কৃষিবিদ মো. মহির উদ্দিন: পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল এবং দরিদ্রতম দেশ বাংলাদেশ। অপ্রতুল কর্মসংস্থান দারিদ্রের অন্যতম একটি কারণ। কৃষি প্রধান দেশ এবং দেশের অধিকাংশ মানৃষ কৃষিনির্ভর হওয়ায় গবাদিপ্রাণি পালন স্বনির্ভর হওয়ার একটি হাতিয়ার হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। বাণিজ্যিক ভাবে গাভীপালন এবং গরু মোটাতাজাকরণ খামার ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হলেও ছোট ছোট পারিবারিক খামার (১-৩/৫টি গরু) এবং পালনকারীর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষিত, অশিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতি, প্রান্তিক চাষী এবং সমাজের বেশিরভাগ অস্বচ্ছল, কর্মহীন নারী-পুরুষ গাভী পালন ও গরু মোটাতাজাকরনের মতো কর্মকান্ডে যুক্ত হচ্ছে। আমাদের আমিষের চাহিদা পূরণ ও কর্মসংস্থানের খুব সহজ উপায় হওয়ার কারণে ও গরু মোটাতাজাকরন এবং গাভী পালনে মানুষ খুব আগ্রহী হচ্ছে। অনেকে পেশা হিসাবে আবার কেউ কেউ সংসারে বাড়তি আয়ের যোগান হিসাবে নিদিষ্ট পেশার সাথে গবাদিপশু পালন করছেন। আমরা জানি গবাদিপ্রাণি পালনে খাদ্য এবং খাদ্য ব্যবস্থাপনা একটি বড় অন্তরায়। গো-খাদ্যের প্রাপ্যতা এবং দাম গবাদিপ্রাণি পালনের সম্ভাবনাকে বিঘ্নিত করছে।
গবাদিপ্রাণিকে যা খাওয়ানো হচ্ছে
গরু বিষয়ক প্রথম পাঠ হলো “গরু ঘাস খায়”। আমরা জানি ঘাসই হলো গরুর প্রধান খাদ্য। বর্তমানে বিভিন্ন কারনে ঘাস প্রাপ্যতা কমে গেছে। তাই এখন “খড়” গরুর প্রধান খাদ্য। গরুর বাণিজ্যিক খামারে (গাভী এবং মোটাতাজাকরন) গো-খাদ্য হিসাবে অন্যান্য খাদ্যের সাথে খড় এবং কাঁচা ঘাসের ব্যবহার দেখা গেলেও ক্ষুদ্র পালনকারীরা খড় এবং ঘাস খাওয়ানোর সুযোগ থাকা সত্বেও গরু তাড়াতাড়ি মোটাতাজা হবে, গাভী বেশি দুধ দিবে এই ভুল ধারনার বশবর্তী হয়ে গবাদিপ্রাণিকে খুদের ভাত, আটাগুলা পানি, গমের জাউ, কচুর লতি সেদ্ধ, আলু সেদ্ধ, কাটাক্ষুড়ি শাক (একধরনের ঘাস যার গায়ের পরতে পরতে কাটা থাকে) সেদ্ধ, কালাই -এর আটা গুলা পানি ইত্যাদি স্পেশাল খাদ্য হিসাবে এবং স্বাভাবিক খাদ্য হিসাবে এর সাথে গমের ছাল,খৈল ইত্যাদি খাওয়ান।
কোরবানির ঈদ, শবে-বরাত ইত্যাদি উৎসব উপলক্ষ্য করে বর্তমান সময়ে ব্যাপকহারে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ গরু মোটাতাজাকরনের সাথে যুক্ত থাকেন। তাছাড়া একজন গরীব কৃষক বা শ্রমিক অনেক কষ্টে টাকা জমিয়ে, ধার-কর্জ করে বা সমিতি,এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে একটি বা দু’টি গরু কিনে পালন করেন এবং স্বপ্ন বুনেন মোটাতাজা করে বেশি দামে বিক্রি করবেন, গাভীর দুধ বেচে সংসারে স্বচ্ছলতা আনবেন। কিন্তু আটাঘাটি,খুদরান্না,কচুরলতি সেদ্ধ ইত্যাদি খাওয়ানোর কারনে গরু বিভিন্ন রকমের পরিপাকজনিত সমস্যায় ভুগে এমনকি মারা যায়। তাই এ সব খাদ্য পরিহার করে স্বাভাবিক খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
গবাদিপ্রাণির খাদ্য
সবুজ ঘাস,খড় এগুলো হলো গবাদিপ্রাণির স্বাভাবিক খাদ্য। গবাদিপ্রাণির খাদ্যের শতকরা ৮০ ভাগ হবে আঁশ জাতীয় খাদ্য এবং ২০ ভাগ হবে দানা জাতীয় খাদ্য। তা না হলে খাদ্য পরিপাক, পরিশোষণ,সর্বপরি গরুর দৈহিক পরিবৃদ্ধি ইত্যাদি ভালো হবে না। গরুর খাদ্যে আঁশ জাতীয় উপাদান রুমেন অণুজীবের নিরবচ্ছিন্ন কার্বোহাইড্রেড প্রাপ্তি ঠিক রাখে, ফলে খাদ্যের সদ্ব্যবহার হয়। ভুট্টা ভাংগা,গম ভাংগা,চালের ক্ষুদ, আটা,ময়দা ইত্যাদি দানাদার খাদ্য উপাদানে স্টার্চ বেশি থাকে। খড়, ঘাস, লতাপাতা ইত্যাদি আঁশ জাতীয় খাদ্যে থাকে সেলুলোজ,হেমিসেলুলোজ।
গরুকে আঁশ জাতীয় খাদ্য খড়,ঘাস ইত্যাদি খাওয়ানো হচ্ছে এমন অবস্থায় যদি হঠাৎ খাদ্য পরিবর্তন করে দানা জাতীয় খাদ্য সরবরাহ করা হয় বা আশঁ জাতীয় খাদ্যের চেয়ে বেশি পরিমান দানা জাতীয় খাদ্য খাওয়ানো হয সেক্ষেত্রে পরিপাকজনিত সমস্যা সৃষ্টি হয়। দানা জাতীয় খাদ্যে স্টার্চ বেশি থাকে, যাকে বলা হয় readily fermentable carbohydrate, এই স্টার্চ খুব দ্রুত পরিপাক হয়। দ্রুত ফ্যাটি এসিড উৎপন্ন হওয়ার কারণে রুমেনের এসিডিটি বেড়ে যায়। আশঁজাতীয় খাদ্যের পরিবর্তে হঠাৎ দানা জাতীয় খাদ্য সরবরাহ করলে স্টার্চ পরিপাক করে এমন ব্যাকটেরিয়ার দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এই ব্যাকটেরিয়া যে এসিড তৈরি করে তার ৮০ -৮৫ ভাগ হলো ল্যাকটিক এসিড। একই সময়ে রুমেনের পিএইচ কমে ৫ এ নেমে আসে। ল্যাকটিক এসিডের পরিমান যদি খুব বেশি হয় তাহলে তা রুমেনে পুঞ্জিভুত হয় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে তা রুমেন প্রাচীরের মাধ্যমে শোষিত হযে রক্ত প্রবাহে মিশে। রক্তে উচ্চ মাত্রার ল্যাকটিক এসিডের উপস্থিতির কারনে গবাদিপ্রাণি নিচের যে কোন একটি বা একাধিক সমস্যায় ভুগতে পারে।
– রুমেন নিশ্চল হয়ে যায় অর্থাৎ রুমেন কোন কাজ করবে না।
– খাদ্য গ্রহন কমে যায়।
– এসিটিক এসিড উৎপাদনকারী ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা কমে যায়। এই ব্যাকটেরিয়া দুধে ফ্যাট উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা কমে গেলে দুধের ফ্যাটের মাত্রাও কমে যায়।
– রুমেনের প্রাচীর ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
– গরুর পেটে গ্যাস উৎপন্ন হয় অর্থাৎ এসিডোসিস হয়।
– এমনকি পেট ফুলে,শ্বাস কষ্টে মারা যেতে পারে।
যদি গরু উচ্চমাত্রায় দানাজাতীয় খাদ্য খেতে খেতে অভ্যস্থ হড়ে পড়ে সে ক্ষেত্রে একটি নতুন মাইক্রোবিয়াল ভারসাম্য গড়ে উঠে এর ফলে Streptococcus ovis এর পরিমান বেশি হয় না। সেলুলোজ,হেমিসেলুলোজ এগুলো স্টার্চ ও সলুবল কার্বোহাইড্রেট -এর চেয়ে ধীরে পরিপাক হয় এ জন্য গ্যাস উৎপাদন কম হয়।
একটা গরু প্রতিদিন ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা জাবর কাটে। জাবর কাটার ফলে শুধু খাদ্যকনা ভেংগে ছোট ছোট অংশে পরিনতই হয় না।এর ফলে লালা খাদ্যে মিশে। লালাতে এক ধরনের লবণ থাকে যাহা এসিডোসিস (গ্যাস উৎপাদন) হ্রাস করে এবং রুমেনের পিএইচ -এর মাত্রা স্বাভাবিক (পিএইচ ৬-৭) রাখতে ন্যাচারাল বাফার (natural buffer) হিসেবে কাজ করে। স্বাভাবিক খাদ্য খেয়ে একটি গাভী প্রতিদিন ৮০ থেকে ১০০ লিটার লালা উৎপাদন করতে পারে। যদি গরুকে কম পরিমানে রাফেজ(খড়,ঘাস ইত্যাদি আঁশ জাতীয় খাদ্য) এবং বেশি পরিমানে দানাদার খাদ্য খাওয়ানো হয়, তাহলে চর্বণ কম হবে অর্থাৎ খাদ্য কম চিবানো দরকার হয়। ফলে কম পরিমান লালা উৎপন্ন হবে। লালা কম উৎপন্ন হলে রুমেনের পিএইচ ৬-৭ থেকে কমে পিএইচ ৫.২- ৫.৫হয়। এর ফলে এসিডিটি বেড়ে যায়।
গরুকে খড় বা আঁশজাতীয় খাদ্য সরবরাহ করলে গলধকরনের জন্য চর্বন করতে হয় এর ফলে লালা উৎপন্ন যা খাদ্য পরিপাকে গুরুত্বপূর্ণ। এখন প্রশ্ন আঁশ জাতীয় খাদ্যের উৎস হিসাবে সরবরাহকৃত খড় কি অবস্থায় খাওয়ানো উচিত। খড় ছোট ছোট করে খাওয়ানোর চেয়ে আস্ত খাওয়ানো ভালো এর ফলে চর্বন বেশি হবে। গরুর খাদ্যে লম্বা আঁশ জাতীয় খাদ্য সরবরাহের পরিমান এমন হওয়া উচিত যাতে প্রতিকেজি শুষ্ক পদার্থ গ্রহনের ফলে প্রতিদিন অন্তত: ৩০ মিনিট জাবর কাটে। গরু কর্তৃক গৃহিত মোট শুষ্ক পদার্থে খড় জাতীয় খাদ্য হতে প্রাপ্ত এর পরিমান কখনো ৩৫- ৪০ ভাগ এর নিচে হওয়া উচিত নয়। খুদের ভাত, আটাঘাটি, আটাগুলা পানি, আলুসেদ্ধ সবগুলোই কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য। এগুলো খাওয়ানো হলে তা কোন চর্বণ সরাসরি ছাড়াই গরুর পেটে চলে যায় এবং বদ হজম ও পেটে গ্যাস তৈরি করে। এগুলো দানাদার খাদ্য হতে পারে না। সুতরাং এগুলো খাওয়ানো উচিত নয়।
লেখক: উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, চাটমোহর, পাবনা।