শুক্রবার , নভেম্বর ২২ ২০২৪

সোনালীর দাপটে চ্যালেঞ্জের মুখে ব্রয়লার

প্রতীকী ছবি

মো. খোরশেদ আলম (জুয়েল) : প্রায় দেড় দশকেরও অধিক সময় ধরে দেশের পোলট্রি সেক্টরে দাপটের সাথে নেতৃত্বে দেয়া ব্রয়লারের দাপট হঠাৎ করেই যেন কমতে শুরু করেছে। নেতৃত্বের সিংহাসন ধরে রাখাটা ব্রয়লারের জন্য এখন কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। কারণ, দেশের পোলট্রি সেক্টর টিকেই আছে মূলত ব্রয়লার এবং লেয়ার মুরগিতে। গেল বছর সেক্টরটি লেয়ারের ধকল সামলে উঠতে পারলেও ব্রয়লারের দুর্দিন যেন কিছুতেই কাটছেনা। নিঃস্ব হচ্ছে বহু খামারি, সেই সাথে বন্ধ খামার। এর সাথ জড়িত সহযোগি শিল্পেরও চলছে দুর্দিন। টানা প্রায় এক বছর ব্রয়লার বাচ্চার দাম না পাওয়াতে হ্যাচারিগুলো টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে ফিড কোম্পানিগুলোও পড়েছে মহা মুসিব্বতে। সোজা কথা বলতে গেলে, দুর্দিন যাচ্ছে দেশের ব্রয়লার বাজারের এবং সেই সাথে সামগ্রিক পোলট্রি সেক্টরের।

ওয়ার্ল্ড পোলট্রি সায়েন্স এসোসিয়েশন বাংলাদেশ শাখা’র সাবেক সভাপতি এবং নারিশ পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি লিমিটেড –এর পরিচালক শামসুল আরেফীন খালেদ’র উপস্থাপিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৮ সনের জুলাই মাসে মুরগির মোট মার্কেট শেয়ারের ৮০ শতাংশ এবং একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ৭৬ শতাংশ ছিল ব্রয়লারে দখলে সেখানে চলতি বছর অর্থাৎ ২০১৯ সনের জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে সেটি নেমে দাড়িয়েছে ৫৭ শতাংশে। বাকী ৩৩ শতাংশ বর্তমানে সোনালী ও দেশি মুরগির দখলে।

অন্যদিকে, ২০১৩-২০১৮ সন পর্যন্ত প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগির খুচরা গড় দামর্ ১৫০ টাকার আশেপাশে ঘুরঘুর করলেও ২০১৯ সনে সেটি নেমে এসেছে ১১০-১২০ টাকায়। গত অক্টোবর মাসে পাইকারী বাজারে সোনালী মুরগির দাম ছিল ২০০-২২০ টাকা কেজি সেখানে ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ৮৫-১০০ টাকা।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) সর্বশেষ ২০১৯ সনে করা এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৫১০ মিলিয়ন বা ৫১ কোটি একদিন বয়সী সোনালী বাচ্চা উৎপাদিত হচ্ছে। প্রায় ৩৩৩টি হ্যাচারির মাধ্যমে এসব বাচ্চা উৎপাদন এবং প্রায় ৩ হাজার ডিলারের মাধ্যমে বাজারজাত করা হচ্ছে। বর্তমানে সপ্তাহে একদিন বয়সী সোনালী বাচ্চার চাহিদা প্রায় ৯.৮ মিলিয়ন বা ৯৮ লাখ। অন্যদিকে বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) এর ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্যমতে দেশে প্রতি সপ্তাহে ১৪ মিলিয়ন বা ১ কোটি ৪০ লাখ একদিন বয়সী ব্রয়লার বাচ্চা উৎপাদন হচ্ছে।

হঠাৎ করে ব্রয়লার মুরগির চাহিদা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে মূলত আগের স্বাদ হারানোকেই দায়ী করেছেন সেক্টর সংশ্লিষ্টগণ। এ ব্যাপারে গত ৩১ আগস্ট ওয়ার্ল্ড পোলট্রি সায়েন্স এসোসিয়েশন-বাংলাদেশ শাখা’র সাধারণ সভায় সংগঠনটির সভাপতি আবু লুৎফে ফজলে রহিম খাঁন বলেন, ব্রিড অনুযায়ী সঠিক ফিড না দেয়ায় এবং পর্যাপ্ত সময় পর্যন্ত ফার্মিং না করার কারণে ইন্ডাস্ট্রিয়াল হোয়াইট ব্রয়লারের স্বাদ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে ব্রয়লার মুরগি তার বাজার হারাচ্ছে। বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে হলে ফিরিয়ে আনতে হবে ব্রয়লারের আগের সেই স্বাদ।

আবার ওপাসা-বিবি’র সাবেক সভাপতি এবং নারিশ পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি লিমিটেড –এর পরিচালক শামসুল আরেফীন খালেদ’র কিছুদিন আগে এক সেমিনারে উপস্থাপিত ডিজিটাল প্রেজেন্টেশনে ব্রয়লার মুরগির স্বাদ কমে যাওয়ার জন্য মূলত ফিডের এফসিআর ও পালনকাল কমকে দায়ী করেছেন।

সোনালী মুরগির ব্যাপারে ভোক্তাদের ধারনা হলো –এটি খেতে সুস্বাদু এবং বহুমুখী ব্যবহার করা যায়, কেজিপ্রতি দাম একটু বেশি হলেও সাইজে ছোট থাকায় সামর্থে্যর মধ্যে ক্রয় করা যায়, অনেক বেশি প্রাকৃতিক এবং নিরাপদ এবং দেখতে দেশি মুরগির মতো ইত্যাদি।

ফলে যারা সোনালী মুরগি পালন করছেন তারা মুরগিটি সম্পর্কে ভোক্তাদের ইতিবাচক মানসিকতা, ভালো দাম পাওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। ভোক্তা চাহিদা থাকার কারণে এটি পালন ঝুঁকিমুক্ত মনে করছেন । যেহেতু ক্রেতাদের চাহিদা বেশি তাই সোনালী মুরগি পালনে লাভও বেশি। তাছাড়া এ জাতের মুরগির খাবার লোকাল ফিডমিলারদের উৎপাদিত ফিড অপেক্ষাকৃত কম দামে পাওয়া যায় এবং এটিতে ওত বেশি বায়োসিকিউরিটি মেনে চলতে হয়না বলে নির্ঝঞ্ঝাট মনে করছেন অনেকেই।

পক্ষান্তরে ব্রয়লারের মাংসে পানির পরিমাণ বেশি থাকায় এবং অল্প সময় (২৮-৩০দিন) পালন করার জন্য মাংসের স্বাদ ও টেক্সার ভালো না আসায় ভোক্তারা স্বাদ পাচ্ছেননা। এছাড়াও এক শ্রেণীর ভোক্তা মনে করছেন এটি অস্বাস্থ্যকর এবং অনিরাপদ। কেউ কেউ আবার এটিকে কৃত্রিম/এলিয়েন বা জিএমও জাতের মুরগি মনে করেন। যদিও এগুলোর কোনটিই সঠিক নয়।

পোলট্রি শিল্প সংশ্লিষ্টগণ বলছেন, বেশিরভাগ সোনালী ফিড উৎপাদনকারী ফিডমিলগুলো ফিআব সদস্য না হওয়ায় এবং সরকারি নিয়ম কানুন না মানায় ফিডের উৎপাদন খরচ কম হওয়াতে অপেক্ষাকৃত কম দামে ফিড বিক্রি করতে পারেন। সোনালী মুরগির প্যারেন্ট স্টক খামার ও হ্যাচারি পোলট্রি নীতিমালা মানতে বাধ্য হয়না। মোদ্দা কথা,  সার্বিক দিক দিয়েই সহজ এবং ঝুঁকিমুক্ত লাভের সম্ভাবনার কারণে খামারিরা সোনালীতে ঝুঁকছেন। অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থাপনা, ক্রেতার চাহিদা কমে যাওয়া এবং লোকসান দেয়ার ভয়ে ব্রয়লার মুরগি পালন থেকে অনেক খামারি সরে যাচ্ছেন।

তবে শিল্প সংশ্লিষ্টগণ এটিও বলছেন যে, ব্রয়লার ফিডের এফসিআর যদি ১.৫ এর উপরে এবং পালনের সময়কাল ৪২-৪৯দিন করা যায় এবং সঠিক বায়োসিকিউরিটি মেনে ওষুধের ব্যবহার কমানো যায় তবে ব্রয়লার আবারো ফিরে পাবে তার সেই অবস্থান। আশার কথা হলো, দেশের পোলট্রি জায়ান্ট কোম্পানিগুলো এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে একমত হয়েছেন এবং কাজও ‍শুরু করে দিয়েছেন। তাঁরা এখন ফিডে এফসিআর বাড়ানো এবং এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধের মাধ্যমে সুস্বাদু এবং নিরাপদ পোলট্রি উৎপাদনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।

This post has already been read 6890 times!

Check Also

ডিমের মূল্যের ঊর্দ্ধগতিতে মধ্যস্বত্বভোগীরা বড় সমস্যা- মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা

পাবনা সংবাদদাতা: ডিমের মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মধ্যস্বত্বভোগীরা বড় সমস্যা উল্লেখ করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা …