শনিবার , নভেম্বর ১৬ ২০২৪

লিচুর বাম্পার ফলন পেতে করণীয়

কৃষিবিদ ড. এম এ মজিদ মন্ডল : দক্ষিণ-পূব এশিয়ার ফলসমুহের মধ্যে লিচু অন্যতম। লিচু সাধারনত উষ্ণ ও অবউষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলের স্বার্থকভাবে জন্মে। চীনের দক্ষিণ অঞ্চলে লিচুর উৎপত্তিস্থল বলে ধারণা করা হয় তবে বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহামহাদেশে লিচু সবচেয়ে জনপ্রিয় ফল কারন এ ফল বৈচিএ্যপূর্ণ ব্যবহার, পুষ্টিমান ও স্বাদে-গন্বেধ অতুলনীয়। বাংলাদেশে প্রায় সব অঞ্চলে লিচু জন্মে কিন্তু দেশের উরাঞ্চলে (বিশেষ করে বৃহত্তর রাজশাহী, দিনাজ পুর, রং পুর, পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর প্রভৃতি অঞ্চলে) এর বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক চাষ হয়ে থাকে। লিচু চাষীরা প্রতি বছর অনেক ক্ষতির শিকার হয়ে থাকেন সাধারনত দুই প্রকারের সমস্যার কারণে-

১. প্রাকৃতিক কারণ (যেমন- ঝড়, শিলাবৃষ্টি, খরা প্রভৃতি), এবং

২. রোগ ও পোকামাকড় দ্বারা আক্রান্ত হয়ে। সঠিক পরিচর্চা ও রোগ-পোকামাকড় দমন করে প্রথম ক্ষতি আংশিক এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় ক্ষতি প্রায় সপূর্ণ রুপে সমাধান করা সম্ভব। নিচে এসব ব্যাপারে পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হলো

ফল না ধরা ঝরে পড়ার কারণসমূহ

১. লিচু গাছে সাধারনত এক বছর বেশি ধরে এবং পরের বছর কম ধরে ( একে অল্টারনেট বিয়ারিং বলে)।

২. কৌলিক গঠন,

৩. গর্ভমুন্ডে নিম্ন পরাহহীনতা,

৪. বর্ধিত ভ্রুণের পুষ্টিহীনতা,

৫. একই ছড়ায় অনেক গুলি ফল ধারন,

৬. সুষম পুষ্টির অভাব,

৭. প্রবল ঝড়,

৮. শিলাবৃষ্টি,

৯. দীঘ সময় খরা,

১০. মাটিতে রসের অভাব,

১১. হরমোনের অসাম্যতা,

১২. রোগ ও

১৩. পোকা-মাকড়ের অক্রমণ ইত্যাদি।

ফলন্ত লিচু গাছের যত্ন পরিচর্যা ফর ঝরা রোধ করণ

১. সুষম সারের ব্যবহার করতে হবে। একটি ৫- ১০ বছরের লিচু গাছে জৈব সার ২৫-৪০ কেজি, ইউরিয়া ৬০০ গ্রাম, টি.এস.পি ৫০০ গ্রাম, এম.পি ২৫০ গ্রাম মিশ্রণ করে তিন ভাগে ভাগ করে প্রতি বছর তিন বার প্রয়োগ করতে হবে ( ফেব্রুয়ারী, মে ও আগষ্ট মাসে )। দুপুর বেলা গাছের ছায়া যতটুকু স্থানে পড়ে সেটুকু স্থানে মাটি কোপায়ে আলগা করে সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছে যদি জিংকের অভাব দেখা যায়, অথাৎ পাতা যদি তামাটে রং ধারন করে তবে প্রতি বছর ৫০০ লিটার পানিতে ২ কেজি জলান্বিত চুন ও ৪ কেজি জিংক সালফেট গুলিয়ে বসন্তকালে গাছে ছিটাতে হবে। তবে উপরে উল্লিখিত সারগুলি গাছের বয়স ৫ বছরের নীচে হলে উহার অর্ধেক এবং গাছের বয়স ১০ বছরের বেশী হলে উহার দেড়গুণ সার প্রয়োগ করতে হবে।

২. খরা মৌসুমে গাছে সেচ দিতে হবে। মাটির ধরন অনুসারে খরার সময় ১০-১৫ দিন পর পর সেচ দিতে হবে।

৩. লিচুর বাগান আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। লিচুর শিকড় গভীর ভাবে আমের মত মাটির নীচে প্রবেশ করে না তাই বছরে ৩-৪ বার অগভীর ভাবে চাষ দিলে ভাল হয়।

৪. গাছের গোড়ায় গরু-মহিষ বাঁধানো বা মানুষ চলাচলের পথ রাখা যাবে না।

৫. ফল খুব ছোট থাকা অবস্থায় প্রতি ৪.৫ লিটার পানিতে ১ মিলি প্লানোফিক্স এক/ দুই বার সেপ্র করলে ফল ঝরা বন্দ্ব হয়।

৬. জিংক সালফেট দ্রবণের সাথে ২,৪-ডি (১৫ পিপিএম) স্প্রে করে ফল ঝরা কমানো যায়।

পোকা দমন

লিচুর মাইটস

এটি লিচুর জন্য সব চেয়ে ক্ষতিকারক মাকড় এর কারনে লিচুর ফলন শুন্যে কাছাকাছি আসতে পারে।

লক্ষণসমুহ

ক.  অতি ক্ষুদ্র সাদা রং এর মাইট পাতার পিছনে বাদামি ভেলভেট তৈরী করে বসবাস করে।

খ. এতে পাতা পুরু হয়, দুমড়িয়ে থাকে এবং মারা যায়।

গ. এরা পাতা নীচের দিকে ভক্ষণ করে।

ঘ. সাধারণত মার্চ- জুলাই মাসে এদের আক্রমন বেশী দেখা যায়।

দমন ব্যবস্থা

১. সালফার (গন্দ্বক) চুর্ণ প্রয়োগ করে এ মাকড় দমন করা যায়।

২. গাছে নুতন পাতা বের হওয়ার সাথে সাথে কেলথেইন ০.১২ % হারে তিন সপ্তাহ পর পর ২-৩ বার% স্প্রে করতে হবে অথবা ডাইমেথোয়েট ০.০৫ % হারে ব্যবহার করা যেতে পারে। (৩) মেটাসিস্টক্্র ০.২ % হারে ব্যবহার করেও উকার পাওয়া যায়।

বাকল খেকো পোকা

লক্ষণসমুহ

ক. মে-জুন মাসে পূর্ণ বয়স্ক প্রজাপতি গাছের বাকলে ডিম পাড়ে।

খ. ডিম ফুটে লার্ভা বের হয় এবং এগুলি বাকল ভক্ষণ করে, পরে কান্ড ছিদ্র করে।

গ. আক্রান্ত ডাল দুর্বল হয় এবং ফল ঝরে পড়ে।

দমন ব্যবস্থা

১. বাগান পরিস্কার পরিছন্ন রাখতে হবে।

২. ডালের ছিদ্র দিয়ে পেট্টোল ঢেলে বা ফরমালিন ঢেলে এবং পরে মাটি বা মোম দিয়ে গর্তের মুখ বন্দ্ব করে দিতে হবে।

লিচুর বীজ ছিদ্রকারী পোকা

ক্ষতির প্রকৃতি

ক. এ পোকার ক্ষুদ্র কীট ফলের বোটার প্রান্ত দিয়ে বীজের মধ্যে প্রবেশ করে।

খ. এর আক্রমনের ফলে এক ধরনের বাদামী গুড়া ( পিপিলিকার মাটির মত) দেখতে পাওয়া যায়।

গ. পাকা ফল ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে খাওয়ার অযোগ্য হয় এবং বাজার মুল্য কমে যায়।

ঘ. ফল পাকার সময় মেঘলা আকাশ ও বৃষ্টিপাত হলে এ পোকার আক্রমন বেশী হয়।

দমন ব্যবস্থা

১. ফল সংগ্র করার পর অবশিটাংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।

২. বাগান আগাছা মুক্ত রাখতে হবে এবং ঝোপ-ঝাড় রাখা যাবে না।

৩. এ পোকার আক্রমন হয়ে গেলে ডাইমেক্রম ১ মিলি প্রতি লিটার (১ লিটার পানিতে) মিশে অথবা ম্যালাথিয়ন ০.১ % হারে পানিতে মিশে ফল পুষ্ট হবার ১৫ দিন পূবে স্প্রে করতে হবে।

বাদুড় দমন

পোকা-মাকড় ছাড়াও লিচুর অন্যতম আপদ হল বাদুড়। প্রতি বছর এদের আক্রমনে প্রচুর পরিমান ফল নষ্ট হয়। এরা ফল পাকা শুরু হলে সাধারনত রাতে ডালে ডালে ঝুলে পাকা ফল খেতে থাকে। বর্তমানে বাদুড়ের মাধ্যমে অনেক প্রকার রোগ ছড়িয়ে পড়তেছে, যেমন- নিপা ভাইরাস। তাই বাদুড় তাড়িয়ে ফল রক্ষা ও রোগ থেকে মুক্তি ব্যবস্থা করা অতি প্রয়োজন।

দমন ব্যবস্থা

লিচু পাকার সময় ফল রক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের দেশে প্রচলিত ও সহজ উপায়সমুহ হলো-

১. ঢোল ও টিন পিটানো,

২. ফাঁটা বাঁশ ফোটানো,

৩. পটকা ফোটানো,

৪. বাগানের চার পার্শ্বে জা পেতে,

৫. জাল দিয়ে ফল গাছ ঢেকে রেখে ইত্যাদি।

রোগ দমন

ফল পচা রোগ

এ রোগ  এক প্রকার ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে।

রোগের লক্ষণসমুহ

ক. প্রথমে ফলের উপর ছিটা ছিটা দাগ পড়ে।

খ. উক্ত দাগ একএ হয়ে বঢ় আকার ধারন করে এবং কালো বর্ণ ধারন করে।

গ. ফল শুকিয়ে যায় এবং এক পর্যায়ে ঝরে পড়ে।

দমন ব্যবস্থা

১. শুকনো ডালপালা বা অবশিটাংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।

২. ফলে বোর্দোমিক্্রার ও ডাইথেন এম-৪৫ প্রয়োগ করতে হবে।

লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও আঞ্চলকি প্রধান, বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (বারটান), রাজশাহী বিভাগীয় আঞ্চলিক কেন্দ্র, সিরাজগঞ্জ।

This post has already been read 4747 times!

Check Also

জলঢাকায় সোনালী ধানের শীষে দুলছে কৃষকের স্বপ্ন

বিধান চন্দ্র রায় (নীলফামারী) : নীলফামারীর জলঢাকায় মাঠের যে দিকে চোখ যায়, সেদিকেই সবুজের সমারোহ। …