ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা) : অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মান, চিংড়ি ঘের তৈরি, বনের গাছ কাটা ও নির্বিচারে মৎস্য আহরণ ইত্যাদি কারনে উপকূল এলাকায় প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়ছে। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় ও জ্বলোচ্ছ্বাসে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু, ঘর-বাড়ি, হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগল, প্রয়োজনীয় মালামাল, পুকুর, কৃষি জমিসহ জানমালের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি সাধিত হয়। সেই ভয়াল ঘুর্ণিঝর সিডর,আইলা.ফনি ও সর্বেশষ জলোচ্ছ্বাস বুলবুল উপকূলীয় খুলনা, সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় প্রায় ১০/১২টি জেলার এগার লাখ জেলে বাওয়ালী, মৌয়ালী পরিবার সর্বস্ব হারিযয়ে ফেলেছে। সম্প্রতি বুলবুলের আঘাত যেতে না যেতেই শুরু হয়েছে না দেখা ও অজানা আতংক করোনা ভাইরাসের মহামারী আক্রমন । আর এই করোনার ভয়াল মহামারি দুর্যোগে স্থবির হয়ে পড়েছে উপকুলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন চক্র । সুন্দরবন কেন্দ্রিক জীবিকা নির্বাহকারী জেলে, ভাওয়ালী, মাওয়ালী, মহিষচাষী ও ভূমিহীন, বিত্তহীন সাধারন গরীব মানুষ যারা এই বনকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করতো তারা করোনার ভাইরাস মহামারীর দুর্যোগে পরিবার পরিজনদের নিয়ে ক্ষুদার যন্ত্রনায় নিরবে কাঁদছে।
করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং এর ব্যাপক বিস্তার রোধকল্পে অধিকতর সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে সারাদেশে গত ২৬ মার্চ থেকে চলছে সাধারন ছুটি । ইতিমধ্যে সরকার কয়েক দফায় সাধারণ ছুটি বৃদ্ধি করে আগামী ৫ মে পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে । একদিকে করোনা ভাইরাস অন্যদিকে সুন্দরবনে মাছ ধরা নিষিদ্ধ হওয়ায় সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীলরা বিপাকে পড়ছে । সুন্দরবন–সংলগ্ন খুলনা জেলার কয়রা,পাইকগাছা,দাকোপ,সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, আশাশুনি উপজেলায় বসবারসত উপকূলীয় জনপদের প্রায় লক্ষাধিক মৎসজিবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। সরকার করোনা মোকাবেলায় সুন্দরবনে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করায় জেলেরা মৎস শিকারে এখন জঙ্গলের তীরবর্তী নদী ও খালে যেতে পারছেন না।
কভিড-১৯ এর কারনে মৎস্য ভান্ডার হিসেবে খ্যাত উপকূলীয় এলাকা সুন্দরবন চর পাটা ও ঝাঁকি জাল দিয়ে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সুন্দরবনের বিভিন্ন খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার রোধ এবং মাছের নিরাপদ প্রজনন ও সংরক্ষণ করতেই এই নিষেধাজ্ঞা নিশ্চিত করেছে সুন্দরবন বন বিভাগ। করোনায় ক্ষতিগ্রস্থ জেলে বাওয়ালীরা নিরাপদে সুন্দরবনে মাছ ধরতে পারলেও সেটি বন্ধ থাকায় তারাও পরিবার পরিজন নিয়ে পড়েছে মানবিক বিপর্যয়ে। অবিলম্বে পারমিট চালু করার দাবি জানিয়েছে সুন্দরবন কেন্দ্রীক বন ও মৎস আহরনের উপর নির্ভরশীলরা।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চারটি রেঞ্জ শরণখোলা, চাঁদপাই, খুলনা ও সাতক্ষীরা এলাকার ইতিমধ্যে ২৫ ফুটের নীচের প্রস্তের প্রায় চার শতাধিক খালকে নিষিদ্ধের তালিকায় নেওয়া হয়েছে। তবে ২৫ ফুটের অধিক প্রস্থের খাল ও বনের নদী এলাকা এ নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত থাকবে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।এ পরিস্থিতিতে চরম হতাশা আর উৎকন্ঠার মধ্যে রয়েছে উপকূলীয় অঞ্চলের হাজার হাজার জেলে ও বনজীবিরা।
বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, বনের মধ্যে দিয়ে ভোলা, বলেশ্বর, শ্যালা, পশুরসহ ১৩টি বড় নদ-নদী ও ৪৫০টি ছোট খাল প্রবাহিত হয়েছে। এ সব নদী ও খালে ২১০ প্রজাতির সাদামাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, ৪৩ প্রজাতির মালাস্কা ও লবস্টার পাওয় যায়। এ ছাড়াও রয়েছে বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির ইরাবতীসহ ছয় প্রজাতির ডলফিন। জুলাই ও আগস্ট মাস সুন্দরবনে মাছের প্রজনন মৌসুম। এ প্রজনন মৌসুমে সুন্দরবনের ছোট ছোট খালে মাছের আধিক্য বেশি থাকার সুযোগে এক শ্রেণীর অসাধু জেলে গোপনে ছোট খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করে থাকে। এ কারণে বনের মৎস্য ও অন্য জলজ প্রাণীর নিরাপদ প্রজনন ও সংরক্ষণসহ ও বিষ প্রয়োগ বন্ধে এ দু’মাস সুন্দরবনের অধিকাংশ খালে মাছ আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জ কর্মকর্তা (এসিএফ) মো. এনামুল হক বলেন, পাস-পারমিট নিতে আসা জেলেদের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি আগে থেকেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কভিড-১৯ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিতকরণে করোনার পর মাছ আহরণের জন্য জেলেদের সীমিত আকারে পাস-পারমিট দেওয়া হবে। সার্বক্ষণিক নজরদারিতে বনবিভাগের পাশাপাশি সুন্দরবন সহ ব্যবস্থাপনা কমিটি, সিপিজি, ভিটিআরটি, ওয়াইল্ড টিমের সদস্য নিয়োজিত থাকবে।