মো. সাজ্জাদ হোসেন:পোল্ট্রি, ডেইরি ও মৎস্য খাত সংশ্লিষ্টরা যখন ডিম, দুধ, মাছ, মাংসের উৎপাদন খরচ কিভাবে সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায় সে চেষ্টায় রত তখন সীড ক্র্যাশিং কোম্পানীগুলোর সংগঠন ‘দি বাংলাদেশ অয়েল মিলস অ্যাসোসিয়েশন’ -এর পক্ষ থেকে পোল্ট্রি, ডেইরি ও ফিস ফিডের অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ সয়াবিন অয়েল কেক বা সয়াকেক, রেপসীড কেক এবং সানফ্লাওয়ার সীড থেকে উৎপাদিত অয়েল কেক আমদানিতে ১৫% কাস্টমস ডিউটি এবং ১৫% রেগুলেটরি ডিউটি আরোপের আবেদন জানিয়েছে। এ দাবির যৌক্তিকতা কতখানি তা বিশ্লেষণের নিমিত্তে “সয়াবিন অয়েল কেক আমদানিতে নতুনভাবে শুল্ক আরোপের অপচেষ্টা এবং বাংলাদেশের সীড ক্র্যাশিং ইন্ডাষ্ট্রি ” শীর্ষক প্রতিবেদনের প্রথম পর্বটি গতকাল প্রকাশিত হয়েছে। আজ প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় বা শেষ পর্ব।
ঘ) MBM-এর আমদানি বন্ধ, নির্ভর করতে হচ্ছে অধিক মূল্যের Fish Meal-এর উপর, বাড়ছে উৎপাদন খরচ
সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে আমদানি বন্ধ রয়েছে মাছ, মুরগি, গবাদি পশুখাদ্যে ব্যবহৃত অপর একটি প্রোটিন সমৃদ্ধ উপকরণ মিট এন্ড বোন মিল (MBM)। এই ঘাটতি পূরণে বর্তমানে ব্যবহার করতে হচ্ছে অধিক মূল্যের Fish Meal । MBM-এর বাজার দর যেখানে কেজি প্রতি ৪০ থেকে ৪৫ টাকা, সেখানে Fish Meal দর কেজি প্রতি প্রায় ১১০ টাকা। ফলে বাড়ছে উৎপাদন খরচ। বাড়ছে ফিডের দাম। করোনা সংকটকালে বন্দরে মালামাল খালাসে জটিলতা, ল্যাব টেস্টে দীর্ঘসূত্রীতা, ইত্যাদি কারণেও বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়-যা কমাতে না পারলে সাশ্রয়ীমূল্যের ডিম, দুধ, মাছ, মুরগির মাংস ক্রেতা সাধারনের নাগালের বাইরে চলে যাবে।
ঙ) মাত্র ৪টি তেল কোম্পানীর কাছে জিম্মী করে ফেলা হচ্ছে পোল্ট্রি, মৎস্য ও ডেইরি খাতকে
বিবরণ | অয়েল ক্র্যাশিং ইন্ডাষ্ট্রি | পোল্ট্রি, মৎস্য ও ডেইরি ইন্ডাষ্ট্রি |
মোট বিনিয়োগ | বাংলাদেশ অয়েল মিলস এসোসিয়েশনের দাবি মতে সীড ক্র্যাশিং (সয়াবিন সীড, রেপসীড, সানফ্লাওয়ার সীড) ইন্ডাস্ট্রিতে মোট বিনিয়োগের পরিমান ২০ হাজার কোটি টাকা, যদিও এ পরিমান নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। | পোল্ট্রিতে = ৩৫ হাজার কোটি টাকা মৎস্য খাতে = ১১০ হাজার কোটি টাকা (আনুমানিক) ডেইরি খাতে = ৯০ হাজার কোটি টাকা মোট= ২৩৫ হাজার কোটি টাকা |
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান | ৩-৫ হাজার | পোল্ট্রিতে= ৬০ লাখ মৎস্য খাতে = ১ কোটি ৯০ লাখ ডেইরি খাতে = প্রায় ১ কোটি মোট= ৩ কোটি ৫০ লাখ |
প্রয়োজনীয়তা | স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা খাদ্যে যথাসম্ভব তেলের ব্যবহার কমাতে বলছেন। | স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বলছেন স্বাস্থ্যবান ও মেধাবী জাতি গড়তে হলে ডিম, দুধ, মাছ, মুরগির মাংস খাওয়ার পরিমান আরও বাড়াতে হবে। |
জিডিপিতে অবদান | জানা নেই | পোল্ট্রিতে = ১.৫ শতাংশ মৎস্য খাতে = ৩.৫৭ শতাংশ ডেইরি খাতে = ৩.৫ শতাংশ মোট = ৮.৫৭ শতাংশবি.দ্র: অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ৩য় এবং মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের স্থান ৪র্থ। |
রপ্তানী | রপ্তানীর সম্ভাবনা নেই | * মৎস্য = ৪২৮৭.৬৪ কোটি টাকা (২০১৭-১৮ সাল) বিশ্বের ৫৬টি দেশে বাংলাদেশ থেকে মাছ রপ্তানী হয়। * পোল্ট্রি = চলতি বছর থেকে সীমিত আকারে পোল্ট্রি ও ফিস ফিডের রপ্তানী শুরু হয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ মাংস ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানীর প্রস্তুতি চলছে। *গরুর মাংস= প্রক্রিয়াজাত গরুর মাংস দুবাই, কুয়েত, মালদ্বীপ, বাহরাইন প্রভৃতি হালাল মার্কেটে বিক্রি হচ্ছে। |
দারিদ্র বিমোচন ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান | লক্ষ্যণীয় নয় | – গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিশাল অবদান – গ্রামীণ দারিদ্র দূরীকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা – শিক্ষিত বেকার যুবকদের জন্য আশীর্বাদ – গ্রাম থেকে শহরমুখী জনস্রোতকে বিপরীত মুখী করেছে। |
খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় অবদান | লক্ষ্যণীয় নয় | অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ |
উপরের ছকে উপস্থাপিত তথ্যের আলোকে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়ত খুব বেশি কষ্ট হবেনা- জাতীয় স্বার্থে কোন্ খাতটিকে আমরা অধিক গুরুত্ব দিব কিংবা কোন শিল্প/খাতের সুরক্ষা নিশ্চিত করবো।
প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, একেক সময় বিশ্বের একেক দেশে ভূ-রাজনৈতিক কিংবা উৎপাদন কম-বেশি হওয়ার কারণে সয়াবিন অয়েল কেক বা সয়াকেকের দরের তারতম্য ঘটে থাকে। বাংলাদেশে যেহেতু সয়াবিন উৎপাদিত হয়না বললেই চলে সেহেতু আমদানিকারকগণ যেখানে কম দাম পান সেখান থেকে কাঁচামাল ক্রয় করে থাকেন। তাই যদি আমদানি পুরোপুরি বন্ধের উদ্দেশ্যে উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করা হয় তবে মাত্র ৪টি সীড ক্র্যাশিং কোম্পানীর হাতে জিম্মী হয়ে পড়বে দেশীয় পোল্ট্রি, ডেইরি ও মৎস্য খাত।
চ) উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় মাছের রপ্তানী বন্ধের উপক্রম ॥ হোঁচট খাচ্ছে পোল্ট্রি রপ্তানীর সম্ভাবনা:
– দেশে চাহিদার চেয়েও অধিক পরিমান মাছ উৎপাদিত হওয়া সত্ত্বেও সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ থেকে মাছ রপ্তানী প্রায় বন্ধই হতে চলেছে- যার অন্যতম প্রধান কারণটি হচ্ছে অতিরিক্ত উৎপাদন খরচ। আন্তর্জাতিক দরের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না দেশীয় রপ্তানীকারকগণ।
– ভারতে বর্তমানে পোল্ট্রি ও ফিস ফিডের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এবং পরিবহন খরচ বেশি হওয়ার কারণে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী আসাম, ত্রিপুরা প্রভৃতি রাজ্যে চলতি বছর থেকে বাংলাদেশী পোল্ট্রি ও ফিস ফিডের রপ্তানী শুরু হয়েছে। উৎপাদন খরচ বাড়লে এ রপ্তানীও বন্ধ হয়ে যাবে।
– ২০২৫ সাল নাগাদ দেশীয় পোল্ট্রি পণ্য (Whole chicken, chicken parts, processed food, etc.) রপ্তানীর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। সরকারও চাচ্ছেন রপ্তানী বাজার ধরতে। এক্ষেত্রেও সমস্যা ‘আন্তর্জাতিক দর’। উৎপাদন খরচ ১২-১৪ টাকা কমাতে পারলেই প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে বাংলাদেশী পোল্ট্রি পণ্য। কাঁচামাল আমদানিতে আরোপিত কর ও শুল্ক প্রত্যাহার করলে সহজেই সে সক্ষমতা তৈরি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কাজেই দেশে উৎপাদিত পোল্ট্রি মাংস ও মাংসজাত পণ্যের রপ্তানী শুরু করতে হলে এবং মাছ, মুরগি ও গবাদি পশুর খাদ্য/ফিডের রপ্তানী করতে হলে নতুন করে কর শুল্ক আরোপ তো নয়ই বরং বিদ্যমান কর ও শুল্ক প্রত্যাহার করতে হবে।
সাধারন পরামর্শ:
– সীড ক্র্যাশিং মিলগুলোর উচিত পোল্ট্রি, মৎস্য ও ডেইরী শিল্পের মত স্পর্শকাতর সেক্টরের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ না করে তাদের নিজেদের অক্ষমতা বা দূর্বলতাগুলো খুঁজে বের করা, competency বাড়াতে মনোযোগী হওয়া।
– চাপ প্রয়োগ করার অপকৌশল পরিহার করে সয়াবিন অয়েল কেক/সয়াকেক, রেপসীড কেক এর গুণগত মানোন্নয়নে কাজ করা।
– ক্লায়েন্টদের অভিযোগগুলোকে গুরুত্ব দেয়া।
– মধ্যসত্ত্বভোগী ডিলারদের সরিয়ে দিয়ে পণ্যের মূল্য আরও সহনশীল পর্যায়ে নামিয়ে আনা। এটি সম্ভব কারণ ফিড ইন্ডাষ্ট্রিই হচ্ছে সীড ক্র্যাশিং ইন্ডাষ্ট্রি’র আলোচিত উপজাত/বাইপ্রোডাক্টটির একমাত্র গ্রাহক।
– দেশে পোল্ট্রি, ডেইরি, মৎস্য খাত ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে তাই আগামীতে সয়াবিন অয়েল কেক/সয়াকেক, রেপসীড কেক ইত্যাদির ব্যবহার বহুগুণ বাড়বে সে কথা বলাই বাহুল্য। তাই আগামীদিনের মার্কেটের কথা চিন্তা করে সীড ক্র্যাশারদের উচিত হবে পরিকল্পিতভাবে সয়াবিন অয়েল কেক/সয়াকেক, রেপসীড কেক ইত্যাদির মার্কেটিং-এর প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
উপরিল্লিখিত বিশ্লেষণে বাংলাদেশ অয়েল মিলস এসোসিয়েশনের দাবি’র অসাড়তাই প্রমাণিত হয়েছে। সীড ক্র্যাশিং মিলগুলো পোল্ট্রি, ডেইরি, মৎস্য খাত কিংবা ফিড ইন্ডাষ্ট্রি’র প্রতিপক্ষ তো নয় বরং সহযোগী। তবে গুণগত মান ও প্রতিযোগিতামূলক মূল্যের ভিত্তিতেই তাঁদের টিকে থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে এ খাতগুলোই সয়াবিন অয়েল কেক/সয়াকেক, রেপসীড কেক এর একমাত্র গ্রাহক। মোট চাহিদার প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ সয়াবিন অয়েল কেক/সয়াকেক দেশীয় কোম্পানীগুলোর কাছ থেকেই ক্রয় করে থাকে দেশীয় ফিড প্রস্তুতকারক কোম্পানীগুলো। অবশিষ্ট ৩০-৩৫ শতাংশ আমদানি করতেই হয়। দেশীয়ভাবে যদি মানসম্মত পণ্য উৎপাদন করা হয় তবে শুল্ক আরোপ করে আমদানির পথ বন্ধ করার প্রয়োজন পড়বে না বরং নিজেদের স্বার্থেই সংশ্লিষ্টরা দেশীয় কোম্পানীর কাছ থেকে সয়াবিন কেক, রেপসীড কেক ইত্যাদি ক্রয় করবেন। মনে রাখতে হবে দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং মেধাবি ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থেই মানসম্মত ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করতে হবে এবং ক্ষেত্র বিশেষে শ্রেণী স্বার্থও পরিত্যাগ করতে হবে।
সয়াবিন অয়েল কেক/সয়াকেকের উপর বিদ্যমান ৫% রেগুলেটরি ডিউটি প্রত্যাহারের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে ইতোমধ্যেই অনুরোধ জানিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। ফিড ইন্ডাষ্ট্রি’র সূত্র মতে-নতুনভাবে ১৫% কাস্টমস ডিউটি ও ১৫% রেগুলেটরি ডিউটি আরোপের আর্জি যেন প্রত্যাখ্যাত হয় সেজন্য ফিড ইন্ডাষ্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন (ফিআব)-এর পক্ষ থেকে মৎস্য অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ছাড়াও অর্থমন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও আর্জি প্রেরণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে।
লেখক:যোগাযোগ ও মিডিয়া উপদেষ্টা, বিপিআইসিসি