মোহাম্মদ তারেক সরকার: বিশ্বব্যাপী করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্ব অর্থনীতি এবং খাদ্য সংকট নিয়ে কম বেশি অনেক দেশই এখন গভীরভাবে চিন্তিত। প্রতিটি সেক্টর আজ সংক্রামক রোগ কোভিড-১৯ এর প্রেক্ষাপটে লকডাউনের কারণে নানামুখী ক্ষতির সম্মুখীন। উৎপাদনশীল কল কারখানা বন্ধ এবং কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য সেক্টরের উৎপাদনেও স্থবিরতা লক্ষণীয়। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রাণিজ আমিষ উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জন করেছে এবং জনগণকে কম দামে প্রোটিন সরবরাহ করা হচ্ছে। তথাপি বর্তমান পরিস্থিতিতে এ শিল্প কঠিন হুমকির মুখে পতিত, বিশেষত ১ মাসেরও অধিক সময় ধরে লকডাউনের কারণে নানা সমস্যা ও ক্ষতি ইতোমধ্যেই লক্ষ্য করা গেছে। এ লকডাউন আরো দীর্ঘায়িত হলে সেক্টরের ক্ষতি টেনে ধরা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
মৎস্যচাষিদের বর্তমান অবস্থা
যেসব চাষির পুকুরে মাছ রয়েছে অথচ বিক্রয় উপযোগি হলেও দাম কমে যাওয়ার কারণে সেগুলো এখন বিক্রি করতে পারছেনা। অন্যদিকে চাহিদাও কমে গেছে, যে কারণে চাষিরা রয়েছে ক্ষতির মুখে। বাজার দাম পতন ঘটলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে বাজার ব্যবস্থাপনা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বিক্রয় ব্যবস্থা এবং ক্রেতাদের বাজার বিমুখ করার প্রক্রিয়ায় চাষিরা কঠিন বিপাকে দিনাতিপাত করছেন।
প্রতি কেজি পাঙ্গাস, তেলাপিয়া, পাবদা, গুলশা, শিং এবং কার্পজাতীয় মাছ স্থানভেদে ৩৫-৫০ টাকা বা কোথাও আরো বেশি কমে গেছে। এ সময়ে পুকুরে মাছ মজুত করে রাখলে অতিরিক্ত খাবার এবং ব্যবস্থাপনাজনিত খরচ যেমন বাড়ছে তেমন মুনাফা হারিয়ে উৎপাদন খরচের নিচে নেমে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। একইসাথে পরবর্তী ‘চাষচক্র’ পিছিয়ে যাচ্ছে। এ সময়ে পুকুর খালি করতে না পারায় পরবর্তী চাষের পোনা মজুত করা যাচ্ছেনা, যা কীনা পরবর্তীতে মারাত্মক সংকট তৈরি করবে। এ কারণেই যথাসময়ে চাষিদের পোনা মজুত করা আবশ্যক। মাছ বিক্রয় করতে না পেরে চাষিদের বিনিয়োগের টাকাও এখন ঝুঁকির মুখে।
হ্যাচারিগুলোর অবস্থা
মাছ ও চিংড়ি হ্যাচারিগুলোর এখন ভরা মৌসুম। তেলাপিয়া হ্যাচারিগুলোতে এখন ‘পিক প্রোডাকশন’। তাছাড়া পাবদা, গুলশা, শিং, মাগুর প্রভৃতি মাছের পোনা উৎপাদন শুরু হয়েছে, বাগদা এবং গলদা হ্যাচারিগুলো উৎপাদনে রয়েছে। এ সময়ে উৎপাদিত পোনা যথাসময়ে বাজারজাত করা না গেলে হ্যাচারি মালিকদের লোকসানের অন্ত থাকবেনা। কেননা সব পোনা হ্যাচারিতে দীর্ঘসময় ধরে রাখা বা হ্যাচারিতে রেখে দেয়া সম্ভব না। তাছাড়া ‘পিক সিজন’ বা ‘ভরা মৌসুমে’ পোনা উৎপাদন না করলে বা যথার্থ সময় অতিক্রম করলে পরবর্তীতে পোনা উৎপাদন স্থবির হয়ে যায়। তাই উপযুক্ত সময়েই পোনা উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়। হ্যাচারিগুলো সারা বছর এ সময়টার দিকে তাকিয়ে থাকে এবং প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করে থাকে। এখন লকডাউনের সময় উৎপাদন চালিয়ে যেতে পারলেও বাস্তব অবস্থায় চাষিদের অনীহা, হতাশা ও বাজারজাত ব্যাহত হওয়ায় হ্যাচারিগুলো ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
রপ্তানিমুখী চিংড়ি শিল্পে ব্যাপক ক্ষতির আশংকা
বাংলাদেশে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে একমাত্র চিংড়ি শিল্প আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি বড় উৎস। ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও সম্ভাবনার এক দশমাংশ উৎপাদন ও রপ্তানি করতে না পারলেও এটিই আমাদের মৎস্য শিল্পের ‘সবে ধন নীল মনি’ হিসেবে বিবেচিত। এ শিল্পের সাথে জড়িত হ্যাচারি, চিংড়ি চাষি, খাদ্য ও প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহকারিরা নানাভাবে এখানে বিনয়োগ করে থাকেন। তদুপরি টাইগার শ্রিম্প বা বাগদা চিংড়ি চাষে নানা রোগের প্রাদুর্ভাবে প্রতিবছর এ সেক্টরে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এতসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই চিংড়ি শিল্পকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ বাগদা চিংড়ির তিনটি SPF (Specific Pathogen Free) হ্যাচারিসহ শতাধিক হ্যাচারি থাকলেও নানা কারণে সবক’টি হ্যাচারি উৎপাদনে না থাকলেও বর্তমানে ৩টি SPF হ্যাচারিসহ বেশকিছু হ্যাচারিতে বাগদা চিংড়ি পোনা উৎপাদন করছে। এমনিতেই হ্যাচারিগুলোর ব্রুড বা মা চিংড়ির ঘাটতিসহ নানা সমস্যায় উৎপাদন ব্যাহত হয়। ইতিমধ্যে হ্যাচারিগুলো বিপুল বিনিয়োগ করে উৎপাদনে গেলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাপক ক্ষতিসহ নানান চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এ অবস্থায় তাদের সহযোগিতা না করলে টিকে থাকা কঠিন হবে।
রপ্তানিমুখী বাগদা চিংড়ি চাষের জন্য আধা নিবিড়, উন্নত সনাতন ও সনাতন খামার রয়েছে। এসব খামারে এখনো প্রত্যাশিত মাত্রায় চিংড়ি উৎপাদন হচ্ছেনা। বিশেষত আধা নিবিড় চিংড়ি খামারগুলোকে ব্যাপক বিনিয়োগ করতে হয় এবং মূলত রপ্তানিকে লক্ষ্য রেখে ঝুঁকি নিয়ে তারা বিনিয়োগ করে। তদুপরি প্রতিবছর রোগের প্রাদুর্ভাবে প্রতিবছর অনেক খামারি ও উদ্যোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন। এবারেও বেশকিছু খামারে ইতিমধ্যে পোনা মজুত করেছে এবং অন্যরা পোনা মজুদের অপেক্ষায় আছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চিংড়ি রপ্তানির শিপমেন্ট বাতিল হয়েছে বলে ‘বাংলাদেশ হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক সমিতি’র সূত্রে জানা গেছে। এ সময় যারা চাষ প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত আছেন তারাও চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।
রপ্তানিযোগ্য চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ চাষে খাবার, প্রয়োজনীয় অ্যাকোয়া প্রোডাক্ট, ইকুইপমেন্ট বা সরঞ্জাম প্রভৃতির গুরুত্ব অপরিসীম। এসবের বিপণনের সাথে যুক্ত রয়েছে ফিশারিজ গ্র্যাজুয়েটসহ অনেক উচ্চ শিক্ষিত ও স্বল্প শিক্ষিত লোকবল। তারা তাদের পরিবারের ভরণ পোষনের দায়িত্ব পালনের সাথে জাতীয় অর্থনীতিতে ও মৎস্য সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। অথচ সাম্প্রতিক লকডাউনে তারা ঘরবন্দী। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যবসা বা সেবার জন্য কঠিনভাবে ব্যহত হলেও তাদের বেতন-ভাতার প্রচুর টাকা গুনতে হবে এসব পণ্য আমদানিকারক কোম্পানিগুলোকে। এক্ষেত্রে টাকার অংকে কোম্পানিগুলোর ক্ষতি নিরূপন না করে সঠিক তথ্য হয়তো দেয়া যাবেনা। তবে বিভিন্ন কোম্পানির মালিকগণ ইতিমধ্যে তাদের হতাশা ব্যাক্ত করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো মৎস্য সেক্টরে সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বিভিন্ন কোম্পানির ফিশারিজের গ্র্যাজুয়েটরা যে সেবা ও পরামর্শ দিয়ে আসছেন তা এ সময় ব্যহত হওয়ার কারণে চাষিরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এবং কারিগরি সেবা ও পরামর্শ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
মাছ ও চিংড়ির বিভিন্ন পণ্য, খাদ্য ও সরঞ্জামাদি আমদানি করতে হয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পরীক্ষা বা টেস্টে দীর্ঘ সময় ক্ষেপনে আমদানিকারকেরা মারাত্মকভাবে আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এবং চাষিরা ঠিকভাবে প্রয়োজনীয় পণ্য পাচ্ছেননা।
এ সময়ে করণীয়
- মাছ চাষিদের রক্ষা করতে ত্রাণের অংশ হিসেবে পাঙ্গাস, তেলাপিয়া প্রভূতি মাছ চাষিদের নিকট থেকে ক্রয় করে দরিদ্রদের বিতরণ করলে চাষিরা বাঁচবে এবং দরিদ্র মানুষ পুষ্টি পাবে।
- তালিকাভুক্ত চাষিদের যাচাই করে সরকার ঘোষিত সর্বনিম্ন হারে ব্যাংক ঋণ দেয়া আবশ্যক।
- মাছের হ্যাচারিগুলোকে উৎপাদন ক্ষতি কাটিয়ে ভবিষ্যতে পোনা উৎপাদন অব্যাহত রাখতে মৎস্য অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত হ্যাচারিগুলোকে সর্বনিম্ন ব্যাংক সুদে (৪%) ঋণ দেয়া আবশ্যক।
- চিংড়ি চাষি বিশেষ করে তালিকাভুক্ত চিংড়ি চাষিদের স্বল্প সুদে (৪%) ব্যাংক ঋণ দেয়া হোক।
- চিংড়ি হ্যাচারি এবং বিশেষত এসপিএফ হ্যাচারিগুলোকে ৪% হারে ব্যাংক ঋণ দেয়া হোক।
- এসপিএফ হ্যাচারিগুলোকে আমদানির ক্ষেত্রে যে ট্যাক্স রয়েছে তা আগামী ৫ বছরের জন্য স্থগিত বা বাতিল করা হোক। যেহেতু এখনো অবকাঠামোগত সুবিধা এবং পর্যাপ্ত ব্রুড সরবরাহ বা উৎপাদন নিশ্চিত হয়নি, এ কারণে রপ্তানিমুখী এ শিল্পকে বিশেষ প্রণোদনা হিসেবে ট্যাক্স মুওকুফ করা হোক।
- চিংড়ি হ্যাচারিগুলোর জন্য Life Food, অন্যান্য খাবার, যন্ত্রপাতি আমদানিতে ট্যাক্স মওকুফ করা হোক।
- SPF ছাড়া অন্যান্য বাগদা হ্যাচারিগুলো ব্রুড সংকট দূরীকরণে ৬৫ দিন সাগরে মাছ ধরা নিষেধাজ্ঞা পূণঃ বিবেচনা করা হোক। এতে হ্যাচারিগুলো ব্রুড সংকট নিরসন করতে পারবে।
- মৎস্য-চিংড়ি শিল্পের সহায়ক হিসেবে অ্যাকোয়া প্রোডাক্ট আমদানিকারকদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। বর্তমানে স্থবিরতায় এবং লকডাউনে এসব কোম্পানিগুলো তাদের কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের মাঠ পর্যায়ে পাঠাতে পারছেনা। অথচ বিশাল অংকের বেতন পরিশোধ করতে হবে। ব্যবসা বন্ধ থাকলেও বেতন চলমান রয়েছে। এক্ষেত্রে মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক নিবন্ধিত অ্যাকোয়া প্রোডাক্ট আমদানিকারক কোম্পানিগুলোকে অন্ততপক্ষে আগামী ৩ বছরের জন্য ৪% হারে ব্যাংক ঋণ সুবিধা দেয়া আবশ্যক।
- রপ্তানি খাত চিংড়ি শিল্পকে ধরে রাখতে হলে চিংড়ি হ্যাচারি, চাষি, ইনপুট সাপ্লায়ার (প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহকারি), রপ্তানিকারক এদের সবাই একইসাথে প্রণোদনায় অন্তর্ভুক্ত করলে সাপ্লাই চেইন এবং সেক্টর রক্ষা পাবে।
- বন্দরে আটকে পড়া জরুরি পণ্য দ্রুত ছাড়করণের ব্যবস্থা নেয়া হোক। পণ্য পরীক্ষার জন্য পিআরটিসি ল্যাবে বেশি চাপ পড়ার কারণে রিপোর্ট পেতে সময় লাগে। এক্ষেত্রে চট্টগ্রামস্থ মৎস্য বিভাগের FIQC ল্যাবেও পরীক্ষা করলে জটিলতা কমে আসবে।
- রপ্তানিযোগ্য চিংড়ি চাষে আধা নিবিড় খামারগুলোকে শতভাগ খাবার আমদানি নির্ভর। এসব খাবার বাংলাদেশে তৈরি হয়না বিধার এর আমদানি সহজীকরণ এবং জটিলতা নিরসন এখন সময়ের দাবী।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ অ্যাকোয়া প্রোডাক্টস কোম্পানিজ এসোসিয়েশন (বাপকা)।