আবু জাফর আহমেদ মুকুল১, মো. ফখরুল ইসলাম হিমেল২ : বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের প্রার্দুভাবে জনগনের প্রতিদিনের স্বাভাবিক কর্মজীবন বিপর্যস্ত। অর্থনৈতিক স্থবিরতার প্রভাবে দেখা যাচ্ছে কর্মহীনতা ও দারিদ্র্য। বিবিএস-২০১৯ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ২১.৮ শতাংশ অর্থাৎ তিন কোটি ২৮ লাখ মানুষ দরিদ্র এবং হতদরিদ্র ১ কোটি ৬৮ লাখ । দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। এরা সবাই দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল। তা ছাড়া কমবেশি ১০ কোটি মানুষ মধ্যবিত্ত। অর্থনৈতিক কর্মকান্ড- বেশিদিন বন্ধ থাকায় এরা সবাই সংকটে পড়ছে। মজুদ পর্যাপ্ত থাকলেও মধ্যবিত্ত পরিবার ক্রয়ক্ষমতা হারাবে। তাই এরাসহ স্বল্প পেনশন ভোগী কর্মচারী, নিম্নআয়ের পেশাজীবী, প্রান্তিক কৃষক ইত্যাদি শ্রেণিপেশার মানুষের ক্রয়ক্ষমতা সংরক্ষণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১ লাখ হাজার কোটি টাকার করোনাকালীন সময়ে বাজেট দিয়েছেন যা সকল মহলে প্রশংসীত হয়েছে। প্রণোদনার একটি অংশের টাকা ও উপহার সামগ্রী জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে গরীব মানুষদের বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। খাদ্যদ্রব্য পর্যাপ্ত থাকলেও সেগুলো বিতরণ বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই ত্রাণ চুরি ও লুটপাটে ব্যস্ত। ইতোমধ্যে অনেক জনপ্রতিনিধিদের এজন্য বরখাস্ত করা হয়েছে এবং সরকারি চাল বেশি দামে বাজারে বিক্রির অভিযোগে বিভিন্ন জনকে আটক করা হয়েছে। এ ছাড়া করোনায় কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ারও আশঙ্কা আছে। এ জন্য কৃষিতে মনোযোগ বাড়ানোর পাশাপাশি ত্রাণ বিতরণে স্বচ্ছতা প্রয়োজন। ফলে সংকট মোকাবিলায় স্থানীয় পর্যায়ে সরকারের আর্থিক ও ব্যবস্থাপনার পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িঁয়েছে।
গত ২১ এপ্রিল, ২০২০ইং জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ডব্লিউএফপি) জানায়, পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে পর্যটন বন্ধ হয়ে যাওয়া, রেমিট্যান্সে ধস, ভ্রমণ এবং অন্যান্য কার্যক্রমে নানা বিধিনিষেধের ফলে সৃষ্ট অভিঘাত চলতি বছর বিশ্বব্যাপী নতুন করে আরও ১৩ কোটি মানুষকে তীব্র ক্ষুর্ধাতের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করবে। দেশের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গর্ভনেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জরিপে বলা হয়, করোনার প্রাদুর্ভাবে দেশের ৭০ শতাংশ দরিদ্র মানুষের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া নতুন করে দরিদ্র হতে পারে আরও ২০ শতাংশ মানুষ। ১৬ এপ্রিল, ২০২০ইং প্রতিষ্ঠান দুটি তাদের জরিপের এ ফল প্রকাশ করে। সুতরাং বিশাল জনগোষ্ঠীকে ত্রাণের আওতায় আনার জন্য দেশে ডিজিটাল ত্রাণ ব্যবস্থাপনার কোন বিকল্প নেই।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, গত ২৭ এপ্রিল, ২০২০ইং পর্যন্ত বাংলাদেশে সকল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের মাধ্যমে করোনাকালীন সময়ে বিশেষ বরাদ্দ হিসেবে সর্বমোট চাল বরাদ্দ হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার সাতষট্রি মেট্রিকটন এবং নগদ টাকা ১১৬ কোটি ৩১ লাখ টাকা বিতরন করা হয়েছে। সর্বোপরি ১ কোটি ২৫ লাখ পরিবার তথা ৫ কোটি মানুষকে ত্রাণের আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু অনেকে ক্ষেত্রে দরিদ্র ও নিম্নবৃত্তদের ত্রাণের জন্য কোন ডিজিটাল কার্ড না থাকায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি যেমন-মেম্বার ও চেয়ারম্যানগন এ সকল জনগনকে বঞ্জিত করেছেন বলে সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি। এটা স্থানীয় জন প্রতিনিধির সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাব এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান রয়েছে। অনেকক্ষেত্রে দেখা গেছে, প্রকৃত দরিদ্র ও নিম্নবৃত্ত মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়ায় স্থানীয় প্রতিনিধিরা ইচ্ছামত ত্রাণ বিতরন করে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন এবং জাতীয় পরিচয়পত্রে সুবিধাভোগীদের পেশা না থাকায় বা যাদের জাতীয় পরিচয় পত্র নেই অথবা ১৮ বছরের নীচে তারা নিম্ন আয়ের পেশাজীবি হলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ তার নিজের আত্নীয়স্বজন ও পরিচিতদের বিতরন করে স্থানীয় ত্রাণ কমিটিকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন যা খুবই দুঃখজনক বিষয়। সুতরাং ডিজিটাল বাংলাদেশে বর্তমান এ পরিস্থিতিতে স্থানীয় পর্যায়ে দরিদ্র ও নিম্নআয়ের মানুষদের মাঝে ত্রাণ বিতরণে স্বচ্ছতার জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত-
১. যাদের স্মার্ট কার্ড আছে তাদেরকে কার্ড রিডার সংযুক্ত করে ত্রাণ কার্যক্রমকে সেন্ট্রাল ডিজিটালইজড ডেটাবেজ তৈরি করা।
২. যাদের স্মার্ট কার্ড নাই কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র আছে প্রয়োজনীয় ডিজিটাল ইজড ডেটাবেজ করা।
৩. অপরটি হলো যাদের কোন ধরনের জাতীয় পরিচয় পত্র নেই অথবা ১৮ বছরের নীচে তাদের সহায়তার প্রয়োজন তাদের তথ্য ডিজিটালইজড করা।
৪. নতুন করে নিম্ন আয়ের পেশাজীবি অর্ন্তভুক্ত করার ক্ষেত্রে যারা সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা যেমন- টিআর, জিআর, ডিজিএফ, কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা), কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) এখন পর্যন্ত এর বাইরে রয়েছেন। তাদেরকে তথ্যসমূহ যাচাইপূর্বক ডিজিটালইজড ডেটাবেজ করা। একজন ব্যক্তির সকল ধরনের ত্রাণের সুবিধাগুলো সমন্বয় করা।
৫. ত্রাণের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার নিশ্চিতকরনের জন্য স্থানীয়ভাবে প্রতিটি ওয়ার্ডে জনপ্রতিনিধিগণ সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, প্রশাসন ও সুশীল সমাজের অংশগ্রহন একটি কমিটি গঠন করে স্থানীয় ত্রাণ বিতরনের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে।
৬. বর্তমান করোনাকালীন সময়ে ত্রাণ বিতরন কার্যক্রম সরাসরি পুলিশের মাধ্যমে প্রদান করা।
৭. ত্রাণ ব্যবস্থাপনার ডেটাবেজ করার জন্য উপজেলা কৃষি অফিসার, সমাজ কল্যান কর্মকতা, শিক্ষা অফিসার ও পরিসংখ্যান কর্মকর্তা এবং ত্রাণ কমিটির প্রয়োজনীয় সাহায্য নেওয়া ।
৮. নির্বাচন কমিশনের উচিত-বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের সাহায্য/উপজেলা প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রে সকলের পেশা উল্লেখ করা। যার ফলে একজন নাগরিকের বিভিন্ন সরকারি সুযোগ সুবিধা পেতে সাহায্য হয়।
৯. এছাড়াও মানবিক সহায়তা এবং খাদ্য বিতরণ কার্যক্রমে দ্রুততা, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সেন্ট্রাল ডাটাবেজ তৈরির জন্য কিউ আর কোড পদ্ধতি ব্যবহার করে স্থানীয় পর্যায়ে কর্মহীন মানুষদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দরিদ্র ও নিম্নআয়ের মানুষদের মাঝে মানবিক সহায়তা বিতরণ করা যেতে পারে। ইতোমধ্যে এই পদক্ষেপটি মাননীয় আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক তার নির্বাচনী আসনে বাস্তবায়ন করেছেন যা সকল মহলে প্রশংসিত হয়েছে।
আশা করি, উপরোক্ত পদক্ষেপগুলো স্থানীয়ভাবে বাস্তবায়ন করলে বর্তমানে করোনাকালীন সময়ে ত্রাণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ফিরে আসবে এবং সময় স্বল্প হলেও এটা এখনই করা সম্ভব। তবে ভবিষ্যতে দীর্ঘ মেয়াদে ত্রাণ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ডিজিটাল রেশন কার্ডের প্রচলন করতে হবে যা কেবল আগের উল্লেখিত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করলে এ কাজটি অধিক সহজতর হবে। তবে রেশন কার্ডে অবশ্যই সুবিধাভোগীর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যেমন-নাম, পিতার নাম, হেড অব ফ্যামিলি, পেশা, বয়স, ব্যক্তি ও পরিবারের আয়, ডিলারের নাম ও ঠিকানা সন্নিবেশিত থাকবে। এই কার্ডের ফলে ত্রাণ সহায়তার পাশাপাশি কৃষকের কৃষি ভতুর্কীর টাকা পেতে সাহায্য করবে অর্থাৎ একটি কার্ড দিয়ে সকল ধরনের সাহায্য মিলবে। আর ডিজিটাল রেশন কার্ডে যেহেতু কিউ আর কোডের থাকবে তাই এর স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।
আশা করি, বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকগন উল্লেখিত বিষয়সমূহ বিবেচনা করে বর্তমান করোনাকালীন সময়ে স্থানীয় পর্যায়ে ডিজিটাল ত্রাণ ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশের নিম্ন আয়ের মানুষের পাশে দাড়াঁবেন এবং বাংলাদেশে ত্রাণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতার জন্য অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন।
লেখকবৃন্দ: ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।