কৃষিবিদ মো. মহির উদ্দীন : “রোগের চিকিৎকার চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম” এ কথাটি হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর ক্ষেত্রে বেশি সামঞ্জম্যপূর্ণ। মানুষ হাঁস-মুরগি গবাদিপশু পালন করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য। হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু রোগাক্রান্ত হলে নানাভাবে আর্থিক ক্ষতি হয়। অসুস্থ হলে কিছু মারা যায় চিকিৎসার পরে যেগুলো বেঁচে থাকে সেগুলোর উৎপাদন কমে যায়, যা পরে সহসায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারে না। তাই এসব পাখি ও প্রাণিকে ভ্যাক্সিন প্রদানের মাধ্যমে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলা উত্তম। আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত খামার ব্যবস্থাপনায় ভ্যাক্সিনেশন একটি অপরিহার্য অংশ। অনেকের ধারনা কোন রোগের ভ্যাক্সিন করার পর আর ঐ রোগ হয় না। কিন্তু এ ধারনা সম্পূর্ণ ভূল। বিভিন্ন কারণে কোন রোগর ভ্যাক্সিন প্রদানের পরেও সে রোগ হতে পারে।
ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা কমে যেসব কারণে:
১. রোগাক্রান্ত হাঁস-মুরগি বা পশুকে ভ্যাক্সিন প্রদান করলে। অর্থাৎ যে মুরগিকে ভ্যাক্সিন দেয়া হলো সে মুরগি যদি আগে থেকেই ঐ রোগের জীবাণু বহন করে থাকে বা রোগের লক্ষণ দৃশ্যমান থাকে তাহলে ভ্যাক্সিন কার্যকর হবে না।
২. সাধারণতঃ কার্যকারীতা নষ্ট হয়ে গেছে এমন ভ্যাক্সিন প্রয়োগ করলে। বিশেষভাবে সংরক্ষণের অভাবে, পরিবেশের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ইত্যাদির কারণে ভ্যাক্সিনের কার্যকারীতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
৩. সঠিক মাত্রায় ভ্যাক্সিন প্রয়োগ না করলে অর্থাৎ যেটুকুর প্রয়োজন তার কম বা বেশি করলে।
৪. মেয়াদোত্তীর্ণ ভ্যাক্সিন ব্যবহার করলে।
৫. ভ্যাক্সিন ডায়ল্যুয়েন্টের সাথে মিশানের পর দ্রুত শেষ না করলে (১-২ ঘণ্টার মধ্যে শেষ করতে হবে)।
৬. পরিবেশগত ধকলের (অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডা) সময় ভ্যাক্সিন করলে।
৭. ভ্যাক্সিন দেয়ার যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত না করে ভ্যাক্সিন প্রয়োগ করলে।
৮. ভ্যাক্সিন প্রয়োগ জ্ঞান নাই এমন কাউকে ভ্যাক্সিন প্রয়োগ করতে দিলে।
৯. মুরগির খাবারে বা শরীরে পুষ্টি ঘাটতি থাকলে ভ্যাক্সিন প্রয়োগ ফলপ্রসু হয় না। কারণ, পুষ্টি ঘাটতি থাকলে শরীরে এন্টিবডি তৈরি হয় না।
১০. অন্য যে কোন রোগে আক্রান্ত মুরগিকে ভ্যাক্সিন প্রয়োগ করলে ভ্যাক্সিন ফলপ্রসু হয় না।
১১. মায়ের নিকট থেকে পাওয়া এন্টিবডির পরিমান নির্ধারণ না করে ভ্যাক্সিন না দিলে।
১২. যে রোগের যে স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে ভ্যাক্সিন প্রয়োগ করা হলো প্রয়োগকৃত ভ্যাক্সিনে সেই স্ট্রেইনের জীবাণুর এন্টিজেন না থাকলে।
১৩. সঠিক পথে ভ্যাক্সিন না করলে। পথ বলতে ভ্যাক্সিন প্রয়োগের জায়গা যেমন- চোখ, চামড়ার নিচে, পালকের নিচের নরম অংশ, মাংস ইত্যাদি স্থানকে বুঝায়।
১৪. মাস (Mass) ভ্যাক্সিনেশন বা গ্রুপ ভ্যাক্সিনেরর ক্ষেত্রে একসাথে অনেক মুরগিকে পানির সাথে ভ্যাক্সিন খাওয়ানো হয় বা স্প্রে করা করা হয়। এক্ষত্রে প্রয়োজনীয় পরিমান ভ্যাক্সিন শরীরে প্রবেশ না করলে।
১৫. ভ্যাক্সিনের সাথে সরবরাহকৃত ডায়ল্যুয়েন্ট ব্যবহার না করলে।
১৬. গুলানো ভ্যাক্সিন প্রয়োগের সময় কুলপ্যাড ব্যবহার না করলে ভ্যাক্সিনের কার্যকারীতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
১৭. প্রস্তুতকারী কোম্পানীর নির্দেশনা মোতাবেক ভ্যাক্সিন না করলে।
১৮. দুই টা ভ্যাক্সিন প্রয়োগের মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান কমপক্ষে ৭২ ঘন্টার কম হওয়া।
ভ্যাক্সিন প্রয়োগে ভালো ফল পেতে করণীয়
১. ভ্যাক্সিন প্রয়োগে ভাল ফল পেতে অবশ্যই সুস্থ,সবল ও রোগমুক্ত মুরগিকে ভ্যাক্সিন করতে হবে।
২. খ্যাতনামা কোম্পানির ভ্যাক্সিন সংগ্রহ করে কোম্পানির নির্দেশনা মোতাবেক ভ্যাক্সিন করতে হবে।
৩. দিনের অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা সময়ে ভ্যাক্সিন দিতে হবে।
৪. ভ্যাক্সিন কোন অবস্থাতেই সূর্যালোকের স্পর্শে আনা যাবে না।
৫. ভ্যাক্সিন পরিবহন ও প্রয়োগের সময় তাপমাত্রা (কুল চেইন) মেইনটেন করতে হবে।
৬. যে তরল পদার্থে (ডায়ল্যুয়েন্টে) ভ্যাক্সিন গুলানো হয় তা সাধারণ তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা গেলেও এবং ভ্যাক্সিন গুলানোর সময় ভ্যাক্সিনের সংরক্ষণের (২-৯০ সে.) তাপমাত্রায় আনতে হবে।
৭. খাবার পানির সাথে ভ্যাক্সিন প্রয়োগ করা হলে তা ক্লোরিনমুক্ত পানিতে মেশাতে হবে।
৮. মুরগির খাবারের পুষ্টিমান নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, শুধু ভ্যাক্সিনই মুরগির শরীরে রোগ প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তুলে না, মুরগি নিজেও তার শরীরে রোগ প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তুলে।
৯. প্রথম ডোজ ভ্যাক্সিন প্রদানের পর একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ঐ ভ্যাক্সিনের কার্যকর প্রতিরোধ শক্তি বজায় থাকে তাই ঐ সময় পরে পুনরায় ঐ ভ্যাক্সিন করতে হবে।
১০. প্রতিটি মুরগির বাচ্চা তার মায়ের নিকট থেকে কিছু রোগ প্রতিরোধ শক্তি পেয়ে থাকে,যাকে বলা হয় মেটারনাল ডেরাইভড এন্টিবডি বা এমডিএ। মুরগির বাচ্চার শরীরের এই এমডিএ’র মাত্রা নির্ধারণ করে ভ্যাক্সিন প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
আমাদের দেশে ভ্যাক্সিন ব্যবহার ও পরিবহনের সময় ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। তাই উৎপাদন কেন্দ্র, ক্রয়কেন্দ্র ও সরবরাহ কেন্দ্র থেকে ভ্যাক্সিন সরবরাহ নেয়ার সময় অবশ্যই কুলভ্যানে অথবা পর্যাপ্ত বরফসহ ফ্লাস্কে ভ্যাক্সিন পরিবহন করতে হবে। তাহলে ভ্যাক্সিনের মান ভালো থাকবে এবং ভালো ফল পাওয়া যাবে।
লেখক: উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, চাটমোহর, পাবনা।