রবিবার , ডিসেম্বর ২২ ২০২৪

শীতের শুরুতেই চলছে নির্বিচারে অতিথি পাখি নিধন মহোৎসব

শীতের অতিথি পাখি (প্রতীকি ছবি)।

ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা) : উপকূলীয় অঞ্চল বঙ্গোপসাগর, সুন্দরবন ও কয়েকটি বড় নদ-নদীর অববাহিকায় হওয়ায় প্রতি বছর এখানে মেলে অতিথি পাখির মিলনমেলা। খুলনাঞ্চলের বিভিন্ন জলাশয়ে ও মৎস্য ঘেরে শীতের শুরুতেই শুরু হয়েছে অতিথি পাখি শিকারের মহোৎসব। প্রতি বছর শীত এলেই হাজার হাজার মাইল থেকে উড়ে আসা এই মেহমানদের নির্দয়ভাবে সুযোগ সন্ধানীরা শিকার করে কেউ আর্থিকভাবে লাভবান হয় আবার কেউ রসনার তৃপ্তি মিটায়।

খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার ডুমুরিয়া, বটিয়াঘাটা, দাকোপ, তালা, পাইকগাছা, ফকিরহাট, মোল্লাহাট, রূপসা, তেরখাদা, মোড়লগঞ্জ, কচুয়া কয়রা এবং কালিগঞ্জ, কুশলিয়া, শ্যামনগর, আশাশুনি, তালা প্রভৃতি উপজেলার শিকারিরা পাখি নিধনে তৎপর হয়ে উঠেছে। নৌকা, জাল, বড়শী বিভিন্ন ফাঁদ, বন্দুক, অচেতন ঔষধসহ বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে পাখি শিকারে। প্রকৃতির ভারসাম্য ও জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় অতিথি পাখির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। পাখিপ্রেমিকরা অতিথি পাখি আগমনের অধির অপেক্ষায় থাকেন। অথচ এক শ্রেণির মানুষ অতিথি পাখিদের হত্যা করছে। যা সভ্য সমাজের জন্য কাম্য নয়।

আমাদের দেশে রাজহংস, চখাচখি, মানিকজোড়, বিভিন্ন জাতের হাঁসপাখি, কাচিচোরা, নানান প্রজাতির বাটান, ধলবগনি, শেতকাক, পেলিকেন, পানকৌড়ি, কাদা খোচা, বালিহাঁস বকসহ প্রায় দেড় শত প্রজাতির হাজার হাজার পাখির আগমন ঘটে। বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে এদের শিকার ও হত্যা করা হচ্ছে। ফলে পরিবেশ-বান্ধব এসব পাখির সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। প্রশাসনের কার্যকরী কোনও উদ্যোগ না থাকায় পাখি শিকারের প্রবণতা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে অতিখি পাখি নিধন বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টি ও বন্যপ্রাণী দপ্তরসহ পুলিশ প্রশাসনের হস্থক্ষেপ কামনা করছেন সচেতন মহল।

সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা যায়, প্রতিবছর শীত আসলেই দেখা মেলে অতিথি পাখিদের। আর শীত শেষ হলই আবার ফিরে যায় গন্তব্যে। প্রতিবছর এসব পাখিরা আসে সুদূর হিমালয় ও সাইবেরিয়াসহ শীত প্রধান অঞ্চল থেকে। ফকিরহাট, মোল্লাহাট, রূপসা, তেরখাদা, মোড়লগঞ্জ, কচুয়া খুলনার কয়র, ডুমুরিয়া উপজেলার খর্ণিয়া, থুকড়া, মাগুরখালী, শিবনগর, কাঠালিয়া, ঘুরুনিয়া, লাঙ্গলমাড়া, বগারখার, কুলটি, জালেরডাঙ্গা, ভল্কামারী, খড়িয়া, পশ্বিম বিলপাবলা, গগনা খাল, বাইসরানী, রংপুর, বিল ডাকাতিয়া, মির্জাপুর, শোভনা, কদমতলা, কাকমারী, বলাবুনিয়া, জিয়ালতলা, শিবপুর, মাদারতলা, ব্রহ্মারবড়, বারুইকাটি, বৈঠাহারা, আধারমানিক, নিচুখালী, চেচুড়ি, বরুনা, দহকুলা, রুদাঘরা, শরাফপুর, সাহস, গোপালনগর, কাঞ্চননগর, তেলিখালী, খড়িবুনিয়া, মাগুরাঘোনা, কাঞ্চনপুর, তালতলা, মাগুরখালী নদী, বেজিআলির খাল, খলসীর চোয়ার খাল, বেতাগ্রাম, হাসানপুর, ঘোষড়া, বাদুড়িয়া, কাকুড়পাড়া, বিলতাওলিয়া, মধুগ্রাম, কালবিল, হামকুড়া খাল ।

এছাড়াও সাতক্ষীরার  কালিগঞ্জ, কুশলিয়া, শ্যামনগর, আশাশুনি, তালা উপজেলার শিকারিরা পাখি নিধনে তৎপর হয়ে উঠেছে।বিশেষ করে সদর উপজেলার ব্রহ্মরাজপুর ইউনিয়নের গোয়ালপোতা বিল, খড়িয়াডাঙা বিল, ধুলিহর এলাকার আছানডাঙা বিল, কোমরপুর বিল, এলাচর, বকচরাসহ বিভিন্ন এলাকায় দল বেঁধে আসছে সাদা বক, বালহাঁস, পানকৌড়ী, (গলা লম্বা) সারসসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। সরকারি নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে ঐসব এলাকার অসাধু ব্যক্তিরা বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে অতিথি পাখি শিকার করছে।

খুলনাঞ্চলের মৎস্য ঘেরগুলো মূলত পাখি বিচরণের বিশেষ ক্ষেত্র। এ অঞ্চলে রয়েছে হাজার হাজার মাছের ঘের। যেখানে নতুন পানি তুললে পাখির আনাগোনা বাড়ে। আর শীতের শুরুতেই বিদেশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি আসে। এছাড়া এ অঞ্চলের মরা নদীগুলো এবং বিভিন্ন নদীর জেগে ওঠা চরে প্রতি বছর এ রকম সময় পাখি আসে। আর চোরা শিকারদের হাতে শত শত হাজার পাখি ধরা পড়ে। পাখি শিকার বন্ধে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও কোনো ভূমিকা রাখছে না। প্রশাসন দেখেও দেখেনা। বরং সমাজের এই বিবেকরাই সুযোগ পেলে পাখি কিনে রসনার তৃপ্তি মেটায়।

বাংলাদেশ পরিবেশ ও মানবাধিকার বাস্তবায়ন সোসাইটির মহাসচিব মো. আজগর হোসেন জানান, জনসচেতনতা ছাড়া অতিথি পাখি নিধন রোধ করা সম্ভব নয়। এছাড়া আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও তা প্রয়োগ করছে না। তিনি এ ব্যাপারে সুশীল সমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

সুন্দরবন বিভাগের বন্যপ্রাণী দফতরের সূত্র জানায়, প্রতি বছরের নভেম্বর থেকে পরবর্তী বছরের মার্চ পর্যন্ত ধানসহ অন্যান্য ফসলও উত্তোলন শেষ এবং পানি কমে যাওয়ায় বিলগুলোতে অতিথি পাখির বিচরণ বেশি থাকে। এ সুযোগে চোরা শিকারিরা তৎপর হয়ে ওঠে। তারা পাখিদের বিচরণ ক্ষেত্র এবং স্থানগুলোতে ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করে। পরে তা প্রকাশ্য ও গোপনে মোটা অঙ্কের অর্থে বিক্রি করা হয়।

পরিবেশ সংগঠন দিপ্ত আলোর প্রধান নির্বাহী হাসানুর রহমান বলেন,অতিথি পাখিরা সুদূর হিমালয় ও সাইবেরিয়াসহ শীত প্রধান অঞ্চল থেকে আমাদের এলাকায় এসে আশ্রয় নিয়েছে। জীবন বাঁচাতে আসা এসব পাখিদেরকে শিকার করা দন্ডনীয় অপরাধ বলে আমি মনে করি। তাছাড়া পাখি নিধন হলে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়।দক্ষিণাঞ্চলের পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র সংরক্ষনে অবৈধ পাখি শিকারীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া হলে অতিথি পাখি শিকার বন্ধ করা সম্ভব হবে বলে তিনি জানান ।

সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দেবাশীষ চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন স্থানে অতিথি পাখি শিকারের অভিযোগ পেয়েছি। ইতোপূর্বে সবাইকে অতিথি পাখি শিকার না করতে আহ্বান জানানো হয়েছিল। এরপরও যারা অতিথি পাখি শিকার করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

২০১২ সালর বন্যপ্রাণি (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী, পাখি নিধনের সর্বোচ্চ শাস্তি এক লাখ টাকা জরিমানা, এক বছরের কারাদন্ড বা উভয় দন্ড। একই অপরাধ আবার করলে শাস্তি ও জরিমানা দ্বিগুণ। আইন এসব শাস্তির উল্লেখ থাকলেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে পাখি নিধন। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের জলাশয়-বিলগুলো এখন অতিথি পাখির জন্য অনিরাপদ হয়ে পড়েছে।

This post has already been read 5033 times!

Check Also

পরিবেশ সুরক্ষা ও পানি সাশ্রয়ে এডব্লিউডি সেচ পদ্ধতি

ড. এম আব্দুল মোমিন: ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য। আউশ, আমন  বোরো মৌসুমে আমাদের দেশে ধান …