মো. খোরশেদ আলম (জুয়েল) : ‘বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় এক পোলট্রি কোম্পানির ফিড -এর বিষয়ে ফেসবুকে কোন এক খামারি এভাবেই পোস্ট দিয়েছেন। কমেন্ট বক্সে একজন জানতে চেয়েছেন, ভাই কেন ওই কোম্পানির ফিড খারাপ। পোস্ট দাতা উত্তরে জানালেন, ওই কোম্পানির (নাম উল্লেখে করা হলো না) ফিডে আগের মতো এফসিআর (FCR) আসেনা। অর্থাৎ ওই কোম্পানির এফসিআর বাজারে প্রচলিত কোম্পানির চেয়ে কিছুটা কম।
পোলট্রি, হাঁস, মাছ বা যে কোন প্রাণি ব্যবসায় অত্যন্ত গুরুত্ব একটি বিষয়ের নাম এফসিআর। এটির সাথে পণ্যের (মাছ, মাংস) উৎপাদন খরচ সরাসরি জড়িত। বেশি খাদ্য খাওয়ানোর পর কম উৎপাদন পাওয়া মানে এফসিআর বেশি এবং কম খাদ্যে বেশি উৎপাদন পাওয়া মানে এফসিআর কম। সহজ কথায়, এফসিআর কম মানে উৎপাদন খরচ কম। দীর্ঘদিন ধরে খামারিদের এহেন মানসিকতার কারণে এফসিআর কম (১.৫ এর নীচে) সম্পন্ন ফিডের চাহিদা বাজারে বেড়েছে।
খামারির চাহিদা থাকায়, খুব স্বাভাবিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকা ও মুনাফার জন্য বেশিরভাগ ফিড কোম্পানি এফসিআর কমানোর প্রতিযোগিতায় নেমে পড়লো। আর এ প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে বড় উস্কানিদাতা অসাধু কিছু ফিড এডিটিভস কোম্পানি। ফিড ক্ম্পোনিগুলোকে তারা বুঝাতে লাগলো আমার অমুক প্রোডাক্টটা নেন, এফসিআর কমবে, উৎপাদন খরচও কমবে!
ওয়ার্ল্ড পোলট্রি সায়েন্স এসোসিয়েশন বাংলাদেশ শাখা’র সাবেক সভাপতি এবং নারিশ পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি লিমিটেড –এর পরিচালক শামসুল আরেফীন খালেদ’র উপস্থাপিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৮ সনের সেপ্টেম্বর মাসে মুরগির মোট মার্কেট শেয়ারের ৭৬ শতাংশ যেখানে ছিল ব্রয়লারে দখলে ২০১৯ সনের একই মাসে সেটি নেমে দাড়িয়েছে ৫৭ শতাংশে। ২০১৮ সনের জুলাই মাসে মুরগির ৮০ শতাংশ বাজার ছিল ব্রয়লারের দখলে ২০১৯ সনের একই মাসে সেটি কমে দাড়িয়েছিল ৫৭ শতাংশে। বাজার ধ্বসের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে তিনি ব্রয়লার মাংসের স্বাদ কমে যাওয়াকে অন্যতম হিসেবে দায়ী করেছেন। আর স্বাদ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি ফিডের এফসিআর কমানো এবং কম সময়ে পালন করাকে দায়ী করেছেন। গবেষণাপত্রে তিনি ব্রয়লার মুরগির এফসিআর ১.৫৫ এবং কমপক্ষে ৩৫দিন পালন করার ব্যাপারে মতামত দেন। তবে, ৪২দিন পর্যন্ত পালনকে তিনি সবচেয়ে যথাযথ মনে করেন।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে এফসিআর ১.৫+ রাখাকে স্ট্যান্ডার্ড মনে করে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে ফিডের গড় এফসিআর ১.৪৫, ওজন ১.৪৪ কেজি, পালনকাল ২৮দিন; এশিয়ার দেশগুলোতে গড় এফসিআর ১.৫৯, ওজন ১.৩৭, পালনকাল ৩০দিন; ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকান দেশগুলোর গড় এফসিআর ১.৫৮, ওজন ১.৩৭, পালনকাল ৩০দিন; উত্তর আমেরিকায় গড় এফসিআর ১.৬৫, ওজন ১.৪২কেজি, পালনকাল ৩২দিন এবং বাংলাদেশে গড় এফসিআর ১.৪৮, ওজন ১.৫ কেজি এবং পালনকাল ২৮দিন।
যাইহোক, উপরের উক্তিটি (অমুক কোম্পানির ফিডের অবস্থা এখন খুব খারাপ) যে প্রথম শুনেছি তা নয়। বেশ কয়েক বছর ধরে খামারিদের মাঝে একটি ধারনা চলে এসেছে যে, যার এফসিআর যত কম তার ফিড তত ভালো। এখানে ভালো বলতে তারা, কম খাদ্যে কাঙ্ক্ষিত খরচকেই বোঝেন বা বুঝানো হয়েছে। অবশ্য খামারিদের একা দোষ দিয়েই লাভ কি? কথায় আছে- নিজের লাভ পাগলেও বুঝে। কিন্তু এটাও বুঝা উচিত, খরচ অতিরিক্ত কমাতে গেলে পণ্যের কোয়ালিটি হ্রাস পায়। আমাদের ব্রয়লারের ক্ষেত্রেও সেটিই হলো, মাংসের স্বাদ আস্তে আস্তে কমতে শুরু করলো এবং সেই সাথে চাহিদাও কমেছে। ব্রয়লার খামার করে বিগত প্রায় এক বছরের অধিক সময় ধরে বহু খামারি সর্বশ্বান্ত হয়েছেন, উৎপাদিত ব্রয়লারে দাম না পাওয়ায়। একদিকে খামারিরা ঝরে পড়ছেন অন্যদিকে হ্যাচারিগুলোও পড়েছে মহা মুশকিলে। একদিন বয়সী ব্রয়লার বাচ্চার দাম উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরেই।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলট্রি সায়েন্স বিভাগের অধ্যাক ড. সুবাস চন্দ্র দাস বলেন, ২০১০ সনের পর থেকে সময় যত বেড়েছে ফিডের এফসিআর তত কমেছে। ফলে মাংসের স্বাদও কমেছে, সেই তালে কমছে ভোক্তা। শিল্প সংশ্লিষ্টদের বুঝতে হবে, মানুষের আর্থিক সক্ষমতার পাশাপাশি রুচিরও পরিবর্তন এসেছে। তারা মাংসের স্বাদ এবং পুষ্টি দুটোই চায়। তাই ভোক্তার চাহিদার কথা মাথায় রেখে মাংস উৎপাদন করতে হবে। তিনি ফিডের এফসিআর কমপক্ষে ১.৫ এবং ব্রয়লার মুরগিকে ৪২ দিন পালনের পরামর্শ দেন।