ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা) : খুলনার কয়রায় সুন্দরবনে অবৈধভাবে পারশে মাছের পোনা আহরণের অপেক্ষায় রয়েছেন কয়েক হাজার জেলে। অভিযোগ উঠেছে, এ জন্য বন বিভাগের সঙ্গে গোপন চুক্তি করেছেন তারা। প্রতিটি ট্রলার ঢোকার অনুমতি পেতে আগাম ১০ হাজার টাকা দিয়ে টোকেন সংগ্রহ করেছেন জেলেরা। পুরো মৌসুম এই টোকেনের মাধ্যমে লেনদেন হবে টাকা।
জেলেরা জানিয়েছেন, প্রতিবার (প্রতিট্রিপে) পারশে মাছের পোনা নিয়ে লোকালয়ে আসলে তাদেরকে আরও ১০ হাজার টাকা করে দিতে হবে। অবৈধ পোনা আহরণ সিন্ডিকেটের নেতা আজিজুল ইতোমধ্যে একাধিক দ্রুতগামী ট্রলার নিয়ে বনের নিষিদ্ধ অঞ্চলে ঢুকে পোনা আহরণ শুরু করেছেন। তার ইঙ্গিত পেলেই নেমে পড়বেন হাজারো অবৈধ পোনা শিকারি।
জানা গেছে, পারশে পোনা সংগ্রহে সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় জনপদ কয়রা, শ্যামনগর, আশাশুনি, দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলার কয়েক হাজার জেলে গত চার/পাঁচ বছর ধরে নতুন এ পেশায় জড়িয়েছেন। অল্প পরিশ্রম এবং কম পুঁজিতে অধিক টাকা উপার্জন হওয়ায় তারা এ অবৈধ কাজকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। কিছু চিংড়ি ঘের ব্যবসায়ী তাদের টাকা দাদন দিয়ে এ কাজে উৎসাহ দিচ্ছেন। এ মুহূর্তে ট্রলারে ক্ষুদ্র ফাঁসের জাল নিয়ে সুন্দরবনের নদী-খালে প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছেন কয়েক হাজার অবৈধ পোনা আহরণকারী। ২০-২৫ জনের প্রতিটি বহরে (দলে) রয়েছে দুটি দ্রতগামী ট্রলার তিন-চার সেট ক্ষুদ্র ফাঁসের জাল (নেট জাল) এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য সরঞ্জামাদি।
জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভাগীয় বন কর্মকর্তার দফতর থেকে সাদামাছ কাঁকড়া ধরার জন্য সুন্দরবনে ট্রলার প্রবেশের অনুমতি নেন তারা। ওই অনুমতি পত্র নিয়ে স্থানীয় ফরেস্ট ষ্টেশন থেকে পাশ-পারমিট নিয়ে বনে প্রবেশ করেন। টানা চার মাস এভাবেই চলবে গহীন সুন্দরবনে পারশে মাছের পোনা আহরণ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এই চক্রের মূল হোতা কয়রার বনদস্যুদের এজেন্ট খ্যাত কয়েকটি সিন্ডিকেট। শুধু মাছ ব্যবসার লাভে সন্তুষ্ট নন তারা। তাই সুন্দবনের হরিণের মাংস বিক্রির জন্য তারা নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে নিয়েছেন। বেশ কয়েকটি হরিণ শিকারীর দলও চালাচ্ছে এই সিন্ডিকেট। আর এই সিন্ডিকেটের সাথে রয়েছে বন বিভাগের কয়েকজন চিহিৃত দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা । তারা মোটা অংকের অর্থ লেনদেন এর মাধ্যমে এই কাজ করছেন ।
গত ১৫ অক্টোবর সুন্দরবনে র্যাবের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে ৪ বনদস্যু নিহত, আর কয়রার বনদস্যু চক্রের দুই পৃষ্ঠপোষককে আটক হয়। এ ঘটনায় বেশ কিছুদিন আত্মগোপনে ছিলেন সিন্ডিকেটের হোতারা। সম্প্রতি তারা পারশে মাছের পোনা আহরণে আবারও সক্রিয় হয়েছে। প্রতিবছর এ খাত থেকে কোটি কোটি টাকা আয় করে তারা। বড় ভাই খ্যাত কয়রার বাসিন্দা ও সুন্দরবন সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির (সিএমসি) পদ ধারী এক নেতার মাধ্যমেই মূলত আরও অনেকের হাতে যায় ওই টাকা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক জেলেরা জানান, সুন্দরবনের অভায়রণ্য এলাকায় মাছ ধরতে গেলে প্রতিবার নৌকা প্রতি পাঁচ হাজার টাকা করে দিতে হয় ওই সিএমসি নেতার কাছে। তিনি বন বিভাগ ও বনদস্যুদের সঙ্গে সমঝোতা করে টাকা আদান-প্রদান করেন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রধান প্রফেসর ড. মো. নাজমুল আহসান জানান, সুন্দরবনের নদ-নদী ও শাখা-উপশাখায় সাগর থেকে উঠে আসা মা মাছ নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ডিম ছাড়ে। ঠিক এ সময় নিষিদ্ধ ক্ষুদ্র ফাঁস জালের সাহায্যে পোনা আহরণের ফলে উপকূলের নদ-নদী মাছশূন্য হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ক্ষুদ্র ফাঁসের জাল দিয়ে এক প্রজাতির পোনা আহরণের সময় অন্য মাছের পোনাও নিধন হচ্ছে। ফলে দেশের মৎস্য সম্পদ ও জলজপ্রাণি মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।
সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বশিরুল আল মামুন বলেন, সাদামাছ ধরার বৈধ পাস পারমিট নিয়ে নিষিদ্ধ কারেন্টজাল দিয়ে পোনা নিধন করা হচ্ছে কিনা তা আমার জানা নেই। যদি এ ধরনের কোনো অপতৎপরতা দেখা গেলে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে। এছাড়া অবৈধ কাজে বনবিভাগের কারো সম্পৃক্ততা থাকলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যাবস্থা নেয়া হবে।পোনা আহরণকারীদের সঙ্গে অবৈধ লেনদেনর বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, এ ধরনের কর্মকান্ডে কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।