানি সরবরাহের ব্যবস্থা, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, সুষম খাবার চুন সার প্রয়োগ, পিসিআর যন্ত্রে পরীক্ষিত ভাইরাসমুক্ত পোনা ঘেরে ছাড়া, প্রকৃতিক খাবার সৃষ্টির মাধ্যমে এ ধরনের মড়ক থেকে পরিত্রাণ সম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন।
পরিবেশবান্ধব ও উন্নত পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রকল্পের আওতায় চলতি বছর উপজেলার প্রায় ১১শ চিংড়ি চাষিকে প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব হয়েছে। তবে এটা চাহিদার তুলনায় নিতান্তই সীমিত বলে তিনি জানান। প্রশিক্ষণ ও সচেতনাতামূলক কর্মকান্ডে ব্যাপক অর্থ বরাদ্দ না বাড়ালে এবং উপজেলা পর্যায়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও লোকবল বৃদ্ধি না করা গেলে রফতানিমুখী এ শিল্পকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না বলে তাদের আশঙ্কা ।
এ ব্যাপারে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. গাউছিয়াতু রেজা বানু বলেন, ভাইরাস নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। দেখা গেছে, ঘেরে অতিরিক্ত তাপমাত্রা সৃষ্টি হলে চিংড়িতে ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয়। ঘেরে কমপক্ষে তিন-পাঁচ ফুট গভীরতা দরকার। কিন্তু চিংড়ি চাষিরা এক-দেড় ফুট গভীরতার ঘের করেন। ফলে পানি গরম হয়ে ওঠে এবং চিংড়ি মারা যায়। ভাইরাস মোকাবিলায় চাষিদেরই সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।