কৃষিবিদ ড. এম এ মজিদ মন্ডল : মসলা জাতীয় ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ ও রসুন অন্যতম। কৃষক পেঁয়াজ ও রসুন উৎপাদন করতে যেয়ে বিশাল অংশ নষ্ট হয় রোগ ও পোকামাকড় দ্বারা আক্রান্ত হয়ে। যেসব কারণে কৃষকের মাঠে পেঁয়াজ-রসুন নষ্ট হয় তার জন্য শতকরা ৮০-৯০ ভাগ দায়ী পার্পল ব্লচ ও ব্লাস্ট নামক দুটি রোগ। তাই রোগ দুটির কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার এখানে আলোচনা করা হলো-
পার্পল ব্লচ (Purple blotch/ Blight)
এই রোগে আক্রান্ত পেঁয়াজ ও রসুনের পাতা বলের মত স্পট পড়ে পার্পল বা লালচে বর্ণ ধারন করে দ্রুত নস্ট হয়ে যায়, তাই এ রোগের নাম পার্পল ব্লচ বা ব্লাইট হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এ রোগ Alternaria porri ও Stemphylium sp নামক ছত্রাক আক্রান্ত হয়ে থাকে। রোগাক্রান্ত ফসলের অবশিস্টাংশে ছত্রাকের মাইসেলিয়াম এক ফসল থেকে পরের বছর ফসল পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। এই রোগের জীবাণু সাধারনত ক. স্পোর যুক্ত মাটি খ. ফসলের পরিত্যক্ত অংশ গ. আক্রান্ত বীজ; প্রভৃতি দ্বারা বংশ বিস্তার করে থাকে।
রোগের অনুকুল অবস্থা
শীত চলে যাওয়ার পর এ রোগ দেখা যায়
ক. আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৮৫-৯০%,
খ. তাপমাত্রা ২২-২৫ ডিগ্রী সে.
গ. দুই-তিন দিন মেঘলা আকাশ বা বৃষ্টি হযে থাকলে এই রোগ হয়ে থাকে। সাধারণত শীতের শেষে বা শীত চলে গেলে এই রোগ দেখা যায়।
রোগের লক্ষণ
ক. প্রাথমিক অবস্থায় রসালো দাগ দেখা যায় ও পুষ্পগুচ্ছ দন্ডে ছোট ছোট সোনালি পানি ভেজা ও সাদাটে দাগ দেখা যায়।
খ. দাগগুলোর রং শীঘ্রই বাদামি হয়ে যায়।
গ. দাগগুলোর আকারে বড় হয়ে জোন বা বড় এলাকা তৈরি করে।
ঘ. দাগের কিনারা পার্পল বা লাল বর্ণ ধারন করে এবং চারদিকে হলুদ রং দ্বারা ঘেরা থাকে।
ঙ. আক্রান্ত পাতা কুঁচকিয়ে যায়, হলুদ বর্ণ ধারন করে, শুকিয়ে যায় এবং সংক্রমণ স্থান ভেঙ্গে যায়।
চ. রোগ মারাত্মক হলে বাল্বও পচে যেতে পারে।
দমন ব্যবস্থা
ক. ফসল উঠাবার পর পরিত্যক্ত অংশসমূহ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
খ. শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে পারলে এ রোগ দমন খুবই কার্যকরী।
গ. মাঠ সুনিষ্কাশিত রাখতে হবে।
ঘ. যে কোন বীজ শোর্ধক ক্যামিক্যাল দ্বারা বীজ শোধন করতে হবে। যেমন-
১. ভিটাভেকস্-২০০ প্রতি ১ কেজিতে ২ গ্রাম হারে মিশাতে হবে, অথবা
২. থিরাম প্রতি ১ কেজিতে ২.৫০ গ্রাম হারে মিশাতে হবে।
ঙ. প্রথম রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়ার পর থেকেই (রোগ দেখার পূর্বেও করা যেতে পারে) ফানজিসাইড স্প্রে করতে হবে। যেমন-
১. রুভরাল ০.৩ % হারে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
২. ডাইথেন-এম-৪৫ ও এন্ডোফাইল-এম-৪৫ পানিতে ০.৩ % হারে মিশে ১০-১৫ দিন পরপর তিনি থেকে চার বার স্প্রে করতে হবে।
৩. কপার ফানজিসাইড ০.৩% হারে ১০ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
ব্লাস্ট (Blast)
এই রোগটি বোট্রিটিস (Botrytis sp) নামক ছত্রাকের চারটি প্রজাতি দ্বারা হয়ে থাকে। এ রোগের জীবাণু পেঁয়াজ ও রসুন গাছে প্রবেশ করে কয়েক দিনের মধেই দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে ফসল নষ্ট করে ফেলে তাই এ রোগের নাম ব্লাস্ট হয়েছে। এ রোগ সরাসরি সুস্থ গাছকে আক্রমণ করতে পারে না, ভেজা পাতার উপর ছত্রাকের স্পোর পড়লে সেটি অঙ্কুরিত হয় এবং বিষাক্ত দ্রব্য ক্ষরণ করে থাকে। এ বিষাক্ত দব্য বিস্তার হয়ে দেহ কোষ নষ্ট হয়ে যায় এবং পাতা সাদা হয়ে মরে যায়।
রোগের অনুকুল অবস্থা
ক. মেঘলা আকাশ ও ঘন কুয়াশা হলে।
খ. গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হলে।
গ. বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৮০-৯০% হলে।
ঘ. তাপমাত্রা ২০-২৫ ডিগ্রীর কাছাকাছি হলে।
রোগের লক্ষণ
১. প্রাথমিক অবস্থায় পাতায় ছোট ছোট সাদা দাগ পড়ে।
২. পরবর্তীতে স্পোর উৎপাদন হয়ে সাদা অংশ বড় হতে থাকে ও মরে যায়।
৩. সাদা অংশের পরিমান সমস্ত পাতায় বৃদ্ধি পেতে থাকে।
৪. আক্রান্ত পাতা কুচঁকিয়ে যায় মরে ঝুলে পড়ে।
৫. রোগের আক্রমণ দ্রুত সমস্ত গাছে ছড়িয়ে পড়ে, তাই একে ব্লাস্ট বলা হয়।
৬. অপ্রাপ্ত বয়সে গাছের পাতা মরে যায়, তাই বাল্ব (পেঁয়াজ) ছোট হয়ে যায়।
দমন ব্যবস্থা
ক. শস্য পর্যায় অবলম্বন করলে এ রোগ দমন করা খুবই কার্যকরী হয়।
খ. পেঁয়াজ-রসুন উঠানোর পর অবশিষ্টাংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
গ. বীজ শোধন করতে হবে, ভিটাভেকস-২০০ প্রতি কেজি বীজে ২ গ্রাম ও ওষুধ মিশিয়ে বীজ লাগাতে হবে।
ঘ. জমিতে রোগ দেখা যাওযার সাথে সাথে ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে। যেমন-
১. বাভিসটিন ৫০ ডব্লিউ পি ১৫ গ্রাম ১০ লিটার পানিতে মিশে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করা যায়। এভাবে দুই-তিন বার স্প্রে করতে হবে।
২. ডাইথেন-এম-৪৫ ও এন্ডোফাইল-এম-৪৫, ০.৩% হারে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
৩. রুবরাল-৫০ ডব্লিউ পি ২০ গ্রাম ১০ লিটার পানিতে মিশে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে। এ ভাবে দুই-তিন বার স্প্রে করতে হবে।
লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (বারটান), রাজশাহী বিভাগীয় আঞ্চলিক কেন্দ্র, সিরাজগঞ্জ।