ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা) : ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সরকার প্রধান বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা দিলেও এখনও দস্যু তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে বিশ্বে সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় (ম্যানগ্রোভ) সুন্দরবনে । আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অব্যাহত তৎপরতা সত্বেও এখানে নানা কৌশলে চলছে দস্যুতা। বিশেষ করে বনের ভেতরে মধু, মাছ, কাঁকড়া ও গোলপাতা সংগ্রহকারীদের উপরেই এসব বনদস্যুরা নির্যাতন চালায়। তাদের আটকে রেখে হত্যার ভয় দেখিয়ে তাদের পরিবার সদস্যদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করে। গত ৮ মাসে র্যাবের হাতে ১৯ বনদস্যু নিহত হলেও এখনও ছোট ছোট গ্রুপে এসব দস্যুর অপরাধ তৎপরতা চালাচ্ছে। সম্প্রতি র্যাব অভিযোগ করেছে, সুন্দরবন ঘিরে বড় বড় মাছের কারবার করেন যেসব ব্যবসায়ীরা তারাই এখন এসব বনদস্যুদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিচ্ছেন। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিক্তিতে ইতিমধ্যে কয়েকজন মাছ ব্যবসায়ীকে গ্রেফতারও করেছে র্যাব-৬ সদস্যরা।
র্যাব-৬ স্পেশাল কোম্পানি কমান্ডার মেজর শামীম সরকার বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরও সুন্দরবনে যারা বনদস্যুতায় নেমেছে তাদেরকে শক্তভাবে প্রতিহত করা হচ্ছে। নিয়মিত টহলের কারণে বনদস্যুরা সুন্দরবনে অবস্থান নিয়ে থাকার দুঃসাহস রাখতে পারছে না। আত্মসমর্পণ করার পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া বনদস্যুরা ছোট ছোট গ্রুপ তৈরি করে নতুন দল গড়ে তুলেছে। এ কারণেই সুন্দরবনে আবারও বনদস্যুরা ফিরে আসছে বলে মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, সুন্দরবনে মধু, কাঁকড়া এবং মাছ আহরণকারীদের বিভিন্ন সময় ছোট ছোট জলদস্যুবাহিনী আটকে রেখে মুক্তিপণ চেয়ে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করে। এসব বনদস্যু বাহিনী সুন্দরবনের বিভিন্ন রেঞ্জের নদী এবং নদী সংলগ্ন বিভিন্ন খাল এলাকায় নিরীহ জেলেদেরকে অপহরণ ও মাছ ধরার ট্রলারে লুটপাট চালায়। কৌশলে জেলেদের পরিবারকে ফোন করে জনপ্রতি বিপুল অংকের টাকা মুক্তিপণ দাবি করে সেই টাকা আদায় করে জেলে ও বাওয়ালীদের ছেড়ে দিচ্ছে।
গত বছরের ১ নভেম্বর সুন্দরবনকে বনদস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হয় । এর পর গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের জোংড়া এলাকায় র্যাব-৮ এর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে বনদস্যু আরিফ বাহিনীর প্রধান আলিমসহ ৪ দস্যু নিহত হয়। নিহতরা হলো বাগেরহাটের মোংলা পৌর শহরের সিগন্যাল টাওয়ার এলাকার আ. আউয়ালের ছেলে আ. আলিম ওরফে আলিফ (২৫), আফজাল হাওলাদারের ছেলে রাজু (২২), আলতাফ গাজীর দুই ছেলে সোহেল (৩০) ও রুবেল (২৫)। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে বনদস্যু সাহেব আলী বাহিনীর প্রধান সাহেব আলী ও সেকেন্ড ইন কমান্ড হাবিবুর নিহত হয়। উদ্ধার হয় ২টি একনলা বন্দুক, ১টা পাইপগান ও ৩২ রাউন্ড গুলি। সেসময় ঘণ্টাব্যাপী বন্দুকযুদ্ধ হয়েছিল। ৬ মে পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের চরপুটিয়া এলাকার খোস্তা কোদালিয়া খালে র্যাব-৬ সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে বনদস্যু রানা বাহিনীর ৩ সদস্য নিহত হয়। এরা হচ্ছে রানা বাহিনীর প্রধান পান্না ওরফে রানা (২৮), তার সেকেন্ড ইন কমান্ড জুলহাস (৩০) ও সদস্য কামরুজ্জামান (৩৯)। এ সময় ৪টি আগ্নেয়াস্ত্র, একটি নৌকা ও বিপুল সংখ্যক গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। ৩০ মে গভীর রাতে পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের জোংড়ার খাল এলাকায় র্যাব-৮ এর সঙ্গে পৃথক বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় হাসান বাহিনীর প্রধান হাসান (৪০) তার সহযোগী মোস্তাঈন (৩৭) ইনুল (৩৫) এবং হায়দার (৪৪)। এ সময় র্যাব ১১টি আগ্নেয়াস্ত্র ও কয়েকটি ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করে। অস্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ৫টি পাইপ গান, ৩টি ওয়ান শ্যুটার গান, ২টি বন্দুক ও ১টি এয়ার গান। ২৩ জুলাই পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের জোংড়া খালে র্যাব-৮ ও দস্যুদের মধ্যে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ খালেক বাহিনীর প্রধান খালেক ও সদস্য বিল্লাল নিহত হয়। তাদের বাড়ি খুলনার দাকোপ উপজেলায়। সর্বশেষ ১৫ অক্টোবর সুন্দরবনের কয়রা খালে র্যাব-৬ এর সঙ্গে আরেক বন্দুকযুদ্ধে ৪ দস্যু নিহত হয়। নিহতরা হচ্ছে বাহিনী প্রধান আমিনুর ও তার সেকেন্ড ইন কমান্ড রফিক, আক্তার হোসেন ও মনীষ সাহা। র্যাব ঘটনাস্থল থেকে দেশি তৈরি তিনটা একনলা বন্দুক, ২৫ রাউন্ড গুলি ও ৯টি গুলির খোসা উদ্ধার এবং ডাকাতদের ব্যবহৃত নৌকা জব্দ করে।
র্যাব-৬ এর গোয়েন্দা তথ্যে জানা গেছে, উপকূলীয় এলাকায় মৎস্য ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতায় সুন্দরবনে বনদস্যুতা কার্যক্রম পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এসব মৎস্য ব্যবসায়ীর সঙ্গে বনদস্যুদের সরাসরি যোগাযোগ থাকে। প্রতিটি কোম্পানির অধীনে ৪০-৫০টি মাছ ধরার নৌকা জিম্মি থাকে। যারা মূলত কোম্পানির কাছ থেকে গোণ প্রতি ২ থেকে ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে টিকিট ক্রয় করতে বাধ্য হয়। জেলেরা সুন্দরবনে মাছ ধরতে গেলে জলদস্যুরা আটক করে তাদের টিকিট পরীক্ষা করে। টিকিট না পেলে তাদের অপহরণ করে পরিবারের কাছে বিকাশের মাধ্যমে মুক্তিপণ দাবি করে।
র্যাব-৬ গত ১০ অক্টোবর খুলনার কয়রা উপজেলায় অভিযান চালিয়ে দস্যুদের মূল পৃষ্ঠপোষক ও সহযোগীসহ দুই জনকে আটক করে। এ সময়ে তাদের কাছ থেকে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও চাঁদা আদায়ের নথিপত্র জব্দ করা হয়। কয়রা থানা এলাকার মৎস্য ব্যবসায়ী নূর হোসেনের বাসায় অভিযান পরিচালনা করে একটি পাইপগান, ৫টি তাজা গুলি, বিভিন্ন প্রকার ডাকাতির সরঞ্জামাদি ও জেলেদের মুক্তিপণ আদায়ে ব্যবহৃত টিকিট জব্দ করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নুর হোসেন দস্যুতার বিষয়ে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। মোজাফফর নামক আরেক ব্যবসায়ীর নামও উঠে আসে তার কথায়। এছাড়া রয়েছে আমিনুর বাহিনী ও জিয়া বাহিনী। মোজাফফরকে গ্রেফতার করা হয় তার প্রতিষ্ঠান থেকে। এ দুটি বাহিনীর পাশাপাশি রয়েছে জোনাব বাহিনীসহ কয়েকটি ছোট ছোট বাহিনী। আটককৃতরা হচ্ছে মোঃ নূর হোসেন (৩০) কয়রা কয়রা উপজেলার ৪নং কয়রা সরকারি পুকুরপাড় এলাকার আব্দুল ওহাব মিস্ত্রীর ছেলে ও মো. মোজাফ্ফর সরদার (৩২) একই এলাকার এসএম জিয়াদ আলীর ছেলে।
র্যাব-৬ এর পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ মোহাম্মদ নূরুস সালেহীন ইউসুফ গত ১০ অক্টোবর আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আটক দুজন জেলেদের কাছ থেকে টোকেনের মাধ্যমে চাঁদা আদায় করতো। তাদের নামে কয়রা থানায় অস্ত্র ও চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, সুন্দরবন এলাকায় ২০১৬ সালের ৩১ মে থেকে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর পর্যন্ত ৩২টি বাহিনীর ৩২৮ জন দস্যু আত্মসমর্পণ করেছে। এ সময় ৪৬২টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ২২ হাজার ৫০৪ রাউন্ড গোলাবারুদ জমা দেয়। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর বাগেরহাটের শেখ হেলাল উদ্দিন স্টেডিয়ামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুন্দরবনকে আনুষ্ঠানিকভাবে সুন্দরবনকে বনদস্যুমুক্ত ঘোষণা দেন। সর্বশেষ ৬টি বনদস্যু বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সুন্দরবন দস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। এ ঘোষণার পর সুন্দরবনে জেলেরা নির্ভয়ে যাওয়া এবং মাছ,বধু,কাকড়া আহরন করে। দস্যুমুক্ত ঘোষণার কিছুদিন যেতে না যেতে আবারও সুন্দরবনে শুরু হয় দস্যু বাহিনীর আবির্ভাব । সাতক্ষীরা, খুলনা ও চাঁদপাই রেঞ্জ এলাকায় ছোট ছোট দল গড়ে দাপট ছড়াতে শুরু করে নতুন বনদস্যু বাহিনী। এরপর শুরু করে জেলে ও বনজীবীদের জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় চলতে থাকে।