মো. খোরশেদ আলম জুয়েল: সমস্যা যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছেনা পোলট্রি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে। একের পর এক সমস্যা যেন লেগেই আছে। দেশে করোনা পরিস্থিতিতে লাখ লাখ খামারি যখন হুমকির মুখে তখন মরার ওপার খরার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর ‘দি বাংলাদেশ ওয়েল মিলস এসোসিয়েশন’র ইস্যু হওয়া সাম্প্রতিক একটি চিঠি। গত ১৯ মে সংগঠনটির সভাপতি বিশ্বজিত সাহা স্বাক্ষরিত উক্ত চিঠিতে সয়াকেক/সয়ামিল ও রেপসীডকেক (HS Code : 2304.00.00 এবং 1208.10.00) আমদানিতে বিদ্যমান শুল্ক ও কর হার আসন্ন ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটে বৃদ্ধির জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে সুপারিশ প্রদানের আবেদন করা হয়েছে। আমদানি নিরুৎসাহিত করতে সয়াবিন কেক/সয়ামিল আমদানির উপর আমদানি শুল্ক ১৫% এবং ১৫% রেগুলেটরী ডিউটি আরোপ করা প্রয়োজন মনে করছে ‘দি বাংলাদেশ ওয়েল মিলস এসোসিয়েশন’। তাদের দাবী এতে করে দেশেই সয়া কেক উৎপাদন সুরক্ষিত থাকবে।
শুধু তাই নয়, গত ২৫ মার্চ এস,আর,ও নং-৯৯ আইন/২০২০/৯৩ মূসক এর মাধ্যমে সয়ামিল এবং রেপসীড কেক এর আমদানি পর্যায়ে প্রত্যাহারকৃত ৫% আগাম করা (AT) পুনর্বহালের আবেদন করা হয়েছে। পোলট্রি, মৎস্য ও গবাদিপশু খাতের অতীব গুরুত্ব বিবেচনা এবং উক্ত বিবেচনার সময় দেশীয় উৎপাদন ছিল না বলেই হয়তো উক্ত সময় শুল্ক ও কর মওকুফ/হ্রাস করা হয়েছে বলে সংগঠনটির পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়। এ নিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে জড়িত উদ্যোক্তা ও খামারিদের মাঝে বিরাজ করছে গভীর উৎকণ্ঠা ও ক্ষোভ।
চিঠিতে ‘দি বাংলাদেশ ওয়েল মিলস এসোসিয়েশন’র দেয়া তথ্যমতে, সিটি সীড ক্রাশিং ইন্ডাষ্ট্রিজ লি., মেঘনা সীড ক্রাসিং ইন্ডাষ্ট্রিজ লি., গ্লোব সীড ক্রাসিং ইন্ডাষ্ট্রি এবং রুপসা সীড ক্রাশিং ইন্ডাষ্ট্রি লি. নামের চারটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের সয়াকেক/সয়ামীল এবং রেপসীডকেক উৎপাদন ক্ষমতা প্রতিদিন ১৬ হাজার মে. টন, অর্থাৎ বছরে যারা পরিমান দাড়ায় ৬০,০০,০০০.০০ (ষাট লাখ) মে.টন।
এ সম্পর্কে ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশেন বাংলাদেশ (ফিআব) সাধারণ সম্পাদক মো. আহসানুজ্জামান এগ্রিনিউজ২৪.কম কে বলেন, আমাদের ফিড শিল্প এবং খামারী উভয়ের জন্য বিষয়টি ভীষণ রকমের উদ্বেগের। আমরা চিঠিটি পড়ে দেখেছি এবং এর উদ্দেশ্যে সম্পর্কে পরিস্কার যে, একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে একচেটিয়া (মনিপলি) ব্যবসা করার পায়তারা চলছে, একটা সময় যাতে আমরা তাদের কাছে জিম্মি হয়ে যাই। আমাদের দেশের মোট চাহিদার মাত্র ২৫ শতাংশের মতো আমরা বিদেশ থেকে ওইসব কাঁচামাল আমদানি করি, বাকীটা তাদের কাছ থেকেই ক্রয় করে ব্যবহার করি। এখন সেটুকু আমদানিতে বাঁধ সাধা মানে, ইচ্ছেমতো তারা যেকোন সময় ওইসব পণ্যের দাম বাড়াতে পারার অগ্রিম কৌশল বলেই প্রতিয়মান হয়। বিগত দিনে আমাদের এমন খারাপ অভিজ্ঞতা রয়েছে। ফলে দেশের ফিড শিল্প এবং সামগ্রিকভাবে পোলট্রি, মৎস্য ও ডেইরি খাতের খামারিরা হুমকির মুখে পড়বে, দেখা দিবে অস্থিরতা, সরাসরি প্রভাব পড়বে ভোক্তা ও দেশের অর্থনীতির ওপর।
মো. আহসানুজ্জামান প্রশ্ন রেখেন বলেন, যদি সয়াকেক/সয়ামিল ও রেপসীডকেক আমাদের দেশেই চাহিদা মেটাতে পারে এবং দাম সাশ্রয়ী হয় তাহলে আমরা বিদেশে থেকে এসব কাঁচামাল আনতে যাবো কেন? এসব পণ্যের কোয়ালিটি একটা বড় ফ্যাক্ট। আমরা বিদেশ থেকে তুলনামূলক কম দামে কিন্তু অধিক মানসম্পন্ন সয়ামিল ও রেপসিড কেক পাই। আমদানিকৃত সয়ামিলে যেখানে প্রোটিনের হার থাকে ৪৭ শতাংশ সেখানে তাদের পণ্যে ৪২ শতাংশের উপরে সেটি পাওয়া যায়না। সবচেয়ে বড় কথা উক্ত চিঠিতে যে পণ্যগুলোর কথা বলা হয়েছে সেগুলো তাদের ফ্যাক্টরির বাই প্রোডাক্ট। তারা তেল উৎপাদনের জন্য জিরো ট্যাক্সে সয়াবিন ও সরিষা আমদানি করেন। তারা যেখানে নিজেরাই চাহিদার বেশিরভাগ কাঁচামাল আমদানি করে, সেখানে কীভাবে তাদের বাই প্রোডাক্ট বিক্রির জন্য এমন একটি দাবী করলেন আমাদের বোধগম্য নয়।
তিনি বলেন, আমরা তাদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা দিয়ে মাল কিনে নিই। সেটিও সময়মতো পাওয়া যায়না। এরপরও দেখা যায় কোয়ালিটি খারাপ হয় কিন্তু কোয়ালিটি খারাপ হলে সেই মাল আবার তারা ফেরত নেয়না, সুযোগ বুঝে ইচ্ছেমতো দাম বাড়ায়।
মো. আহসানুজ্জামান বলেন, আমরা গত বৃহস্পতিবার (৪ মে) প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকে এ ব্যাপারে আমাদের অবস্থানের কথা বলেছি। যদি উল্লেখিত দাবী বাজেটে প্রতিফলিত হয় তবে চলমান সংকটের মাঝে নতুন করে ভয়াবহ অস্থিরতা তৈরি হবে পোলট্রি, মৎস্য ও ডেইরি খাতে, কারণ এসব আমরা এমনিতেই সংকটের মধ্যে আছি।
এ ব্যাপারে এনিমেল হেলথ কোম্পানিজ এসোসিয়েশন বাংলাদেশ (আহ্কাব) সভাপতি ডা. এম নজরুল ইসলাম এগ্রিনিউজ২৪.কম কে বলেন, যদি ওয়েল এসোসিয়েশনের দাবী মেনে নিয়ে সেটি প্রতিফলিত হয় তবে, সেটি হবে দেশের ফিড ও প্রাণিজ সেক্টরের ওপর সরাসরি আঘাত। তেল কোম্পানিগুলো জিরো ট্যাক্সে ফুল ফ্যাট সয়াবিন নিয়ে আসে তেল উৎপাদনের জন্য, আমাদের সেক্টরের জন্য নয়। এখন সেই তেল উৎপাদনের পর বাই প্রোডাক্ট বিক্রির জন্য ফিড সেক্টরের ওপর চাপের কৌশল নিবে সেটি কোনভাবেই কাম্য নয়। এতে করে ভবিষ্যতে অস্থিতিশীল হওয়ার আশংকা রয়েছে ফিড শিল্প ও সামগ্রিক প্রাণিজ খাত।
বাংলাদেশ অ্যাকোয়া প্রোডাক্ট কোম্পানিজ এসোসিয়েশন (বাপকা) সভাপতি মোহাম্মদ তারেক সরকার এগ্রিনিউজ২৪.কম কে বলেন, বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও রপ্তানিতে কোন লক্ষ্যমাত্রাই অর্জন করতে পারেনি। শুধুমাত্র উৎপাদন খরচ কম হওয়ার কারণে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম আমাদের চেয়ে কম খরচে মাছ উৎপাদন করতে পারছে বলে রপ্তানিতে বিশ্ববাজার দখল করে আছে।
তিনি বলেন, গত বছর মিট অ্যান্ড বোন মিল ইস্যুতে চাষি ও ফিড কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, প্রাণিজ প্রোটিন আমদানি জটিলতায় ফিডের দামও বেড়ে গেছে। এরই মধ্যে নতুন আবদার হচ্ছে সয়াবিন কেক আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতে সরকারকে ট্যাক্স আরোপের পরামর্শ দিয়েছে একটি গোষ্ঠী। মূলত সিন্ডিকেট করে ব্যবসা বাড়ানোর জন্য দেশের মৎস্য শিল্পের বারোটা বাজিয়ে মৎস্য আমদানি নির্ভর দেশে পরিনত করা সুকৌশলে এজেন্ডাই বলে সন্দেহ হচ্ছে। যেখানে নিজেরাই তারা সয়াকেক রপ্তানির কথা বলছে সেখানে মুক্তবাজার অর্থনীতির এ সময়ে আমদানি বন্ধ বা ব্যাহত করার সুকৌশল আবদার শুভ লক্ষণ বলে মনে করিনা। এ ব্যাপারে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ভুল পথে পা দেবেনা বলে আমরা বিশ্বাস করতে চাই।
তারেক সরকার আরো বলেন, অতীতে এ সয়াকেক নিয়ে অনেক খেলা হয়েছে। কখনো ৩০ টাকা কেজি আবার জিনিস ৮০ টাকা কেজিও হয়েছে। এ সময়ে আন্তর্জাতিক বাজার সবার জন্য উন্মুক্ত থাকাই শ্রেয়। আমাদের সয়াকেক উৎপাদকেরা বিদেশে রপ্তানি করুক এটা আমরাও চাই, তাই বলে ফিডমিলারদের জিম্মি করে আমদানির সুযোগ বন্ধ করে নয়।
বাংলাদেশ এগ্রো ফিড ইনগ্রিডিয়েন্টস ইম্পোর্টার্স এন্ড ট্রেডার্স এসোসিয়েশন (বাফিটা) ভাইস প্রেসিডেন্ট এ.এম আমিরুল ইসলাম (মন্টু) বলেন, দেশে সয়ামিল ও রেপসিড কেকের অধিক উৎপাদন আছে বলে ওয়েল এসোসিয়েশন এর পক্ষ থেকে যে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে সেই দাবীর কোন বাস্তবতা আছে বলে মনে করিনা। দেশে অধিক উৎপাদন থাকলে আমরা কেন লোকসানের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশ থেকে এসব কাঁচামাল আমদানি করবো? কারণ, এসব পণ্যগুলো আমরা ফিডমিলারদের কাছে বিক্রি করি আর ফিডমিলাররা যদি অপেক্ষাকৃত কম দামে মানসম্পন্ন কাঁচামাল দেশেই পেয়ে যায়, তবে আমাদের কাছ থেকে কেন ক্রয় করবেন বা নিজেরাই আমদানি করবেন?
আমিরুল ইসলাম মন্টু প্রশ্ন রেখে বলেন, তাদের দাবী যদি ঠিকই থাকতো তাহলে তারা দেশের পোলট্রি, মৎস্য ও ডেইরি শিল্পের সাথে জড়িত সংগঠনগুলোর সাথে বসতেন, তাদের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য নির্ধারন করে দিতেন। কিন্তু সেটি না করে তারা পোলট্রি, মৎস্য সেক্টরে সদ্য প্রত্যাহারকৃত ৫% আগাম কর পুনর্বহাল, আমদানিকৃত সয়ামিল ও রেপসিডের ওপর ১৫% ভ্যাট এবং সাথে আরো ১৫% রেগুলেটরী ডিউটি আরোপের দাবী করেছেন যা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাই।
বাংলাদেশ পোলট্রি রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’র সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার মহসিন বলেন, এটি হবে সরাসরি খামারিদের ওপর আঘাত। আমাদের দেশে ফিডের দাম এমনিতেই বেশি, ফলে ডিম ও মুরগি উৎপাদনে খরচও বেশি হয়। বিগত প্রায় দুই বছর ধরে ডিম ও মুরগির ন্যায্য দাম না পাওয়াতে হাজার হাজার পোলট্রি খামার বন্ধ হয়ে গেছে, বেকার হয়েছে লাখ লাখ খামারি; যদি ওয়েল এসোসিয়েশন এর দাবী সরকার মেনে নেয় তবে ভয়ানক হুমকির মুখে পড়ে যাবে এ সেক্টর।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে যদি চাহিদার চেয়ে অধিক উৎপাদন থাকে তবে বিশ্ববাজারে যেখানে সয়ামিলের দাম প্রতিকেজি সাড়ে ২৩ টাকারও কম সেখানে বাংলাদেশে ৩৫ টাকার কাছাকাছি কেন? এটি করা হয়েছে কেবল গুটি কয়েক কোম্পানির স্বার্থে সিন্ডিকেট করে একচেটিয়া ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে। করোনাকালীন এই মহাদুর্যোগে মানুষ যাতে বেশি বেশি প্রোটিন গ্রহণ করতে পারে, খামারিরা টিকে থাকে সেই ব্যবস্থা নেয়া দরকার; সেই সময় ওইসব অযৌক্তিক দাবী মেনে নেয়া হবে চরম হটকারি সিদ্ধান্ত। আমরা সাধারণ খামারীরা কোনভাবেই উক্ত দাবীর সাথে একমত হতে পারিনা। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, সরকার এমন কোন হটকারী সিদ্ধান্ত নিবেনা যার ফলে খামারিরা হুমকির মুখে পড়ে নতুন অস্থিরতা তৈরি হয়।