একটি রেখায় চাষি ও সাধারণ মানুষকে তাদের বসতভিটা চাষ জমি ফেলে পথে বেরিয়ে পড়ে নতুন আবাসের লক্ষে। কোটি কোটি উদ্বাস্তু মানুষ তারা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে । নদী পথে ও স্থলপথে তারা সম্বলহীন অবস্থায় সুন্দরবন উপকূলে আগে থেকে বাস করা মানুষের সাথে এসে বসবাস করতে শুরু করে। দেশ ভাগের পরে পাকিস্তান সরকার এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষকে কোনো রকম সাহায্য সহযোগীতা করেনি। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকা তৎকালীন নেতা যোগেন মল্লিক দেশভাগের সময় ভারতের সাথে যেতে অপারগতা জানায়। তিনি আশা করেছিলেন পাকিস্তান সরকার তাকে সরকার পরিচালনার কাজে কিছু ক্ষমতা দেবে।কিন্তু ধর্মীয় বৈষম্য ও নিম্ন অঞ্চলের মানুষ বলে, পাকিস্তান সরকার তাকে কোনো রকম ক্ষমতা তো দূরের কথা সাহায্য সহযোগিতাই করেনি।
দেশ ভাগ হওয়াতে ভারত সরকার থেকে পাওয়া রেশনের চাল আসাও বন্ধ হয়ে যায়। তাই সুন্দরবন সংলগ্ন মানুষের দুঃখ দুর্দশা চরমে পৌছায়। তাই তারা জীবনের তাগিদে সুন্দর বনের এই দ্বীপের ভিতরে এসে সুন্দর বনের বাঘ ও অন্যান্য হিংস্র প্রাণীর সাথে লড়াই করে জঙ্গল সাফ করে গোল পাতার ছাউনি দিয়ে ঘর তুলে বসবাস করতে শুরু করে। এই বন সংলগ্ন মানষের জীবন নানা বৈচিত্র্যময়। বন তাদের আগলে রেখেছে গভীর মমতায়। নানান সময়ে ঘূণিঝড় জলোচ্ছাস থেকে রক্ষা করেছে এই বন। সুন্দরবন ও সুন্দরবন সংলগ্ন মানুষের জীবন প্রণালী অন্য সব জনপদ থেকে আলাদা। আর এই ভিন্নতার কারণ হল তাদের জীবিকা। জলে কুমির চারদিকে নোনা জল ডাঙ্গায় বাঘ ও পরিবারের চরম দারিদ্র্যতা নিয়ে জীবন কাটে সুন্দরবন অঞ্চলের এক শ্রেণীর মানুষের। তারা জীবিকার জন্য সুন্দরবনের ছোট ছোট খাল, গাছপালা, জীব জন্তুর, সাথে মিলে মিশে আছে। এদের সাথে গড়ে উঠেছে তাদের এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। কখনো অনিশ্চিত আতঙ্কে নিম্ন ও অতি নিম্ন বিত্তের একদল মানুষ জীবিকার সন্ধানে বাঁচার তাগিদে অলৌকিক শক্তির কাছে আত্মসমর্পন করেছে। এ নিয়ে গড়ে উঠেছে সুন্দরবন উপকূলে অনেক লোক সংস্কৃতি। যেমন : বনবিবির পুঁথি,গাজি কালুর গীত ইত্যাদি উল্লেখ যোগ্য।
বিচিত্র এই সুন্দরবনের বিচিত্র এই মানুষগুলি হাজার বিপদের মাঝে নোনাজল ও নোনা পলি মাটিতে হাবু ডুবু খেয়ে হিংস্র বন্য জীব ও সরীসৃপের সাথে জীবন মৃত্য লড়াই করে, প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝা ও দৈত্য সম ঘূণিঝড়ের দাপটে সামান্য গোলপাতার ছাউনি ঘরে বুক চিতিয়ে এরা বেঁচে আছে। শুধু বেঁচে থাকা নয় তাগড়া চেহারা ও বলিষ্ঠ মন নিয়ে দিব্যি নিজের খাদ্য উপকরণ আহরণ করে নিচ্ছে এই বন থেকে এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মাঝে পৌছে দিচ্ছে। জঙ্গল কেটে আবাদি জমিতে পরিনত করেছে সমাজের এসব নিম্ন শ্রেণীর শক্ত পেশীর মানুষ গুলো কিন্তু তাদের নামে এসব ভূ-সম্পত্তি ছিলো না।
সুন্দরবনের অর্থনৈতিক কাঠামোটি মুলত জীব বৈচিত্র্যের ওপর নির্ভরশীল। এর ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন শ্রমজীবী মানুষগুলো এই অঞ্চলকে দিনে দিনে শিল্প সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলেছে ।
প্রথমতো তারা জীবন জীবিকার জন্য নিজস্ব পেশার কারনেই অল্প সংখ্যক মানুষ নিজেদের জীবন বিপন্ন করে বসবাস করা শুরু করে। সুন্দর বনের জীববৈচিত্র্যের উপর নির্ভর করে তারা বেছে নেয় তাদের পেশা। তাদের মৌয়াল, কেউ বাওয়ালা কেউ, জেলে কেউবা চুনুরী। বর্তমানে সুন্দরবনে উপকূলে বাওয়াল মৌয়াল ও জেলেরা থাকলেও কালের বিবর্তনে এই জৈব উপায়ে তৈরী করা চুন প্রস্তুত কারী চুন শিল্পের এই চুনুরিরা আজ নেই। আমরা সুন্দরবনের সংলগ্ন অনেক মানুষ জানিই না, যে এক সময় সুন্দরবন এলাকায় চুন প্রস্তুতকারী চুনুরি জাতি বাস করত।
তবে চলুন হারিয়ে যাওয়া জীবিকা সম্পর্কে কিছু জানি। আজ আপনাদের জানাব ‘চুনুরিজাতি’ সম্পর্কে।
‘যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম, মহেশখালীর পানখিলি তারে বানাই খাওয়াইতাম *
* পান খেয়ে ঠোঁট লাল করিলাম, বন্ধুর দেখা পাইলাম না *
পান নিয়ে এমন অনেক গান আমরা শুনেছি। যাইহোক, মূল কথায় আসি।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ এশিয়ায় পান একটি জনপ্রিয় ও পরিচিত খাবার। সাধারণত অতিথি আপ্যায়নে কিংবা কোনো বৈঠকে আলোচনা শুরু করার উপলক্ষ হিসেবে পানের ব্যবহার দেখা যায়। পান বলতে শুধু পান পাতা খাওয়াই বোঝায় না। সাথে থাকে অবশ্যই ঠোঁট লাল করার চুন ও সুপারি। আর ভারত বর্ষ ও বাংলার রসনা বিলাসী মানুষের কাছে পান একটি অতি প্রিয় খাবার। সেই পানে স্বাদ যোগায় চুন সুপারি। সুপারি একধরনের ফল তা গাছে ধরে সবাই জানি। কিন্তু পানকে সুস্বাদু করতে চুন প্রস্তুত করতে হয়। বাংলাদেশে একসময় চুন বলতে বোঝাত, শামুক ও ঝিনুকের তৈরী চুন। কিন্তু কালের বিবর্তনে এই জৈব উপায়ে তৈরী চুন বিলুপ্তির পথে। তাই এখন আমরা বাজারে দুই ধরনের চুন দেখলেও ‘পাথুরে’ চুনই বেশী দেখি। পাথুরে চুন তৈরী হয়, ‘চুনাপাথর’ ও অন্যান্য ক্যামিকেল দিয়ে। যা মানুষের শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই চুন আসলে ঘরবাড়ি চুনকাম করা ও অন্যান্য কাজে ব্যবহারের জন্য। পাথুরে চুন মানুষের শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই পাথুরে চুন মানুষের শরীরের ক্যালসিয়াম ও শক্তি ক্ষয় করে, জীবনী নষ্ট করে, পাকস্থলী নষ্ট করে, দাঁত ক্ষয় করে। এই জন্য কোনোমতেই পাথুরে চুন খাওয়া উচিৎ নয়। তবে একথাও সত্য যে জৈব অথবা অজৈব উভয় প্রক্রিয়ায় চুনাপাথর গঠিত হতে পারে। অধিকাংশ চুনাপাথরই উচ্চমাত্রায় জীবাষ্ম সমৃদ্ধ এবং সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত যে, প্রাচীনকালের ঝিঁনুক রাজি অথবা প্রবাল বলয়ের সঞ্চয়নকে উপস্থাপন করে থাকে। তবে এই চুনাপাথরই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন ক্যামিকেল মিশিয়ে তা বাজারজাত করে। সেই চুন অনেকে ব্যবহার করে ঘরবাড়ি চুনকাম করতে, অনেকে খাওয়ার চুন হিসেবে। অন্যান্য কাজ তো আছেই। এই চুনে এ্যাসিডের পরিমান বেশী থাকে।
অন্যদিকে জৈব উপায়ে তৈরি খাবার চুন হিসেবে এই শামুক ঝিনুকের চুন মানুষের শরীরের জন্য উপকারী। এই চুন শ্লেষ্মা, মেদোরোগ, অম্ল-পিত্ত-শূল, ব্রণ, গ্রহনী(পাকস্থলী জাতীয় রোগ), ক্রিমি রোগ নষ্ট করে। ৮ তোলা চুন দশ সের পানির মধ্যে দুই প্রহর অর্থাৎ ছয় ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে সেই পানির সাথে দুধ মিশিয়ে পান করলে মধুমেহ রোগ প্রশমিত হয়। এই পানিয়টি অম্লপিত্ত ও শূল রোগের পথ্য ও ঔষধ। ঝিঁনুক চুনের মধ্যে মুক্তার গুন পাওয়া যায়। আর আমরা সবাই জানি, আমাদের চামড়ার উপরের অংশ অর্থাৎ টিস্যুর গঠনে যে উজ্জ্বলতা তা সোনা ও মুক্তার কারনে। একটা বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলিঃ একবার ছোটবেলায় লুকোচুরি খেলতে গিয়ে, ভিমরুলের চাকে খোঁচা দিয়েছিলাম। আর যাবা কোথায় ! দুইটা ভিমরুল বসে পড়ল নাকের উপর। কোনোরকম পাশে থাকা পুকুরে ঝাপ দিলাম। ওরাও পিছু নিল আমার। ডুব দিতে দিতে একটা কামড় বসাল পিঠে। সে বার দেখেছি নানীর হাতে বানানো ঝিঁনুক ও শামুকের তৈরি চুনের যাদু। তিনি আমার ভিমরুলের কামড়ানো স্থানে এই চুন লাগিয়ে দিলেন। কিছুক্ষন পরে সেই তীব্র যন্ত্রনা কমে গেল, ফোলাও কমে গেলো। আগেই বলেছি আগে গ্রামের গেরস্তবাড়ির অনেকেই নিজেদের খাওয়ার জন্যই সাধারণত চুন তৈরি করত।
এবার চুন প্রস্তুত প্রণালী দেখি
এই চুন তৈরীর জন্য দরকার শামুক ঝিঁনুক। তাই কিছু মানুষ চুন তৈরীর জন্য সুন্দরবনের ভেতরে ছোট ছোট খালে প্রবেশ করে, শামুক ও ঝিঁনুক সংগ্রহ করার জন্য। তারা এগুলো সংগ্রহ করে স্থানীয় হাঁটে বিক্রি করত। আবার অনেকে নিজেরাই তৈরী করত। চুনুরিরা এসব হাঁট থেকে শামুক ও ঝিঁনুক সংগ্রহ করত। এই চুন প্রস্তুত খুবই চমকপ্রদ এবং সময় সাপেক্ষ ব্যপার। চমকপ্রদ এজন্য বললাম, কারন এই চুন প্রস্তুতের সময় তারা বিভিন্ন সাবধানতা অবলম্বন করে। মন্ত্র পড়ে, বনের দেবদেবীকে স্মরণ করে। চুনিরিদুর ধারনা অলক্ষি কেউ এই চুন তৈরীর সময় নজর দিলে চুন ভাল ফুটে সাদা হবে না। চুন কালো হয়ে যাবে, অলক্ষির মুখের মতো। তাই অনেক রাখঢাক করেই এই চুন তৈরী করত চুনেরা। স্থানীয় ভাষায় এদের চুনে বলা হয়। তবে আমার শশুরবাড়ির এদিকে অর্থাৎ উত্তরাঞ্চলে এদের *জুগে* বলা হয়। চুনেরা বা জুগিরা ছাড়াও এই চুন তৈরি করে অনেক গেরস্থ বাড়ি। যেমন আমি আমার নানিকে দুখেছি এই চুন তৈরী করতে। আমার নানা ও দাদাবাড়ি সুন্দরবন সংলগ্ন রামপাল উপজেলায়। তাই আমি সখের বশেই কিয়াম মামার সাথে ঝিঁনুক ও শামুক খুঁটে এনেছি নানাবাড়ির পাশেই খাল থেকে। আহা! আমার সেই শৈশব। যাই হোক, চুনুরিরা চুন তৈরীর জন্য ঝিঁনুক ও শামুকের উপরের শক্ত আবরনটিই শুধু নিত। আর ভিতরের নরম অংশটুকু বাড়ির হাঁস মুরগির খাবারের জন্য কাজে লাগাতো। উপরের শক্ত খোলসটি খুব ভাল করে পরিষ্কার করে অল্প রোদে শুকিয়ে নিত প্রথমে।
অন্যদিকে গরুর গোবরের গোল গোল চাকতি করে রোদে ভাল করে শুকিয়ে নিত, যেন জ্বালানী হিসেবে এটি ভালমতো পোড়ে। শামুকের ও ঝিনুকের শক্ত খোলসটি এই গোল চাকতির উপরে রেখে তার উপর আবারো চাকতি দিত এভাবে পর্যায়ক্রমে এটি উপরের দিকে উঠাত। এবং চাকতির মাঝখানে ফাঁকা জায়গায় তুষ দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিত। গোবরের চাকতিগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেলে আলত করে শামুক ও ঝিঁনুকগুলো উঠিয়ে গরম ফুটানো পানিতে ছেড়ে দিয়ে জোরে জোরে বাঁশের লাকড়ি দিয়ে ২০/২৫ মিনিট নাড়তে হয়। আমি দেখেছি নানিকে খেজুরের রস জাল দেওয়া *তাফোলে* ( এক ধরনের পাত্র) এই শামুক ও ঝিঁনুকগুলো ফুটাতো। মজার ব্যাপার হলো, আগুনে পুড়ে শামুক ও ঝিঁনুকগুলো সাদা রং হয়ে যেতো।। এই শামুক ও ঝিঁনুকগুলো ফুটানো পানিতে ফুটানোর সময় অনেকে চুনের রং আরো সাদা করার জন্য কাঁচা কলার রস মিশায়। ৫০ কেজী চূর্ণ বিচূর্ণ পোড়ানো শামুক ও ঝিঁনুক ফুটালে ১৫০ থকে ১৮০ কেজী খাওয়ার চুন পাওয়া যায়। অনেকে আবার অন্য পদ্ধতিতেও এই জৈব চুন তৈরী করে। যেমন এই উত্তরাঞ্চলে মাটির এক ধরনের বিশেষ চুলায় ও মাটির পাত্রে চুন পোড়ায় ও ফুটায়।
আমি এই চুনকে জৈব চুন বলি কারণ:
এই চুনে রাসায়নিক বা কোনো ধরনের কেমিক্যাল মেশানো হয় না।
রাসায়নিক কোনো প্রকার দ্রব্য এই জৈব চুনে থাকে না বরং স্বাস্থ্যের জন্য এই চুন উপকার। তবুও কালের বিবর্তনে এই চুন শিল্প আজ ধ্বংসের মুখে। এই চুন শিল্পে জড়িত ‘চুনে’বা ‘জুগিরা’ আজ তারা তাদের বাপ দাদার আমলের পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়েছে। এখানে আমার প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও সমাজতত্ত্ববিদ ‘ইবনে খলুদিনে্র একটি উক্তি মনে পড়ছে। তাঁর মতে, কোনো কোনো জাত বা সম্রাজ্যের স্থায়ী কাল চার পুরুষের অধিক খুব একটা স্থায়ী হয় না। এর পিছনে কারন থাকে অনেক। ঠিক পেশাগত জাতী হিসেবে পরিচিত এই ‘চুনে’ও ‘জুগি’ জাতীদের পেশার পরিবর্তন ও এই শিল্পের বিলুপ্ত হওয়ার পিছনে কারন ও অনেক। রয়েছে পরিবেশ বিপর্যয় ও সামাজিক বৈষম্য। আমি এই প্রতিবেদনটি লেখার সময় কুড়িগ্রাম কাঠালবাড়ি জুগি পাড়ায় গিয়ে তাদের সাথে কথা বলেছি। জেনেছি তাদের সুখ দুঃখ। এই পেশার বিলুপ্ত হওয়ার কারনও জেনেছি। উত্তরাঞ্চলে সব থেকে বড় জুগি পাড়া হল ঠাকুরগাঁ জুগি পাড়া। ওদের মাধ্যমেও খবর নিয়ে জানতে পেরেছি এই বিলুপ্ত হওয়ার একই কারন। আমি সবার জানার জন্য তাদের নাম ও পরিচয় পরে তুলে ধরব। এখন এই শিল্প বিলুপ্ত হওয়ার কারন গুলো বলিঃ
এই শিল্পের নতুন প্রজন্ম বর্তমান সামাজিক অবস্থার সাথে টিকে থাকতে ও সামাজিক বিভিন্ন বৈষম্যের কারনে জীবন যুদ্ধের সাথে জয়ী হতে এই শিল্প থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছে নতুন প্রজন্ম। যেমনঃ
১. জলবায়ুর পরিবর্তনের কারনে সমুদ্রের উপকূলের সুন্দরবনের ভিতরে ছোট ছোট খাল গুলিতে লবনাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারনে শামুক ও ঝিনুকেরর পরিমান কমে গেছে।
২. সুন্দরবনের খালগুলোতে বাগদা চিংড়ির রেণু সংগ্রহ করার সময় প্রচুর পরিমানে ঝিঁনুক ও শামুক নষ্ট হয় আর এ কারনেও কমে যাচ্ছে শামুক ও ঝিঁনুক।
৩. খালবিল নদী নালায় মাছ উৎপাদন ও ধান চাষে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারনেও ঝিঁনুক ও শামুক কমে গোছে।
৪. বর্তমানে ফিড বা মাছ, মুরগির খাবার, কবুতরের গ্রীড তৈরি এবং মাছের খাদ্যের গ্রিড তৈরি করতে শামুক ও ঝিনুকের ব্যবহারের জন্য ও চুন প্রস্তুতকারী শিল্পীরা শামুক ও ঝিনুকের সংকটে পড়ছে। আর যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে তাও চড়া দামে কিনতে হচ্ছে তাদের। আর মাত্র তিন কেজি শামুক ও ঝিঁনুক পেলে এক কেজী গুড়া চুন পাওয়া যায়। তাতে পানি মেশালে পাঁচ কেজি খাবার চুন পাওয়া যায়। এক কেজি গুড়া চুন বিশ টাকা। আর পানি চুন দশ টাকায় বিক্রি হয়। তিন কেজি শামুক ও ঝিনুকের দাম পড়ে ১০/১৫ টাকা, কাঠখড়ির খরচ ৩০/৪০ টাকা এবং পরিশ্রম ও সময় মিলায়ে বর্তমানে এ পেশায় টিকে থাকা মুশকিল। যেখানে আগে বস্তাই বিক্রি হতো ১০/২০ টাকাতে।
৫. চুন প্রস্তুতের সময় শামুক ও ঝিঁনুক পোড়ানোতে সামান্য যে ধোয়ার সৃষ্টি এবং দুর্গন্ধ হয় যা অতি সামান্য, এতে অনেক সময় আশেপাশের মানুষ অভিযোগ করে। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতামতে শামুক ও ঝিঁনুক পোড়ালে তেমন দুর্গন্ধ ও ধোয়ার সৃষ্টি হয় না। তবে হ্যাঁ, এই শামুক ও ঝিঁনুক পোড়ানোর সময় এর ভিতরের শাষমূল ভালমতো পরিষ্কার না হলে গন্ধটা তীব্র হয়। তবে যেহেতু এটা কোনো ধরনের ক্যামিকেল না বরং এক ধরনে ছোট ছোট প্রানী তাই এটা পোড়ানোর সময় এর গন্ধ ও ধোয়াতে সাস্থ্যের কোনো রকম ক্ষতি হয় না। যতটা যানবাহনের ধোয়াতে হয়। তাইলে তো আমরা সামান্য জায়গাতেই গাড়ি বের না করে হেঁটেই যেতে পারি। যাই হোক, আমার নানাবাড়ি ও দাদাবাড়ি সুন্দরবন সংলগ্ন রামপাল থানার ফয়লা গ্রামে। যদিও নানী আমার এই চুন প্রস্তুত শিল্পের সাথে জড়িত নয়, তবুও তখনকার সময়ে অনেক গেরস্থ বাড়ির মতো তিনিও বাড়িতে আসা মেহমান আপ্যায়নের জন্য ও নিজেদের খাওয়ার জন্য এই চুন তৈরী করত। তিনি ফয়লা বাজার হাটের ফৌড়েদের কাছ থেকে এটা সংগ্রহ করত। তাই পুরো চুন প্রস্তুত প্রনালীটি আমি নিজে দেখেছি। এটা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ব্যপার। আসলে এই আধুনিক যুগের মানুষের সবকিছুতেই ধ্যৈর্যচ্যুতি ঘটে। এর এসব অভিযোগের উপর ভিত্তি করে অনেকেই এ কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। তারা গ্রহন করেছে অন্য পেশা। কারন সামাজিক বৈষম্য মতে তারা খুবই দুর্বল জাতি। এই কারনে তথ্যমতে,ঝালকাঠি শহরের পশ্চিম চাঁদকাঠি এলাকায় প্রায় দেড়শ বছর ধরে চলে আসা চুন শিল্পের সাথে জড়িত ‘গৌরিহরি ধরের পুত্র বিষ্ণুপদ ধর তার চুন তৈরীর জন্য শামুক ও ঝিঁনুক সংগ্রহ করতেন মোংলার দিগরাজ বাজার থেকে। তিনি ও তার এই পেশা থেকে হাত গুটিয়ে নিচ্ছেন এইসব অভিযোগের জন্য। এলাকাবাসী তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে শামুক ও ঝিঁনুক পোড়ানোর গন্ধের, তাই সে এ পেশা বন্ধ করে দিচ্ছে।
কুড়িগ্রাম জেলার কাঠালবাড়ি গ্রামের তারাপদ ধরের সাথে কথা বলে জেনেছি, সেও তার বাপ দাদার এই পেশা এখনো মায়ার টানেই ধরে রেখেছে। তিনি আমাকে বললেন তিনি তার বাবার সাথে পার্বতিপুর থেকে ট্রেনে করে চলে যেতেন খুলনা। সেখান থেকে মোংলা পোর্ট দিগরাজ বাজার থেকে বস্তাভরে সমুদ্রের শামুক ও ঝিঁনুক নিয়ে মালগাড়ির বগিতে করে চলে আসতেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন এতো দূরে যান শামুক ও ঝিঁনুক সংগ্রহ করত? উত্তরে তিনি বললেন, সমুদ্রের শামুকের সাথে দেশীয় সনাতন পদ্ধতিতে সংগ্রহ করা পুকুর ও খালবিলের শামুক ও ঝিঁনুক মিশিয়ে চুন তৈ্রী করলে সেই চুনের স্বাদ হয় খুবই ভাল। এবং এর ক্রেতাও ভাল পাওয়া যায়। এক সময় এই চুন অন্যান্য দেশেও রপ্তানি হতো। এখন সবই বন্ধ। এখন তিনি অত দূরে যেতে পারেননা( দিগরাজ বাজার)। কাউকে দিয়ে আনিয়ে নেন। তাও অনেক চড়া দামে। যাতে কোনোরকম তার জীবন চলে। কিন্তু তিনিও এখন এই পেশা বন্ধ করে দিচ্ছেন।
৬. অর্থনৈতিকভাবে বর্তমানে টিকে থাকতে এ পেশা তাদের জন্য ধরে রাখা একেবারেই অসম্ভব। বর্তমান বাজার দর, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চাহিদা মেটানো এই পেশা থেকে তা পূরণ করা একেবারেই সম্ভব না।
৭. পাথুরে চুনের সাথে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকাও মুশকিল।
রসনা বিলাসী মানুষের কাছে চুনের চাহিদা থাকলেও তারা পাথুরে চুনের খারাপ দিকগুলো সম্পর্কে জানেই না। আর শামুক ও ঝিনুকের তৈরি চুন থেকে পাথুরে চুন সস্তা। তাই ক্রেতা তার অজ্ঞতার কারনে কমদামে ক্ষতিকর এই পাথুরে চুন কিনতে আগ্রহী হয়ে পড়ছে। মুখ থুবড়ে পড়ছে জৈব চুন শিল্প। পাথুরে চুনে ঠোট মুখ লাল হচ্ছে ঠিকই কিন্তু পাকস্থলি রক্তাক্ত হচ্ছে, ক্ষয় হচ্ছে ক্যালসিয়াম। অন্যান্য মুখের ঘা ও পেটের পিড়া তো আছেই।
আমি বলছি না এই জৈব চুন শিল্পীরা নিজেরা না খেয়ে না পরে, তারা বাংলার রসনা বিলাসী মানুষের স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল করুক। কিন্তু সরকার থেকে এমন ব্যাবস্থা করুক যেন তাদের এই পেশা টিকে থাকে। কারন এটাও বাংলার শত বছরের এক ঐতিহ্য শিল্প। তারা অন্যান্য পেশার পাশাপাশি এই পেশাটি টিকিয়ে রাখুক। তারা শহর মুখি হচ্ছে। বাড়ছে বড় শহরে এইসব পেশার মানুষের চাপ।
এই আধুনিক যুগের মানুষগুলোকে সভ্যতার দ্বারে পৌছে দিয়েছে এইসব অবহেলিত শ্রমজীবী মানুষগুলো। তাদের জানতে নতুন প্রজন্মকে সাহায্য করেছে আমাদের ইতিহাসবিদরা। তাই তাদের আমরা শ্রদ্ধা জানাই। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের প্রজন্ম সভ্যতা বলতে বোঝে তথাকথিত উন্নতি প্রচার কৌশল ও স্ব প্রদর্শনকারী সংস্কৃতি সচেতন মানুষ।
এইসব শ্রমজীবী আদি মানবের নিত্য নতুন কৃষি বিপ্লব কারিগরি দিকগুলি অনেকে আপাতদৃষ্টিতে পশ্চাৎপদ, অমার্জিত আখ্যা দিয়ে নিজেদের উঁচু স্তরের লোক ভাবতে ভালবাসে। একটা দেশের জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটা যে কতোটা অন্তরায় তা এখনো ভাবতে শেখেনি বেশীরভাগ সংখ্যালঘিষ্ট সুবিধাভোগি জনগোষ্ঠী। তাই সুন্দরবনের কৃষিজীবী, জলজীবী ও সাধারন শ্রমজীবী এসব মানুষের প্রতি এখনো তথাকথিত ভদ্রলোকদের অবজ্ঞার বহর দেখে বিস্মিত হই। এ অঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষগুলো জীবন যাপনে, জীবিকা অর্জনের জন্য নানা বাধা বিঘ্ন পার হয়ে আসছে। অন্যের খাদ্যের চাহিদার যোগান দিচ্ছে। সুন্দরবন সংলগ্ন বেশীরভাগ শ্রমজীবী মানষের ঘর মাটির তৈরী গোলপাতার ছাউনি। তাই উপকূলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় একেকটি দীর্ঘশ্বাস। লবণ পানির সাথে তাদের আজীবন বসবাস। পানযোগ্য পানির জন্য যেন আর এক দুর্ভোগ। এক একটা দুর্যোগে সরকারী বেসরকারী কর্মকর্তা রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবকরা এসব মানুষের দুঃখ দুর্দশা দেখে সাময়িক উহ ! আহ! সমায়িক আশ্বাসের বানী শুনালেও বাস্তবে তা আর পূর্ণ হয় না। জোয়ার ভাটার এই লবন পানির সাথে সখ্যতা করেই জীবন চলছে সুন্দরবন উপকুলবাসীর। বংশানুক্রমে সেই পর্তুগীজ, ওলন্দাজ,ফরাসী ও মারাঠাদের অত্যাচার এবং প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে, সুন্দরবনকে ভালবেসে বসবাস করে আসছে এসব শ্রমজীবী মানুষগুলো। সুন্দরবন ও তাদের মায়ের মতো রক্ষা করে আসছে, সমুদ্রের জলোচ্ছাস ও ঘূর্নিঝড় থেকে। এখন আবার মরার উপর এই খাড়ার ঘা “রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র” তাই এই আধুনিক অবকাঠামোর বাংলাদেশ হয়েও উপকূলবাসীর শেষ হয় না দুঃখ বেদনার সাদাকালো মলিন পথ।