বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রধানত কৃষি নির্ভর। এই কৃষি নির্ভর অর্থনীতির একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে প্রাণিসম্পদ। বর্তমানে জিডিপিতে প্রাণিসম্পদের অবদান প্রায় ৬.৫%। কিন্তু অন্যান্য সম্পদের তুলনায় প্রাণিসম্পদ আজও অনেকটা অবহেলিত, অব্যবহৃত। সম্প্রতি আমরা নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করেছি। তবে এই আশার আড়ালে যে নিরাশাজনক বিষয়টি রয়েছে তা হলো- দরিদ্রতা। যা নি:সন্দেহে একটা দেশের উন্নয়নের অন্যতম অন্তরায়। এখনো বাংলাদেশের প্রায় ২৬ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছে। এছাড়া চরম দারিদ্র্যে থাকা মানুষের সংখ্যাও কম না, তা এখনো প্রায় ১৬%। দারিদ্রের সাথে যে বিষয়টি আমাদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে তা হলো পুষ্টিহীনতা।
আমাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৭ শতাংশ মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। এক্ষেত্রে প্রাণিসম্পদের উন্নয়ন ও সংরক্ষণই হতে পারে দারিদ্র্য ও পুষ্টিহীনতা সমস্যা দূরীকরণেকার্যকর ও সময়োপযোগী উপায়। আমরা যদি প্রাণিসম্পদের যথাযথ উন্নয়ন করতে পারি তাহলে তা দেশের চাহিদা মিটিয়ে পার্শবর্তী দেশ ভারত, চীনের বিপুল জনসংখ্যার চাহিদা পূরন করে আমাদের জন্য ক্সবদেশিক মুদ্রা আয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ পথ খুলে দিবে। কিন্তু শুধু কৃষিবিদদের পক্ষে এ বিশাল খাতের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ করা সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন সরকারের নীতি প্রণয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রনালয় থেকে সর্বোচ্চ সাহায্য ও সহযোগিতা।
গত কয়েক বছরে প্রাণিসম্পদ খাতে বেশ উন্নতি করতে পারলেও শতভাগ চাহিদা মেটাতে পারছে না। দেশে এখনো প্রায় ৭৫ লাখ টন দুধ ও ১১লাখ টন মাংস এবং প্রায় সাড়ে ৫৫ কোটি ডিমের ঘাটতি রয়েছে (বণিক বার্তা, মার্চ ২৮, ২০১৬)। পোল্ট্রি হচ্ছে অন্যতম প্রাণীজ আমিষের উৎস। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে পোল্ট্রি সেক্টরে হাজার কোটি টাকারও কম বিনিয়োগ ছিল। বর্তমানে তা ৩০ হাজার কোটি টাকাও ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু পোল্ট্রি খামার ও ফিড দুটিই করের আওতাভুক্ত হওয়ায় যে হারে বিনিয়োগ আসার কথা ছিল তা আসছে না। ফলে এ খাতের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
প্রথম দিকে আমরা বিদেশী টেকনিশিয়ানদের উপর নির্ভরশীল ছিলাম। কিন্তু দেশে এখন যোগ্য টেকনিশিয়ান তৈরি হয়েছে। খাতটির উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারী খাতের যে প্রচেষ্টা, বিশেষ করে পোল্ট্রি বোর্ড গঠন, উন্নত জাতের ব্রিড আমদানি, স্বল্প সুদে ঋণপ্রদান উৎপাদনশীলতা বাড়াতে বিশেষ সহায়ক হবে বলে ধারনা করা যায়। আশা করা যায় ২০২০ সালের মধ্যে এ খাতে বিনিয়োগের পরিমান ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে এবং প্রায় ১ কোটি লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। পোল্ট্রির জন্য যেসব খাদ্য উপকরণ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় তার উপর প্রায় ৩৫ শতাংশ করারোপ করা হয়েছে। এছাড়াও গত তিন চার মাস ধরে হঠাৎ করেই ভ্যাকসিন আমদানির অনুমোদন দেয়া বন্ধ করা হয়েছে। এর ফলে ছোট বড় খামারগুলোতে রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে। তাছাড়া যে পোল্ট্রি বোর্ড গঠনের কা ছিল সেটাও আজ অবধি আলোর মুখ দেখেনি। পোল্ট্রি থেকে আমরা যে মাংস ও ডিম পাচ্ছি তা নিঃসন্দেহে নিরাপদ ও সাশ্রয়ী আমিষের উৎস।
ডেইরি সেক্টর পেশার ক্ষেত্র হিসেবে অতি পুরাতন, কিন্তু কতিপয় সমস্যার কারণে এর উন্নয়ন এতদিন ব্যাহত হয়েছে। আমাদের দৈনিক মাথাপিছু ২৫০ মি.লি. দুধ খাওয়া প্রয়োজন, কিন্তু চাহিদা ও যোগানের মধ্যে ভারসাম্যহীনতার কারণে সেটা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। আমাদের দেশে পালিত গরুর ৯৯ শতাংশই ব্যক্তি পর্যায়ে পালন করা হচ্ছে এবং বাণিজ্যিকভাবে পালন হচ্ছে মাত্র ১ শতাংশ। প্রায় ৩০ বছর আগের ব্রিড দিয়ে এখনো গাভী ও দুধ উৎপাদন হচ্ছে। ফলে উৎপাদনশীলতা যেমন কমছে, খামারিদের খরচও তেমনি বাড়ছে, খামারীরা হচ্ছে মুনাফা বঞ্চিত। বাংলাদেশে মোট বার্ষিক দুধ উৎপাদন প্রায়
২.৮৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন (আইএফসিএন, ২০১৩)। জাতীয় পর্যায়ে দুধ উৎপাদনের পরিমান মোট চাহিদার শুধুমাত্র ১৩% মেটাতে পারে। আর এই ঘাটতি পূরণ হচ্ছে বিভিন্ন দেশ যেমন- অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, হল্যান্ড, ডেনমার্ক থেকে আমদানিকৃত পাউডার দুধের মাধ্যমে। গ্রামের নারীদের যদি আমরা একটি করে দুগ্ধবতী গাভী দিতে পারি, তাহলে একদিকে যেমন আমরা দুধ পাব অন্যদিকে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও হবে। এর মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নও বাড়বে। দক্ষ জনবলের ঘাটতি থাকায় আগে বাইরে থেকে লোক আনতে হতো। কিন্তু বর্তমানে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে যে পরিমান অ্যানিম্যাল সায়েন্স গ্রাজুয়েট বা পশুপালন গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে, তাতে আর দক্ষ কর্মীর অভাব নেই। তাই এই খাতের সার্বিক অগ্রগতির জন্য সরকারের যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহন ও বাস্তবায়ন দরকার।
পুষ্টিগুন সম্পন্ন সুষম খাদ্য সরবারহের মাধ্যমে গবাদিপশুর উৎপাদনের গতিশীলতা বজায় রাখা যায়। নিম্নমানের পুষ্টিমান সম্পন্ন খাদ্য সরবরাহ দুধ ও মাংস উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটা বড় প্রতিবন্ধক। আমাদের দেশে গবাদিপশুর জন্য যে চারণভূমি আছে এবং তাতে যে ঘাসের উৎপাদন হচ্ছে তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। আমাদের দেশে খাদ্য হিসেবে প্রধানত খড় ও ঘাস খাওয়ানো হয়। দানাদার খাদ্য দেয়া হয় না বললেই চলে। দানাদার খাদ্যের দাম তুলনামুলক ভাবে বেশি হওয়ায় তা গরীব খামারিদের পক্ষে সরবারহ করা দুষ্কর। আমাদের দেশে কোন উন্নত ফিডিং সিস্টেম না থাকার কারণে গ্রহনযোগ্য উৎপাদন বজায় রাখার জন্য পুষ্টি চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। উপযুক্ত যন্ত্রপাতিতে সুসজ্জিত ল্যাবরেটরি না থাকার দরুন পশু খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রন ও যাচাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা চালানো সম্ভব হচ্ছে না।
সিজনাল ঘাস, আঁশযুক্ত শস্য রেসিডিউ দিয়ে “সাইলেজ” ও ”হে” তৈরি করে সংরক্ষণ করতে হবে, যাতে অফ সিজনেও বিরূপ আবহাওয়ায় খাদ্য সংকটের সময় সেগুলো ব্যবহার করা যায়। সর্বোপরি পশুখাদ্যের সহজলভ্যতা ও মান বাড়াতে দক্ষ অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রিয়ান দ্বারা ব্যাপক গবেষণা কার্যক্রম চালাতে হবে। বর্তমানে আমাদের দেশে গবাদিপশুর ব্রিডিং সমস্যা সংকটে রূপ নিয়েছে। আমাদের দেশের অনেক কৃষকের ধারণা যে, বিদেশি জাতের গরুর সাথে দেশী গরুর প্রজনন করলে জাত উন্নয়ন হবে এবং দুধ ও মাংসের উৎপাদন বাড়বে। এই ভুল ধারণা সংশোধনের জন্য মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারন কৃষি কার্যক্রম ও প্রশিক্ষণবাড়াতে হবে। ক্রস ব্রিডিংয়ের ক্ষেত্রে “Right breed in the right place” এই নীতিটি অনুসরণকরতে হবে। আমাদের দেশে ব্রিডিংয়ের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন খুবই সীমিত পরিসরে। ব্রিডিং এক্সপার্টের মাধ্যমে এই উন্নয়নের পরিসীমা বাড়াতে হবে। সর্বোপরি লোকাল জেনেটিক রিসোর্স হিসেবে দেশী গরুর পালনে যত্নবান হতে হবে এবং এর সংরক্ষণ বাড়াতে হবে।
সীমাবদ্ধতা সমূহ
পশুখাদ্যের উচ্চমূল্য ও অপ্রতুলতা,বিভিন্ন সংক্রামক, ইমার্জিং ও জেনেটিক রোগসমূহ প্রাণিসম্পদ খাত উন্নয়নের বাধাস্বরূপ। পোল্ট্রি ও প্রাণীজ পণ্য (দুধ, ডিম ও মাংস ইত্যাদি) বাজারজাতকরণে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম অস্থিতিশীল বাজারমূল্য ও বাজারজাতকরণে সমস্যার সৃষ্টি করছে। জাত উন্নয়নের জন্য নিরবিচ্ছিন্ন গবেষণার অভাব রয়েছে। এছাড়াও, কখন উৎপাদন করা উচিত, কি পরিমানে উৎপাদন করা উচিত, কখন বাজারে গেলে মুনাফা হবে এ নিয়ে তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উদাসীনতা ও নিস্পৃহ আচরণএবং পর্যাপ্ত সংখ্যক দক্ষ গ্রাজুয়েট থাকা সত্ত্বেও উপযুক্ত কোন অর্গানোগ্রাম না থাকার দরুন খামারী পর্যায়ে প্রাণিসম্পদের সম্প্রাসরণ এখনও অপর্যাপ্ত রয়েছে।
চ্যালেঞ্জসমূহ
মানসম্মত প্রাণী ও পোল্ট্রির খাদ্যের মান উন্নয়ন ও খাদ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণ এবং অধিক উৎপাদনশীল টেকসই জাত ও রোগ প্রতিরোধ কৌশল উদ্ভাবনের মাধ্যমে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণকরা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
কৃষি ক্ষেত্রে উন্নয়ন বর্তমানে বৈপ্লবিক আকার ধারণ করেছে। কৃষি ক্ষেত্রের প্রসার ঘটানোর জন্য যেমন ধান গবেষণা কেন্দ্র, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, পাট গবেষণা কেন্দ্র ইত্যাদি স্বতন্ত্র গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তেমনি খামারী ও জাতীয় পর্যায়ে প্রাণিসম্পদের ব্যপক প্রসার ঘটানোর জন্য যদি পোল্ট্রি উন্নয়ন বোর্ড, ডেয়রি উন্নয়ন বোর্ড এবং এ জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান, প্রাসঙ্গিক বোর্ড ও পলিসি গঠন করা যায় এবং তার যথাযথ ও সমোয়পযোগী বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ করা হয়, তাহলে প্রাণিসম্পদ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এক অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে।
লেখক:
প্রফেসর ড. সৈয়দ মো. এহসানুর রহমান, এ্যানিমেল সায়েন্স বিভাগ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।
রোমানা আফরোজ রিতু, এম.এস. এ্যানিমেল সায়েন্স বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।