শুক্রবার , নভেম্বর ২২ ২০২৪

সূর্যমুখী চাষে সফল হতে চান দক্ষিণ সুরমার কৃষক

শহীদ আহমেদ খান (সিলেট) : সূর্যমুখী ফুল চাষ করে  সফল হতে চান দক্ষিণ সুরমার মোল্লারগাঁওয়ের কৃষক আব্দুস সবুর সুজাম । এর আগে তিনি ২০১০ সালে ১২ বিঘা জমিতে স্ট্রবেরী চাষ করে সফলতা ও আঞ্চলিক পুরস্কার লাভ করেন। দক্ষিণ সুরমার মোল্লার গাঁও  নিবাসী বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক ও রাষ্ট্রপতি পদক প্রাপ্ত সফল কৃষক নেতা মরহুম আশরাফ আলী ও সৈয়দা আয়শা খানমের পুত্র সুজাম পিতার পথ ধরে কৃষি ক্ষেত্রে একের পর এক সফলতা অর্জন করে চলেছেন।

সরেজমিনে সুজামের সূর্যমুখী ফুল বাগান ঘুরে দেখা যায়, অপরূপ সৌন্দর্যে সেজেছে সুজামের সূর্যমুখী বাগান। এ যেন এক ফুলের রাজ্য, এখানে এসে ভ্রমণ পিপাসুদেরও মন আনন্দে ভরে ওঠে। সবুজে ঘেরা প্রকৃতির মাঝে মনোরম পরিবেশে  শোভা পাচ্ছে হলুদ রঙের সূর্যমুখী। দূর  থেকে  যে কারো মন কেড়ে নেবে অপরূপ দৃশ্যটি। সূর্যমুখীর বাগানে দর্শনার্থীদের পদচারণা বেড়েছে বলে জানান কৃষক সুজাম। মাঠে সূর্যমুখী ফুলের সমারোহ। সূর্যমুখীর বাম্পার ফলন গ্রামীণ অর্থনীতিতে সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, সূর্যমুখী ফুল সারা বছর চাষ করা যায়। তবে অগ্রহায়ন মাসের মধ্য থেকে চাষ করলে এর ভাল ফলন পাওয়া যায়। সুজামের বাগানে ইন্ডিয়ান প্যাসিফিক হাইসান -৩৩ জাতের সূর্যমুখী ফুল রোপন করা হয়েছে। ফুলের ব্যাস ২১.৩ সেন্টিমিটার। উচ্চতা ৯০ সেন্টিমিটার থেকে ১১০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত । ফুলের দানা ১৩০০ শ এবং ফলন একর প্রতি ৩৫ থেকে ৩৬ মণ।

সূর্যমুখীর বীজ যন্ত্রে মাড়াই করে তেল বের করা হয়। তেলের উৎস হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সূর্যমুখীর ব্যাপক চাষ হয়। সমভূমি এলাকায় শীত ও বসন্তকালে, উঁচু লালমাটি এলাকায়, বর্ষাকালে ও সমুদ্রকূলবর্তী এলাকায় শীতকালীন শস্য হিসাবে চাষ করা হয়। ১৯৭৫ সাল  থেকে সূর্যমুখী একটি  তেল ফসল হিসেবে বাংলাদেশে চাষ করা হচ্ছে। সূর্যমুখীর  তেল ঘিয়ের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই  তেল অন্যান্য  ভোজ্য  তেল  থেকে ভাল এবং হৃদরোগীদের জন্য  বেশ উপকারী। এতে  কোলেস্টরলের মাত্রা অত্যন্ত কম। এছাড়া এতে ভিটামিন এ, ডি ও ই রয়েছে। এর বীজ হাস মুরগির খাদ্যরূপে ও  তেলের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

দক্ষিণ সুরমা উপজেলার মোল্লার গাঁওয়ের সূর্যমুখী প্রদর্শনী মাঠ এখন হলুদ ফুলের সমাহারে নয়নাভিরাম রুপ নিয়েছে। বিনোদন পিপাসু পর্যটকরা বিকাল বেলায় তাদের স্বজনদের নিয়ে সূর্যমুখী প্রদর্শনীতে ভিড় জমাচ্ছেন। এ  যেন ফসলী জমি নয়, দৃষ্টিনন্দন বাগান।

আলাপকালে তিনি জানান, ইউনিয়ন সহকারী কৃষি অফিসারের কাছ  থেকে বীজ সংগ্রহ করে চাষ শুরু করেন এই কৃষক। একটি পরিপূর্ণ সূর্যমুখী ফুলের গাছ ৯০ দিন  থেকে ১২০ দিনের মধ্যেই কৃষকরা বীজ ঘরে তুলতে পারবেন। যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে কোন প্রকার ক্ষতি না হয় তাহলে প্রতি বিঘা জমিতে ৮  থেকে ১০ মণ সূর্যমূখী ফুলের বীজ পাওয়া যাবে। ১ মণ বীজ থেকে ১৮  কেজি তেল পাওয়া যাবে। সূর্যমুখীর তেল ছাড়াও খৈল দিয়ে মাছের খাবার এবং সূর্যমুখী গাছ জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা যায়। এর  কোন অংশই  ফেলা হয়না।

দক্ষিণ সুরমা উপজেলায় প্রথমবারের মতো প্রায় ৩ একর জমিতে সূর্যমুখী চাষ করছেন কৃষক সুজাম। সূর্যমুখী চাষের ফলে অনেকের আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমবারের মতো এই কৃষক  সূর্যমুখীর বীজ উৎপাদনে সফল হতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন সহকারী কৃষি অফিসার। সূর্যমুখী বিক্রি করে এবার কৃষকের মুখে হাসি ফুটবে বলে আশা দক্ষিণ সুরমার মোল্লার গাওঁ ইউনিয়নের সহকারী কৃষি অফিসার বিপ্রেস তালুকদারের।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিলেটের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সিলেটের মাটিতে সূর্যমুখী চাষ করার লক্ষ্যে গত তিন বছর ধরে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় গবেষণা চালাচ্ছেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউড (বারি) সিলেট শাখার গবেষকরা।

কৃষক  সুজাম জানান, সহকারী কৃষি কর্মকর্তার  দেওয়া পরামর্শ ও সহযোগিতায় প্রথমবারের মতো তিনি  ৩ বিঘা জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করেছেন। কৃষি অফিস থেকে বিনামূল্যে বীজ, সার ও নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রতিটি গাছে ফুল ধরেছে। ভাল ফলন পাওয়ার আশা করছেন। সহকারী কৃষি কর্মকর্তা বিপ্রেস তালুকদার জানান, সূর্যমুখী ফুল থেকে পাখির খাবারের পাশাপাশি  কোলেস্টেরল মুক্ত  তেল উৎপাদন করে ক্ষতিকর পাম অয়েল ও সয়াবিনের স্বাস্থ্যঝুঁকি  থেকে রক্ষা পাবে মানুষ। চলতি বছরে কৃষক সুজাম সূর্যমুখী ফুলের চাষ করেছেন। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে কৃষকদের বিনামূল্যে সূর্যমুখীর বীজ, সার ও আন্ত-পরিচর্যার জন্য উপকরণ ও অর্থ সহায়তা  দেয়া হয়েছে। সূর্যমুখী চাষে কৃষকরা আরো আগ্রহী হবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

সংকটাপন্ন পরিবেশের মধ্যেও মোল্লারগাঁও ইউনিয়নের ভাইয়ারপারে তরুণ চাষী আব্দুস সবুর সুজাম ৩ একর জায়গার মধ্যে সূর্যমুখী চাষ করে করেছেন। এখানকার মাটি সূর্যমুখী ফুলের জন্য উর্বর বলে প্রমাণ করেছেন। আব্দুস সবুর চাষাবাদে মনোযোগী হয়েছেন তার বাবার কাছ থেকে প্রেরণা পেয়ে। তার বাবা প্রয়াত আশরাফ আলী ১৯৭৪ সালে কৃষি ক্ষেত্রে সফলতার জন্য বঙ্গবন্ধু ও রাষ্ট্রপতি পদক পেয়েছেন। এছাড়া ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে সিউলে অনুষ্ঠিত কৃষক প্রশিক্ষণে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এর আগে সবুর তার ২৪ শতক জায়গায় স্ট্রবেরী চাষ করেও সফল হয়েছেন।

কৃষিক্ষেত্রে অনেক সাফল্য রয়েছে সুজামের। মোল্লার গাঁও ইউনিয়ন সিআইজি(ফসল) সমবায় সমিতির পরিচালক ও সাধারণ সম্পাদক সুজাম ১৯৯৩,৯৫,৯৬ সালে পশু স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্প্রসারণ প্রকল্পসহ বিভিন্ন কৃষি মেলায় অংশ নিয়ে পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া তিনি ২০১৫-১৬ সালে পল্লী সেচ প্রকল্প গঠন করে সিলেট অঞ্চলের পতিত জমি চাষে কৃষি উন্নয়ন বিষয়ক কোর কমিটির প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত হন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বিভিন্ন কার্যক্রম ও প্রদর্শনীতে তিনি বিভিন্ন সময় অংশ নেন। তিনি বার্মি কম্পোষ্ট, উন্নত কচুঁ চাষ,রাইস ট্রান্স প্ল্যান্টার দ্বারা  ধানের চারা রোপণ, রিপার দ্বারা ধান কর্তন, উন্নত জাতের চাষাবাদ করেন।

This post has already been read 4446 times!

Check Also

বারি ও সুপ্রিম সীড কোম্পানি লি: এর মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর

গাজীপুর সংবাদদাতা: বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এবং সুপ্রিম সীড কোম্পানি লিমিটেড এর মধ্যে এক …