চরম সংকটে পড়া দেশের পোলট্রি শিল্পকে বাঁচাতে সরকারি সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি)। সংগঠণটিরর পক্ষ থেকে জানানো হয়, কোভিড-১৯ ভাইরাসের প্রভাবে দেশীয় পোল্ট্রি শিল্পে ২০ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ১৬ দিনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ১১৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে জানিয়েছে পোল্ট্রি শিল্পের কেন্দ্রিয় সংগঠন ‘বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাষ্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি)। সংগঠনটির পক্ষ বলা হয় বাজারে পোল্ট্রি পণ্যের দরপতন এবং উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করতে না পারার কারণে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন সাধারন খামারি থেকে শুরু করে শিল্প উদ্যোক্তারা। প্রতিদিনই এ পরিমান বাড়ছে। তাছাড়া চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এন্ড এনিমেল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত দেশের একমাত্র পিআরটিসি (PRTC) ল্যাবটি বন্ধ থাকায় বন্দর থেকে ছাড় করানো যাচ্ছেনা পোল্ট্রি শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল। এ অবস্থা চলতে থাকলে থমকে যেতে পারে দেশীয় পোল্ট্রি শিল্প।
এ সম্পর্কে বিপিআইসিসি’র সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, করোনা সতর্কতায় জনসমাগম ঠেকাতে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের কারণে পাইকারি বাজার থেকে শুরু করে খুচরা বাজার-হাটে ক্রেতা সাধারনের উপস্থিতি ব্যাপকমাত্রায় কমেছে। চাল-ডালের মত পণ্যের দর ক্ষেত্র বিশেষে বাড়লেও ব্যাপকহারে কমেছে ব্রয়লার মুরগি, একদিন বয়সী বাচ্চা ও ডিমের দাম। পোল্ট্রি ও ফিস ফিডের উৎপাদন প্রায় ৭০-৭৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার দাম মাত্র ১ টাকায় নেমে এসেছে, যেখানে উৎপাদন খরচ প্রায় ৩৫ টাকা। এছাড়া পোল্ট্রি প্রসেসড প্রোডাক্টস এর বিক্রি ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। কাজেই দেখা যাচ্ছে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে দেশীয় পোল্ট্রি শিল্পে ইতোমধ্যেই ভয়াবহ ধ্বস নেমেছে।
তিনি বলেন, “আমাদের প্রাথমিক হিসাব মতে আগামী ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ১১৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। যদি আরও এক সপ্তাহ এ অবস্থা চলতে থাকে তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ১৬৫০ কোটি টাকা ছাড়াবে। এরপরও যদি অবস্থার উন্নতি না হয় তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান দাঁড়াবে দৈনিক প্রায় ১০০ কোটি টাকা। তাছাড়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও মার্কেট স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে আরও অন্তত: এক মাস।”
বর্তমানে প্রতি পিস ডিম উৎপাদনে যেখানে খরচ হচ্ছে ৫.৫০ টাকা, সেখানে পাইকারী পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৪.২০ টাকা এছাড়াও অবিক্রিত থাকছে ২.৮০ কোটি ডিম; এক কেজি ব্রয়লার মুরগি উৎপাদনে যেখানে খরচ হচ্ছে ৯৫ টাকা সেটি পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা এবং দৈনিক অবিক্রিত থাকছে ৩০২৭ মেট্রিক টন; ৩৫ টাকা উৎপাদন খরচের একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে প্রতি পিস ১ টাকা এবং প্রতিদিন অবিক্রিত থাকছে ১ কোটি ৮৭ লাখ পিস; দৈনিক পোল্ট্রি ফিড উৎপাদন হচ্ছে ৯৮৬৩ মেট্রিক টন কিন্তু অবিক্রিত থাকছে ৬৯০৪ মেট্রিক টন।
ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বিএবি) সভাপতি রকিবুর রহমান টুটুল বলেন, ব্রিডার্স ও হ্যাচারি ইন্ডাষ্ট্রিতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান অন্তত: ৪৫৮ কোটি টাকা। ফিড ইন্ডাষ্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ফিআব) সভাপতি এহতেশাম বি. শাহজাহান জানান এ শিল্পে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ৭৫ কোটি টাকারও অধিক। এছাড়াও বিপিআইসিসি’র হিসাব মতে বাণিজ্যিক পোল্ট্রিতে (ডিম, মুরগির মাংস) ৫০৩ কোটি টাকা, প্রসেসড ইন্ডাষ্ট্রিতে৩১ কোটি টাকা এবং প্রাণি ঔষধ খাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান দাঁড়াবে অন্তত: ৮৩ কোটি টাকা।
৪ এপ্রিল পর্যন্ত ব্রিডার্স ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতি ৪৫৮ কোটি টাকা, ১ সপ্তাহ প্রলম্বিত হলে যার পরিমান দাড়াবে ৬৫৮ কোটি টাকায়; ফিড ইন্ডাস্ট্রির ৭৫ কোটি টাকা ১ সপ্তাহ প্রলম্বিত হলে যার পরিমান দাড়াবে ১০৮ কোটি টাকা; বাণিজ্যিক পোল্ট্রির (ডিম, মাংস) ক্ষতি ৫০৩ কোটি টাকা, ১ সপ্তাহ প্রলম্বিত হলে যার পরিমান দাড়াবে ৭২৩ কোটি টাকা; প্রসেসড ইন্ডাষ্ট্রির ক্ষতি ৩১ কোটি টাকা, ১ সপ্তাহ প্রলম্বিত হলে যার পরিমান দাড়াবে ৪৫ কোটি টাকা এবং ঔষধ, মিনারেল, প্রিমিক্স ইত্যাদিতে ক্ষতি ৮৩ টাকা এবং ১ সপ্তাহ প্রলম্বিত হলে যার পরিমান দাড়াবে ১১৯ কোটি টাকা।
পোল্ট্রি শিল্পকে ঘুরে দাঁড়াতে বিপিআইসিসি’র পক্ষ থেকে সরকারের কাছে যে সহায়তাগুলো চাওয়া হয়েছে তার মধ্যে আছে- (১) পোল্ট্রি শিল্পের প্রতিটি শাখা যেমন- নিবন্ধিত ব্রিডার ফার্ম ও হ্যাচারি, বাণিজ্যিক মুরগির খামার, ফিড মিল, ঔষধ প্রস্তুতকারক ও বাজারজাতকারি প্রতিষ্ঠান, কাঁচামাল সরবরাহকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকের সুদ আগামী ৬ মাসের জন্য মওকুফ; (২) বন্দরে আটকে পড়া কাঁচামালের কারণে যে পোর্ট ডেমারেজ জমা হচ্ছে তা পুরোপুরি মওকুফ; (৩) সাধারন মানুষের জন্য সরকার কর্তৃক ঘোষিত খাদ্য সহায়তার অংশ হিসেবে ডিম ও মুরগির মাংস বিতরণ; (৫) পোল্ট্রি’র সবগুলো খাতের জন্য ৩০% আর্থিক প্রণোদনা প্রদান; এবং (৬) ‘কোভিড-১৯’ বিষয়ক সচেতনতার অংশ হিসেবে সরকারি ও বেসরকারি গণমাধ্যমে ডিম, দুধ, মাছ, মাংসের ইতিবাচক প্রচারণা চালানো- যেহেতু এ ধরনের পুষ্টিকর ও প্রোটিন জাতীয় খাদ্য শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং সংক্রমণ প্রতিরোধেও কার্যকর।
সংগঠনটির পক্ষ থেকে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের বলিষ্ঠ পদক্ষেপের প্রশংসা করা হয় এবং সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে দেশকে জীবানুমুক্ত করা সম্ভব হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়।