ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা) : ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করে লাভবান হচ্ছেন চাষিরা। উপকূলীয় অঞ্চলে বিগত কয়েক বছর ধরে চিংড়ি উৎপাদন কমলে মৎস্য অধিদপ্তরের নির্দেশনায় ডুমুরিয়ায় ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চাষ করে চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতীর মৎস্য উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। খুলনা জেলার ডুমুরিয়ার বড়ডাঙ্গা গ্রামের পাশাপাশী দক্ষিন উপকুলীয় অঞ্চলে শিক্ষিত বেকারদের মাঝে নতুন উদ্যমে শুরু হয়েছে সম্ভাবনাময় ক্লাস্টার পদ্ধতির চিংড়ি চাষ । ফলে ক্লাস্টার পদ্ধতির এ চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতীর মৎস চাষে উন্মোচিত হচ্ছে ব্যাপক কর্মসংস্থানের দ্বার।
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলা চিংড়িসহ মৎস চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। রয়েছে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ২৫০০০ চিংড়ি ঘের। কিন্তু পূর্বে সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ করার ফলে উৎপাদন খুবই কম হচ্ছিল। বিভিন্ন সময় রোগ বালাই সহ নানাবিধ কারণে চিংড়ির মড়কও দেখা যায়। আবার উৎপাদন খরচ বেশী হওয়ায় চাষীদের লোকসানও গুনতে হয়েছে। ফলে দিনদিন দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় সাদাসোনা খ্যাত চিংড়ি চাষে আগ্রহ হারিয়ে চাষিরা ভিন্ন পেশায় চলে যান ।
সূত্র জানায়, ভাইরাস,মড়ক,ন্যায্য মুল্য না পাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে চিংড়ি চাষিরা যখন হতাশায় দিন পার করছে ঠিক তখনই মৎস্য অধিদপ্তর চাষিদের দেখিয়েছেন নতুন সম্ভাবনা ও আশার আলো। মৎস্য অধিদপ্তর ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষের জন্য মৎস চাষীদের সংগঠিত করেন বড়ডাঙ্গা চিংড়ি চাষী (সিআইজি) সমবায় সমিতি ৬৫ জন সদস্যকে ক্লাস্টার পদ্ধতির প্রশক্ষিন দেয়া এবং খামারের ডেমো দেয়া হয় । প্রথমে প্রশিক্ষিত ৬৫জন সদস্য প্রত্যেক সদস্য এক হাজার টাকা করে মোট ৬৫ হাজার টাকা সংগ্রহ করেন । সমিতির সংগ্রহিত ৬৫হাজার টাকা মূলধন দিয়ে ক্লাস্টার পদ্ধতিতে মৎস চাষ শুরু করেন । তাদের মৎস খামারে শুধু চিংড়ি মাছই নয় সাখে পারসে,কার্ফসহ আরো দেশীয় মাছ চাষ করা হয় । বড়ডাঙ্গা গ্রামের বড়ডাঙ্গা চিংড়ি চাষী (সিআইজি) সমবায় সমিতি ৬৫ জন সদস্যদের ৬৫ হাজার টাকার মূলধন এখন দাড়িয়েছে ১৮ লক্ষ টাকায় । সিআইজি প্রকল্পের সদস্যদের পাশাপাশী এখন ঐ গ্রামের আরো ১৫৩ জন মৎস চাষী ক্লাস্টার পদ্ধতিতে মৎস চাষ শুরু করেন । বর্তমানে বড়ডাঙ্গা গ্রামের ২২৮ জন চাষি (তন্মধ্যে ৬০ জন নারী সদস্য ) প্রাথমিক অবস্থায় ৭৫ হেক্টর ঘের ও জলাশয়ে চিংড়ি চাষ করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। চাষীরা সবাই বড়ডাঙ্গা চিংড়ি চাষী (সিআইজি) সমবায় সমিতির অর্থায়নে সয়াবিন,ভুট্রা,ডাল,অটোপালিশ,আটা,খৈল,মাছেরগুর,ঝিনুকেরগুরা,আতপকুরা দিয়ে মাছের খাবার উৎপাদন করে । যার ফিডের নাম বড়ডাঙ্গা মডেল ফিড । প্রতি বস্তা ফিড তৈরিতে সমিতির খরচ ১০২০টাকা । সদস্য ছাড়া অন্য চাষীরা এ ফিড ক্রয় করেন ১০৫০টাকা । মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় এই খাবার প্রস্তুত করা হয় ।
পূর্বে যেখানে হেক্টর প্রতি মাছের গড় উৎপাদন ছিল গলদা চিংড়ি ৪৬০ কেজি, বাগদা চিংড়ি ২৯০ কেজি। বর্তমানে ক্লাস্টার পদ্ধতি ও বড়ডাঙ্গা মডেল ফিড দ্বারা চাষা বাদের ফলে হেক্টর প্রতি গড় মাছের উৎপাদন দাড়িয়েছে গলদা, বাগদা ও কার্প জাতীয় মাছ যথাক্রমে ৯৮০, ৫৩২ এবং ৯৭০ কেজি যা পূর্বের উৎপাদনের দ্বিগুনেরও বেশী। শুধু উৎপাদন বৃদ্ধিই নয় তাদের আয়ও বেড়েছে। শুধু মাত্র বিগত বছরে উক্ত বিলে প্রায় ৫ কোটি টাকার অতিরিক্ত চিংড়ি ও দেশীয় প্রজাতীর মাছ উৎপাদিত হয়েছে। ক্লাস্টার পদ্ধতিতে মাছ চাষাবাদ করার ফলে চাষিরা আর্থিক ভাবে লাভবান হচ্ছেন, নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে, পারিবারিকপুষ্টির চাহিদা পূরনের পাশাপাশী ডুমুরিয়া অঞ্চলে দারিদ্র বিমোচনও ঘটছে। ফলে চিংড়ি চাষিদের মধ্যে নতুন প্রাণচাল্য সৃষ্টি হচ্ছে।
বড়ডাঙ্গা গ্রামের চাষিদের দেখা দেখি উপজেলার আরো প্রায় আট শতাধিক চাষি ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ শুরু করেছেন। ছয় জন নারী চিংড়ি চাষি ক্লাস্টার পদ্ধতির চিংড়ি চাষের প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষতা অর্জন করেছেন। বড়ডাঙ্গা ক্লাস্টার মডেলের রুপকার সুজিত মন্ডল বলেন, ‘তৎকালীন সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সরোজ কুমার মিস্ত্রী স্যারের পরামর্শে মাত্র ৬ জন চাষি নিয়ে আমরা শুরু করেছিলাম। এ পদ্ধতি অনেক লাভ জনক ও নিরাপদ হওয়ায় বর্তমানে বড়ডাঙ্গা বিলের ২২৮ জন চিংড়ি চাষি এ পদ্ধতি অনুসরণ করে চাষাবাদ করছেন। চাষের ক্ষেত্রে গুড এ্যাকুয়া কালচার প্রাকটিস ও ফুড সেফটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দল গত ভাবে চাষের উপকরণ সংগ্রহ, পোনা ক্রয়, খাদ্য তৈরী ইত্যাদি করার ফলে উৎপাদন খরচ বহুলাংশে কমেছে। তাছাড়া জৈব নিরাপত্তা বজায় রাখায় ঘেরে কোন রোগ বালাইয়ের আক্রমনও নেই।
বড়ডাঙ্গা চিংড়ি চাষী (সিআইজি) সমবায় সমিতির সদস্য সুভেন্দ্র জানান,ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চাষাবাদের ফলে জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে। একই জমিতে গলদা, বাগদা, রুই, কাতলা, পাশে, তেলাপিয়া ইত্যাদি মাছের চাষ এবং পাড়ে প্রচুর পরিমাণে সবজি চাষ করা হচ্ছে। আমাদের এ সকল ঘেরে নিষিদ্ধ কোন ঔষধ বা কীটনাশক ব্যবহার না করায় উৎপাদিত পণ্যের নিরাপদ তা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে। যার কারনে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে ঘেরের পণ্যের চাহিদা ও মূল্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
উল্লেখ,গত বছরের অক্টোবরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মোঃআশরাফ আলী খান ( খসরু ) এমপি, মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব রইছউল আলম মন্ডল, মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাজীশামস্ আফরোজ, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনষ্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ সহ উর্দ্ধতন কর্মকর্তা গণ বড়ডাঙ্গা চিংড়ি চাষী (সিআইজি) সমবায় সমিতির মডেল সরেজমিনে পরিদর্শন করেন । পরিদর্শন শেষে প্রতিমন্ত্রী সিআইজি প্রকল্পের প্রসংশা করেন এবং দেশে চিংড়ি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ক্লাস্টার পদ্ধতির চিংড়ি চাষের এই মডেল সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশনা প্রদান করেন। ক্লাস্টার পদ্ধতির এ মডেলের উদ্ভাবক সরোজ কুমার মিস্ত্রী বলেন, ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ পদ্ধতিটি নিরাপদ চিংড়ি উৎপাদন বৃদ্ধি, উপকূলীয় কৃষি ভিক্তিক অর্থনীতির উন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং এসডিজি অর্জনের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করা। দেশের প্রতিটি ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণ সম্ভব হলে চিংড়ি সেক্টরে ব্যাপক উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশী দেশের দক্ষিন উপকুলীয় অঞ্চলে ব্যাপক কর্মসংস্থানের দ্বার উন্মোচন হবে । পুনরায় অর্জিত হবে সাদা সোঁনার বৈদেশিক মুদ্রা ।