এম ওমর ফারুক : সবেমাত্র চাকরি থেকে অবসরে এসেছি। বলা যায় আমি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি। কারণ এই ৩৯ বছর বয়সে কেউ অবসরে যান না। যাইহোক, এই বিস্তৃত অবসরে কি করবো! অন্তত সময়টা তো পার করতে হবে। একদিন চ্যানেল আই এর একটা অনুষ্ঠান দেখলাম ঘরের মধ্যে মাছের চাষ। সেদিন অনুষ্ঠানটা পুরোপুরি দেখতে পারি নি। শেষের কিছু অংশ দেখেছিলাম। শেষ দৃশ্যের বক্তব্যগুলো এমন ছিল যে, একটা হাউজে মাছ ছেড়ে দিয়েছি আর কয়েক মাসেই আমি লাখপতি এবং বছর ঘুরতেই কোটিপতি। কিন্তু হায় হায়! আমি তো পুরো বক্তব্য বা পদ্ধতি কিছুই দেখতে বা শুনতে পারি নি। কি করবো এখন? কিভাবে জানতে পারবো এইসব অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে?
চিন্তায় ভাজ পড়ে গেল কপালে। তখনই আমার গিন্নী বললো, “আরে এত চিন্তা করছো কেন? ইউটিউবে সার্চ দাও।”
বলতে দেরি কিন্তু আমার সার্চ দিতে দেরি হ য়নি। Indoor fish farming, ঘরের মধ্যে মাছের চাষ ইত্যাদি লিখে সার্চ দিতেই কত শত ভিডিও সামনে এসে হাজির। কয়েকটি ভিডিও দেখেই হুররে, পেয়েছি বলে চিতকার দিয়ে উঠলাম।
মধ্যরাতে চিতকার শুনে পাশের কক্ষে ঘুমিয়ে থাকা ছেলেটা দৌড়ে আমার কক্ষে এসে জিজ্ঞাসা করছে- আব্বু কি হয়েছে? ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটা একলাফে আমার কোলে এসে বসেছে। গিন্নী বলছে কি হলো! এতো রাতে নিজেও ঘুমাও না, আর অন্যরা ঘুমালে তাদেরও ঘুমাতে দাও না।
আমার মনে হয় আমি বিগত ১২/১৪ বছরে এমন জোরে চিৎকার করিনি। তাদেরকে বললাম, আমি আমার অবসর জীবন পার করার উপায় পেয়ে গেছি। ঘরের মধ্যে মাছের চাষই হবে আমার আগামী ধ্যান-জ্ঞান এবং আয়ের উৎস। তোমরা ঘুমাও।
সেই রাত আমি ঘুমাই নি। সারারাত ইউটিউবে ভিডিও দেখে পার করেছিলাম।
ময়মনসিংহের RAS system, বগুড়ার রহিম ভাইয়ের তেলাপিয়া চাষ, ডেমরার আলাউদ্দিনের আলাস মেথড, সাতক্ষীরার জাকির ভাইয়ের শৈল মাছের চাষ, মালয়েশিয়া প্রবাসী রাজিবের ভিডিও, ইন্ডিয়ার আফতাবের ভিডিও, আরো অনেক। কি করা যায়! কি করা যায়! কিভাবে তাদের প্রজেক্টগুলো ভিজিট করবো? কিভাবে কখন তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নেবো? তারা তো লিজেন্ড, আমার মতো কাউকে কেন পরামর্শ দেবেন উনারা! এসব ভাবতে ভাবতেই সকাল হয়ে গেল।
ভিডিও দেখবার সময় উনাদের নাম্বারগুলোর স্ক্রিনশট নিয়ে রেখেছিলাম। কল দিতে গিয়েও দিচ্ছি না। ভাবছি, এতো সকালে তাদের মতো লিজেন্ড শ্রেণীর মানুষকে ফোন করব! যদি ঘুম থেকে না জাগেন তাহলে তো কল দিলে রাগ করবেন। ১০টা অবধি অপেক্ষা করে তারপর কল দেয়া শুরু করলাম।
বগুড়ার রহিম কল রিসিভ করলেন না। ডেমরার আলাউদ্দিন কল রিসিভ করলেন। আমি খুবই আদবের সঙ্গে স্যার সম্বোধন করে সালাম দিয়ে কথা শুরু করেছি। ওপাশ থেকে আলাউদ্দিন সাহেব বললেন, কিছুক্ষণ পর কল করুন। জ্বি স্যার, জ্বি স্যার বলতে বলতে আমি ফোন রেখে দিলাম। এভাবে অনেককে কল দিলাম সেদিন। অনেক লিজেন্ডের নাম্বার আমি সংরক্ষণ করতে পেরেছি ভেবে আমার ভেতরে একটা আনন্দ অনুভূত হচ্ছিলো।
ডেমরার আলাউদ্দিন সাহেবকে আবারও কল দিলাম। উনি ভিজিট করার অনুমতি দিলেন এভাবে- “সামনে যে শুক্রবার তার পরের শুক্রবার আসবেন।” অনুমতি পেয়ে আমি তো মহাখুশি!
স্যার কিভাবে আসবো? উনি রাস্তা এবং গাড়ির নামধাম বলে দিলেন।
এরইমধ্যে বগুড়ার রহিম ভাইয়ের সঙ্গেও কথা হয়েছে। কিন্তু তিনি জানালেন- তিনি সময় দিতে পারবেন না; আমাকে কথা বলতে হবে উনার ছেলের সঙ্গে।
ছেলের নাম্বার নাকি ইউটিউবে আছে, সার্চ দিয়ে সংগ্রহ করতে হবে। কী আর করা। এতো বড় লিজেন্ড, আমার সঙ্গে কথা বলেছেন, তাই বা কম কি? ইউটিউব থেকে নাম্বার খুঁজে রহিম সাহেবের ছেলেকে কল দিলাম। সে বললো- আসেন যেকোনো সময়।
তারপর শুরু হলো প্রজেক্ট ভিজিটিং। আমি বিভিন্ন প্রজেক্ট ভিজিটের অভিজ্ঞতাগুলো সবাইকে জানানোর জন্য এই লেখাটি লিখছি।
প্রজেক্ট ভিজিট ১
বগুড়ার রহিম ভাইয়ের প্রজেক্ট। উনি ইউটিউবের ভিডিওতে বক্তব্য ও নির্দেশনা দিয়েছেন যে, একেকটা তেলাপিয়া ৪/৫ মাসেই এক কেজি হয়ে যাবে। একটা ১২ ফুট বাই ১৫ ফুট হাউজে ৬০ হাজার টাকা লাভ। ইত্যাদি, ইত্যাদি।
একদিন খুব সকালে সাভারের বাসা থেকে বগুড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। পৌঁছে গেলাম বগুড়ার আদমদিঘী গ্রামে। রাস্তার পাশেই রহিম ভাইয়ের প্রজেক্ট। রহিম ভাই ও তার ছেলেকে একসাথে পেয়ে গেলাম। কিন্তু একি! কিসের তেলাপিয়া, কিসের মাছ চাষ- কিছুই তো দেখছি না।
এতো বড় লিজেন্ড রহিম ভাই আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন না। তার ছেলে মাথাব্যথার অজুহাতে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করলো। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর রহিম ভাই বললেন, ভাই বোঝেন না? ওগুলো ভিডিওর জন্য বলা। আমাকে পরামর্শ দিলেন সাড়ে তিন ফুট গভীর পানির হাউজ তৈরির। এরপর তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললেন।
রহিম ভাইয়ের প্রজেক্ট থেকে বেরিয়ে এসে সামনের রাস্তার মোড়ে চা-সিগারেটের জন্য বসলাম বিধ্বস্ত ও বিষন্ন মন নিয়ে। বসা মাত্রই চা দোকানী জিজ্ঞেস করলো- ভাই কন্টু আসিচ্ছেন?
আমি বুঝলাম, আমি কোথায় এসেছি এটাই জিজ্ঞেস করেছে। জবাবে বললাম, রহিম ভাইয়ের প্রজেক্ট দেখতে এসেছি। একথা শুনে দোকানী যা বললো তা এমন-
“ভাই, কিসক আসিচ্ছেন এটি? ও লটির বেটা তো চিটার, ওটি পাংগাস বেচিচ্ছিলো, সগলি পাংগাস রহিম নাম দিছলো। তখন থেকি পাংগাস রহিম না বললি কেউ চিনবার পারিচ্চে না। আরেক লটির ব্যাটাক ধরি আনি কি ভিডিও করিচ্চে আর ইউটিউবত ছাড়িচ্ছে। এরপর থাকি লোক শুধু আসিচ্চে আর আসিচ্চে।”
আমি শুধু শুনলাম দোকানীর কথা। তারপর একটা সিগারেটে আগুন লাগিয়ে বেরিয়ে এলাম।
প্রজেক্ট ভিজিট ২
আলা’স মেথডে মাছ চাষ-
কয়েকবার গাড়ী, সিএনজি, অটোরিকশা পাল্টিয়ে যখন সাভার থেকে ডেমরা পৌঁছেছি তখন বেলা ১১টা বাজে। আমি ডেমরার আলাউদ্দিন সাহেবকে কল দিলাম। বললাম, স্যার আমি তো এসেছি আপনার বাড়ির কাছেই। উনি জবাব দিলেন, আশেপাশে কোথাও অপেক্ষা করেন। বিকেল তিনটা বাজে আরেকবার কল দেবেন। তখন প্রজেক্ট দেখতে ডাকবো। কি আর করবো! দোকানে, বাজারে, জাহাজ কারখানায় ঘুরে ঘুরে সময় যেন পার হয় না। জুমার নামাজের পরও দেড় ঘন্টা সময় কিভাবে পার করি! তবুও অপেক্ষা করতে লাগলাম। আশপাশে যে কয়েকটি দোকান ছিল সেখান থেকে চা বিস্কুট আর সিগারেট নিয়ে পার করছি সময়।
তিনটা বাজে। কল দিলাম আলাউদ্দিন সাহেবকে। অনুমতি মিলল বাড়ি প্রবেশের। তার বাড়িতে গিয়ে আমি অবাক। মনে মনে বলে। উঠলাম- ওমা একি! এতটুকু এক হাউজে কয়েকটি তেলাপিয়া দেয়া। কয়েক মিনিটের মধ্যে অনেক লোক জমা হয়েছে। হ্যা, তাদের সবাইকে তো রাস্তায় ঘুরাঘুরি করতে দেখেছি! আলাউদ্দিন সাহেব বসতে দিলেন সবাইকে। অনেকে বসার স্থান পেলো না; তারা দাঁড়িয়ে বক্তব্য শুনতে লাগলো।
১৮/২০ মিনিট বক্তব্য দিলো, কথা শুধু একটাই- “বুঝলেন তো, ট্যাংকটাই মূল ব্যাপার। বুঝলেন তো, ট্যাংকটাই মূল ব্যাপার। ১২ ইঞ্চি থেকে ১৪ ইঞ্চি ঢালু রাখবেন।”
আলাউদ্দিন সাহেব দাঁড়ি পাকা একজন বৃদ্ধ। মাছ চাষ সম্পর্কে কিছুই জানেন না বা জ্ঞান নেই তার। তবে ইউটিউব চ্যানেল আছে।
সাবেক অর্থমন্ত্রীর মতো ‘রাবিশ’ বলে গালি দিতে দিতে সবাই বিদায় নিলো। আমিও সন্ধ্যার আগে বাসায় ফেরার পথে যাত্রা করলাম। দাঁড়ি পাকা একজন অতিশয় বৃদ্ধ প্রতারককে অযথা স্যার ডাকার অনুশোচনা আজও জাগে।
প্রজেক্ট ভিজিট ৩:
ত্রিশাল উপজেলার ধলা। নাম বিজয়।
দাদা আসেন আমার এখানে মাছ চাষের বিভিন্ন আয়োজন দেখবেন। একইভাবে আরো কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো। ভাবলাম যেভাবেই হোক ঘরের মধ্যে মাছের চাষ করতেই হবে। এজন্য মাছের পোনা কিভাবে সংগ্রহ করবো নিজ চোখে দেখে আসি।
বাসা থেকে ইউটিউবে পাওয়া নাম্বারে কল দিলে সবাই হোম ডেলিভারি দিতে চায়। কিন্তু হ্যাচারি দেখতে বা ওখানে গিয়ে পোনা নিতে চাইলে রাজি হতেই চায় না। নানা সমস্যার কথা বলে এড়িয়ে যেতে শুরু করে। অনেক চাপাচাপির পর রাজি হলো, মানে সেখানে দেখতে যাওয়ার কথায় সম্মত। সবারই একটা জিজ্ঞাসা- কবে আসবেন?
আমি বললাম বুধবার বা বৃ্হস্পতিবার আসবো। নির্দিষ্ট করে দিন উল্লেখ না করে একদিন গিয়ে হাজির হলাম। সেদিন ছিল বুধবার। কল দিলাম। ভাই আপনি কোথায় আছেন? জবাব এলো- এইতো ভাই আমি ধলা হ্যাচারিতে আছি। কী পোনা লাগবে? আমি বললাম, ভাই, শিং মাছের পোনা লাগবে।
ভাই, কতগুলো লাগবে ভাই?
আমি বললাম, আপাতত এক লাখ লাগবে কয়েকদিন পরে ৪/৫ লাখ লাগবে।
আচ্ছা ভাই কোনো প্রব্লেম নেই, মাইক্রোবাসে করে পোনা পৌঁছে দেবো। আপনি টেনশন করবেন না।
তা ভাই, আপনার হ্যাচারির নাম কি?
ওদিক থেকে ভিন্ন প্রশ্ন- ভাই আপনি কোথায় আছেন?
আমি বললাম, ভাই এই তো আমি ধলা বাজার পার হয়ে গাজির মোড়ে এসেছি। ওদিক থেকে আর কোনো কথা নেই।
খানিক বিরতি দিয়ে বললো, কী আর বলবো ভাই! আমি একটা হোম ডেলিভারি দিতে কুমিল্লা এসেছি। আর আজকেই আপনি ধলা এসেছেন। আগে একটু ফোন করে আসবেন তো!
আমি বললাম, সমস্যা নেই। আপনার হ্যাচারির নাম ঠিকানা বলেন। আমি গিয়ে দেখে আসি, পরে পোনা আপনি পৌঁছে দেবেন। জবাবে কী বলবে সে? তার তো নিজের হ্যাচারি নেই। সে একজন দালাল। তবুও লোভে পড়ে একটা হ্যাচারির নাম বললো। এভাবে চারজনকে জনকে হঠাৎ কল দিলাম সবাই বাইরে আছে। সেদিন কেউ ধলায় হাজির ছিলো না।
উপায়ন্তর না পেয়ে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে কয়েকটি হ্যাচারি ভিজিট করলাম। এসব হ্যাচারির মালিকদের কাছে প্রতারকগুলোর নাম বলার পর তারা যে প্রতিক্রিয়া জানালো তা লিখতে আমি লজ্জা পাচ্ছি।
এইসব দালাল ইউটিউব এবং ফেইসবুকে বিভিন্ন হ্যাচারির নাম দিয়ে পেইজ বা আইডি খুলে মানুষকে ঠকিয়ে যাচ্ছে। এরা নামে সবাই হ্যাচারির মালিক অথচ এদের কাছে বলবেন যে, নিজে হ্যাচারিতে গিয়ে পোনা কিনবো; তখন এরা কেউ হ্যাচারিতে থাকবে না।
উপরের এসব ঘটনা তুলে ধরলাম শুধুমাত্র একটা কারণে, সেটি হলো- আমরা মাছ চাষিরা যেন কাউকে অতিমাত্রায় বিশ্বাস করে ঠকে না যাই। মজার ব্যাপার হলো- এতকিছুর পরেও আমি মাছ চাষে যুক্ত হয়েছি। আমার নিজস্ব একটা হ্যাচিং প্লান্ট আছে। তবে সেখানে শুধুমাত্র অ্যাকুরিয়াম ফিস কালচার করা হয়।
যাহোক, একজন চাষিভাইও যদি লেখাটি পড়ে উপকৃত হন তবেই আমার লেখা সফল। সে সফলতা বাংলাদেশ ফিস ফারমার্স এসোসিয়েশনেরও।