তানজিলা তাবাসসুম নকশী : আমি আজ এমন একজন ডাক্তারের এর কথা বলবো যিনি সারাজীবন অধ্যাবসায় ও সাধনা সহকারে অসুস্ত রোগীর পাশে থেকে হাজার হাজার রোগীকে সুস্থ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনেছেন। ব্রেইনের অপারেশনের মতো অত্যন্ত ব্যায়বহুল অপারেশন ও সম্পুর্ণ বিনা খরচে করেছেন শতাধিক রোগীর৷ তাঁর নাম ডা. মো. ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী৷ এই মহান ব্যক্তিটিকে নতুন বিশ্বের ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল বললে নেহায়েত ভুল হবেনা, কারণ উত্তর বংগ যেখানে একটা দারিদ্র্য পিড়ীত এলাকা সেখানে সাধারণ চিকিৎসাই ছিল দুরূহ ব্যাপার৷
আজ থেকে ১৩/১৪ বছর আগে যেখানে ঢাকার মধ্যেই নিউরোসার্জারি সীমাবদ্ধ ছিল সেখানে উনি নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে একটা প্রত্যন্ত জেলা শহরে গিয়ে সেখানে নিউরোসার্জারি, নিউরো আই.সি.ইউ উত্তরবংগে শুরু এস্টাবলিশড করে দিয়ে এসেছেন৷ উনি নিজে অসুস্থ রোগীর পাশে সারারাত থেকে চিকিৎসা দিয়ে এসেছেন৷ এমনকি নিজের পকেটের পয়সা ও খরচ করতেন! মোটামুটি একটা ধারণা প্রচলিত হয়ে গেছে সে এলাকায় যে ওনার কাছে গেলে যে যতটুকু পারে সর্বনিম্ন সেই টাকা দিয়েই উনি এতো এতো ব্যায়বহুল চিকিৎসা/ অপারেশন করে দেন৷ শুধু তাই নয়, উনি Awake surgery করেন ২০০৭ থেকে৷ অর্থাৎ রোগীকে সম্পুর্ন অচেতন না করেই৷ অথচ মাত্র ক’মাস আগে ঢাকার এপোলোতে অন্যান্য ডাক্তারগন এই পদ্ধতি চালু হবার পর প্রেস কনফারেন্স পর্যন্ত করেছেন!! সেখানে তাহলে ভাবুন এই প্রচারবিমুখ মানুষটিকে নিয়ে কতখানি মাতামাতি করা আমাদের মিডিয়ার দায়িত্ব ছিল! প্রতিনিয়ত উনি বিনামূল্যে অসংখ্য রোগীর অপারেশন করে চলেছেন বিনামূল্যে৷ অথচ নিউরোসার্জারি অনেক ব্যায়বহুল ও কষ্টসাধ্য!! একেকটি অপারেশন করতে ৫-৭ ঘন্টা লাগে৷ এমন আরো অনেক উদাহরণ আছে তাঁকে নিয়ে৷
এযাবৎকালীন তথ্য ও উপাত্তমতে উনি বিশ্বে এক মাত্র ব্যাক্তি যিনি একাধারে একজন নিউরো সার্জন , নিউরো এনেস্থেটিক্স এবং নিউরো আই.সি.ইউ. কন্সাল্টেন্ট। দেশের বেশিরভাগ শহরেই যেখানে একজন আই.সি.ইউ. কন্সাল্টেন্ট পাওয়া দুস্কর সেখানে তিনি নীরবে সকল বাঁধা বিঘ্ন অতিক্রম করে জটিল থেকে জটিলতর রোগীর অপারেশান করে, নিজেই আই.সি.ইউ. সাপোর্ট দিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে৷ তাঁর পরিচালিত আই.সি.ইউ. তে বিশ্বের যেকোনো নিউরো আই.সি.ইউ. থেকে মৃ্ত্যুহার অনেক কম। যার প্রত্যক্ষদর্শী রাজধানী ঢাকা ছাড়াও বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও উত্তর বংগের সহস্র রোগী৷ বর্তমানে “ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হসপিটাল” কর্তৃপক্ষের অনুরোধে সেখানে নিউরোসার্জারি, আই.সি.ইউ, এইচ.ডি.ইউ, স্ট্রোক সেন্টার এবং স্পাইন সেন্টার প্রতিষ্ঠায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন এই প্রচারবিমুখ মানুষটি৷
উল্লেখ্য, ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হসপিটাল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৫ সালে পুরান ঢাকার জনসন রোডে৷ তাঁর চিকিৎসার আরো কিছু অনন্য সাক্ষর রয়েছে যেমন, -P.L.I.D. and spinal canal stenosis এ লক্ষ লক্ষ রোগী দেশে ও বিদেশে বহু দিন যাবদ ভুগছে। এ রোগীগুলো আমেরিকা, সিংগাপুর ও ইন্ডিয়া সহ পৃথিবীর কোন দেশে সুস্থ হয়না , যার জন্য অপারেশান এর পর এইসব রোগীকে বলা Failed back syndrome কিন্তু ওনার আবিষ্কৃত পদ্ধতিতে P.L.I.D. এবং spinal canal staenosis রোগী ১০০% ভালো হচ্ছে৷ অর্থাৎ failed back syndrome সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমায় তাঁর হাতে বিলুপ্ত হচ্ছে৷ এপর্যন্ত তিন হাজার অপারেশন করা হয়েছে যাদের মধ্যে ৯৮ শতাংশের সবাই ভালো। এটা তার নিজস্ব আবিস্কার! যা বিশ্বে বিরল।
-cerebral palsy নামক আরেকটি রোগ আছে যা birth hypoxia এর জন্য হয়ে থাকে৷ মাথার খুলি ছোট, লালা পরা,খিচুনি হওয়া, দাঁড়াতে ও কথা বলতে না পারা এবং অস্বাভাবিক আচরণ এই রোগের অন্যতম লক্ষন৷ শুধুমাত্র ভুক্তভোগী ও তার পরিবারগনই এই রোগের শোক অনুধাবন করতে পারবেন৷ মূলত পৃথিবী জুড়ে এর কোন চিকিৎসা নাই। কিন্তু উনি এ পর্যন্ত সাতটি বাচ্চার মাথার খুলি অস্ত্রোপচার করেছেন যারা সবাই এখন পুরোপুরি সুস্থ এবং স্বাভাবিক আছে৷ এই কোমলমতি রোগীদের নতুন জীবন পাওয়াই বিশাল বেপার৷ অন্য কোনো দেশের মিডিয়া হলে ওনাকে নিয়ে এতোটাই হইচই ফেলে দিতো যে মেডিক্যাল ট্যুরিজম পর্যন্ত গড়াতো বিষয়টা!
– Dimentia এমন এক রোগ যার ফলে রোগী কিছুই মনে রাখতে পারেন৷ সাধারণত এসব রোগীর কোন চিকিৎসা নাই, কিন্তু এই রোগী গুলোও ৭০% এর অধিক ভালো হয়েছে ওনারই তত্ত্বাবধানে৷ এছাড়া ব্রেইন, মেরুদণ্ড ও নার্ভজনিত সকল রোগের নিয়মিত সমাধানতো তিনি দিয়ে যাচ্ছেন হরহামেশাই৷ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক যদি থাকে আমাদেরই দেশে তবে তাকে আমরা কেনো তাকে মৃল্যায়নস্বরূপ দেশের মাটিতেই চিকিৎসা নিতে পারছিনা ? এই প্রতিভাও একদিন দেশ ছেড়ে চলে যাবে হয়তো৷ এই রকম আরো কত জ্ঞানী ব্যক্তি দেশ ছেড়ে চলে গেছেন তার কোনো হিসাব আমাদের আছে কি? অথচ ইংল্যান্ড আমেরিকার কথা বাদই দিলাম, ডাক্তার মোঃ ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী যদি এদেশে না জন্মে আমার পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেই জন্মাতেন তবে পুরো ভারতীয় মিডিয়া নিজ দায়িত্বে তুলে ধরতেন তাঁকে বিশ্বদরবারে৷
আসুন এমন প্রতিভাবান নিবেদিত প্রজ্ঞার কথা ছড়িয়ে দেই দেশ থেকে দেশান্তরে৷
লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।