শুক্রবার , ডিসেম্বর ২৭ ২০২৪

সুপারি-নারিকেল গাছে নতুন পোকা সনাক্ত করেছেন পবিপ্রবি গবেষকরা

ইফরান আল রাফি (পবিপ্রবি প্রতিনিধি): বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে পটুয়াখালী জেলার দুমকি উপজেলায় সুপারি ও নারিকেল গাছে মারাত্মক ক্ষতিকারক প্রজাতির ব্যাগওয়ার্ম সর্বপ্রথম সনাক্ত করেছেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান ও প্রফেসর ড. এস. এম. হেমায়েত জাহান এর নেতৃত্বাধীন এক দল গবেষক। এ সংক্রান্ত তাঁদের গবেষণাপত্রটি আর্ন্তজাতিক বৈজ্ঞানিক সাময়িকী “ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ইনোভেটিভ রিসার্চ” এ ২০১৯ সালের এপ্রিল ইস্যুতে প্রকাশিত হয়েছে।

উক্ত গবেষণাপত্রে গবেষকবৃন্দ উল্লেখ্য করেন, লেপিডোপটেরা বর্গের সিকিডি পরিবারে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৩৫০টি প্রজাতির ক্ষতিকারক ব্যাগওয়ার্ম পোকা রয়েছে। যাদের মধ্যে মাহাসিনা করবেটি (Mahasena corbetti)  নামক প্রজাতির ব্যাগওয়ার্মটি মারাত্মক ক্ষতিকারক। এ প্রজাতির পোকা শুধুমাত্র অর্থকরী ফসল যেমন সুপারি, নারিকেল কিংবা পামজাতীয় অন্যান্য গাছের সকল পাতা ভক্ষণ করে এমনটি নয় বরং শুভাবর্ধনকারী গাছ মেহেদি ও ড্রসিনার পাতাও ভক্ষণ করে গাছকে পল্লবহীন করে মেরে ফেলে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশসহ প্রশান্ত মহাসাগরীয় কিছু দ্বীপে এই প্রজাতির পোকার সন্ধান মিললেও বাংলাদেশে ইতোপূর্বে এই প্রজাতির পোকার কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। পূর্বে মালয়েশিয়া, সিংগাপুর, থাইল্যান্ড, ফিলিপিন, সুমাত্রা, জাবা, ব্রুনাই, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ ও পাপোয়া নিউগিনি থেকে এ প্রজাতির পোকা সনাক্ত হলেও ২০১৫-১৬ সালে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মেঘালয় প্রদেশের পূর্ব পাহাড়িয় খাশি জেলায় সুপারি গাছে প্রথম এ প্রজাতির পোকা সনাক্ত হয় যা ২০১৮ সালের বৈজ্ঞানিক সাময়িকী “ফাইটোপ্যারাসাইটিকায়” প্রকাশ পায়।

বাংলাদেশে সুপারি ও নারিকেল গাছে ক্ষতিকারক প্রজাতির ব্যাগওয়ার্ম মথ সনাক্তকরণ ও তার অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে গবেষণা প্রধান প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, “বাংলাদেশে ২০১৮ সালে পবিপ্রবি খামারের সুপারি গাছে সর্বপ্রথম এ প্রজাতির ব্যাগওয়ার্ম দৃষ্টিগোচর হলে তা সংগ্রহ করে গবেষণাগারে লালন-পালন করে তার পূর্ণাঙ্গ জীবনচক্র দেখা হয়। কারণ, মুক্তাবস্থায় পূর্ণাঙ্গ মথ খুঁজে পাওয়া খুবই দুষ্কর এবং প্রজাতি সনাক্তকরণে পূর্ণাঙ্গ পুরুষ মথ প্রয়োজন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে গবেষকবৃন্দ নিশ্চিত হয় যে এটা মাহাসিনা করবেটি (Mahasena corbetti)  নামক প্রজাতির একটি মারাত্মক ক্ষতিকারক ব্যাগওয়ার্ম। গবেষণা চলাকালীন সময়ে গবেষকবৃন্দ এ প্রজাতির পোকার উপস্থিতি নারিকেল, মেহেদি ও ড্রসিনা গাছেও লক্ষ্য করেন। দুশ্চিন্তার বিষয় এ পোকার হোস্টপ্লান্টের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ পোকায় আক্রমণে গাছের এক থেকে দুই তৃতীয়াংশ পাতা খেয়ে ফেলার কারণে বিনষ্ট হয়, কখনো বা পুরো গাছটিই শুকিয়ে মারা যায়। পরিসংখ্যানে দেখা যায় এ পোকার আক্রমনে ৪০-৫০% ফলন নষ্ট হয়ে যায় যা অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মক ক্ষতি।”

কীভাবে এ পোকা দমন করা যায় এমন প্রশ্নের প্রত্যুত্তোরে তিনি বলেন, এ পোকা দমন করতে হলে সূচনালগ্নেই সিস্টেমিক কীটনাশক প্রয়োগ করে লার্ভা এবং সঠিক ফেরোমন/আলো ফাঁদ ব্যবহার করে পূর্ণাঙ্গ মথ মেরে ফেলতে হবে, নতুবা ব্যাগের  ভেতর থাকাকালীন মারা একটু কষ্টসাধ্য ব্যপার হয়ে যাবে।

তিনি আরো বলেন, সঠিক দমন পদ্ধতি উদ্ভাবনে আমাদের গবেষণা কার্যক্রম চলমান আছে। আশা করি খুব শিগ্রই আমরা একটি ভালো দমন পদ্ধতি উদ্ভাবনে সক্ষম হবো ইনশাল্লাহ। এ গবেষণা দলের অন্যান্য গবেষক হলেন প্রফেসর ড. এস. এম. হেমায়েত জাহান, মো. সাব্বির তালুকদার, মো. রুবেল কাজী ও মো. সাদিকুল ইসলাম।

উল্লেখ্য, প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান গবেষণার সূচনালগ্ন থেকেই ইনসেক্ট সিস্টেমেটিক্সের উপর কাজ করে আসছেন। ইতোমধ্যে তিনি বিশ্বে ২৬টি নতুন প্রজাতির (new species) এবং ৪০টি দেশে প্রথম বারের মতো সনাক্তকৃত (new record) প্লান্টহোপার ও লিফহোপারের প্রজাতি সনাক্ত করেন যা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক র্জানালে প্রকাশিত হয়েছে। গত সাত বছর ধরে তিনি তাঁর পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন ইনসেক্টের টেক্সোনমিক গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

২০১৮ সালের মে মাসে তাঁর তত্ত্বাবধানে একজন এম.এস. ছাত্র মোঃ সাইফুল আলম আম গাছে প্রথম বারের মতো দুটি ম্যাঙ্গোহোপার [Idioscopus nagpurensis (Pruthi) I Idioscopus nitidulus (Walker)] সনাক্ত করেন যা  আর্ন্তজাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়াও রয়েছে জিনোম সিকুন্সিংসহ নতুন প্রজাতির প্লান্টহোপার, Hauptenia bandarbanensis Jhan & Rahman, 2016 যা বান্দরবান থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল।

গবেষণায় ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, ”বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কতোগুলো ইনসেক্টের প্রজাতি রয়েছে তার সঠিক কোন চেকলিস্ট এখনো প্রকাশিত হয়নি। আমার লক্ষ্য হচ্ছে শতআর্থিক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বাংলাদেশের মেজর কিছু অর্ডারের ইনসেক্টের চেকলিস্ট তৈরীসহ তাদের জিনোমিক সিকুয়েন্স প্রকাশের নিমিত্তে কাজ করা। আমি জানি কাজটি অনেক কষ্টসাধ্য, তবুও আমার চেষ্টা থাকবে নিরন্তর যাতে ইনসেক্ট বায়োরিসোর্সের দিক থেকেও আমাদের দেশ পিছিয়ে না থাকে।”

This post has already been read 6615 times!

Check Also

ফসলের উৎপাদন বাড়তে বেশি করে গবেষণার নির্দেশ দিয়ে কৃষিমন্ত্রীর

গাজীপুর সংবাদদাতা: ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বেশি করে গবেষণা করতে কৃষি বিজ্ঞানী ও গবেষকদের নির্দেশ …