ফকির শহিদুল ইসলাম(খুলনা) : করোনা ভাইরাসের মধ্যেই ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাব নিয়ে সংকটে পড়েছেন উপকূলীয় জেলা খুলনা,বাগেরহাট,সাতক্ষীরার মানুষ । ঝড়ের আগাম বার্তা পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই কর্মহীন এসব মানুষ যেন অজানা আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা মধ্যে পড়েছেন উপকূলীয় জেলার মানুষ ,। তারা নিরাপদ আশ্রয় কিংবা জীবন বাঁচানোর চিন্তা না করে তারা নিজেদের বসতঘর আর সম্পদ রক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।ঝড়ে না জানি কি হয়, এমন চিন্তা তাদের চোখ-মুখে। এদিকে ঝড় মোকাবিলায় ৩টি ধাপে প্রস্তুতি নিয়েছে জেলা প্রশাসন। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের আঘাতের পূর্বে ঝড়ের সময় এবং ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে করণীয় বিষয়ে খুলনা,বাগেরহাট,সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে ।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ এবং চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৪ থেকে ৫ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় আম্ফান অতিক্রমকালে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণসহ ঘণ্টায় ১৪০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাটের অধিকাংশ বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় আতংকে আশ্রয় কেন্দ্রে যাচ্ছেন সাধারন মানুষ । সংশ্লিষ্ঠ জেলা প্রশাসন করোনা স্বাস্থ বিধি ও সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে কেন্দ্রে অবস্থান নিতে বলা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’ আজ মঙ্গলবার কিংবা বুধবার রাতে দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে আঘাত হানতে পারে- এমন খবরে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে খুলনার ৩৪৯টি আশ্রয়কেন্দ্রের পাশাপাশি উপকূলীয় এলাকার সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছে। সতর্ক করে উপকূলের বিভিন্ন স্থানে চলছে মাইকিং। সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে রয়েছেন খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা,সাতক্ষীরার শ্যামনগর,আশাশুনি,বাগেরহাটের মোরলগঞ্জ,শরনখোলা,রামপাল,মংলা উপজেলার বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ এলাকায় অবস্থান করা মানুষজন। তারা আশঙ্কা করছেন, ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’ আঘাত হানলে গ্রামের বেড়িবাঁধটি ভেঙে যাবে। এতে লোনাপানিতে পুরো এলাকা ভেসে যাবে। এদিকে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে ঘূর্ণিঝড়ে দুই লাখ ৩৮ হাজার ৯৫০ জনকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনতে এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া জেলা-উপজেলায় পর্যায়ে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। এরই মধ্যে উপকূলবাসীকে সতর্ক করতে মাইকিং শুরু হয়েছে।
খুলনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’ মোকাবিলায় সকল প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। করোনার মধ্যে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে আশ্রয়কেন্দ্রের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগানো হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতি এড়াতে রেডক্রিসেন্ট, সিপিপিসহ দুই হাজার ৪৬০ জন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন। বেসরকারি এনজিওর রয়েছে আরও ১১০০ স্বেচ্ছাসেবক। এরই মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। সেখানে প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’ এ পর্যন্ত বাংলাদেশের দিকে ৪৫ কিলোমিটার এগিয়েছে। তবে ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রে বাতাসের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। আরও শক্তিশালী হয়ে কলকাতা ঘেঁষে সুন্দরবনের উপকূলীয় অঞ্চলের দিকে ধেয়ে আসছে।
অপরদিকে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাব মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে উপকূলীয় জেলা বাগেরহাট। এরই মধ্যে জরুরি সভা করেছে দুর্যোগ প্রস্তুতি কমিটি জেলা। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঝুঁকি এড়াতে আশ্রয় কেন্দ্র গুলোতেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে স্থানীয় লোকজন যাতে থাকতে পারে সেজন্য বাহেরহাট জেলার ৩৪৫টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র ছাড়াও স্ব স্ব উপজেলার স্কুল ও কলেজগুলো খুলে রাখার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি ও শুকনা খাবার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
বাগেরহাটের সুযোগ্য জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ জানান, ‘মহামারি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আম্পান দুর্যোগ মোকাবেলায় ইতোমধ্যেই জরুরী সভা হয়েছে। জেলা ও উপজেলাগুলোতে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। মাঠে থাকা বোরো ধান দ্রত কেটে ঘরে তুলতে কৃষি বিভাগকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঝুকি এড়িয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে থাকার মতো করে ৩৪৫টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পর্যাপ্ত আশ্রয়ের সুবিধার্খে সংশ্লিষ্ট উপজেলার স্কুল ও কলেজগুলো খুলে রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি রাখতে বলা হয়েছে।
বাগেরহাটের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক রঘুনাথ কর জানান, চলতি মৌসুমে বাগেরহাট জেলায় ৫২ হাজার ৯৩০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। চারটি কম্বাইন্ড হারভেস্টার, ৯৭টি রিপার, হ্যান্ড রিপার এবং স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় ইতোমধ্যে মাঠের ৮৫ ভাগ ধান কেটে ঘরে তোলা সম্ভব হয়েছে।এদিকে ৫০টি আশ্রয়নকেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে।এদিকে বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান মোকাবেলায় আগাম প্রস্তুতিমূলক এক জরুরী সভাও করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় কচুয়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহন করা হয়েছে ।
সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৫০টি আশ্রয়কেন্দ্র সচল রাখা হয়েছে,পরিস্কার করা হচ্ছে বাথরুম সহ ব্যবহারের স্থান। প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে ইউনিয়ন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের। দুর্যোগ মুহূর্তে একেকটি আশ্রয়কেন্দ্রে গড়ে ২০০জন করে আশ্রয় নেওয়ার ধারণা করে মানুষের খাদ্য সরবরাহের জন্য চিড়া, গুড়, পানিসহ মোমবাতি ও দিয়াশলাই মজুদ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পাশাপাশি করোনার এই দুর্যোগে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্ত হয়।
এছাড়া মাঠের রবিশস্য সংরক্ষণেও কৃষি বিভাগকে সতর্ক নজরদারি রাখকে বলা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কক্ষে নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে এ সভার সিদ্ধান্ত গুলি যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে দিক নির্দেশনা দেয়া হয়। সভায়, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ নাহিদুজ্জামান খাঁনসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস, রাজনৈতিক দলের নেতা, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক ও এনজিও কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ঘুর্ণিঝড় আম্ফান মোকাবেলায় আমরা প্রস্তুত রয়েছি, ৫০টি আশ্রয়নকেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। এছাড়া জরুরী প্রয়োজনে আরো ১৪টি আশ্রয়নকেন্দ্রে সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। আশ্রয়নকেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিদের দেখভালের জন্য প্রতিটি ইউনিয়নে স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের খুলনা বিভাগীয় দপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোঃ আবুল হোসেন জানান,ঘূর্ণিঝড় আম্পান মোকাবেলায় আমাদের সর্বাত্বক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে । কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে এই ঘূর্ণিঝড় সৃষ্ট হওয়ায় সব ধরনের স্বাস্থ্য বিধি মেনে লোকজনদের আশ্রয়কেন্দ্রে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে । খুলনা,বাগেরহাট,সাতক্ষীরার প্রতিটি ডিভিশনে কন্টোল রুম খোলা হয়েছে ও স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সম্মন্বয় করে আমাদের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বেড়িবাঁধ এলাকায় অবস্থান করছে । ঝুঁকিপূর্ন বাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ হলে তাৎক্ষনিক মেরামতের প্রস্তুতিও রয়েছে । ইতিমধ্যে আমাদের পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের নির্দশনায় সকল ছুটি বাতিল করা হয়েছে । আমাদের উপকুলীয় অঞ্চলের বাঁধ মোটামুটি ঝুঁকিমুক্ত রয়েছে । শরনখোলার বগি এলাকায় যে বাঁধ সম্প্রতি ভেঙেছে তা দ্রুত মেরামত করা হয়েছে । তবে আমাদের বাঁধ মেরামতের যে প্রকল্প চলমান রয়েছে তা সম্পুর্ণ বাস্তবায়ন হলে সাইক্লোন মোকাবেলা করা সম্ভব হবে এবং উপকুল বাসীর আতংক কেটে যাবে ।