ডা. মো. রোমেল ইসলাম, ডি ভি এম : বেশকিছুক্ষণ ধরে মাথার উপরে তিনটি কালো কুচকুচে দাড়কাক গোল হয়ে ঘুরছে আর কা কা করছে। জৈষ্ঠৈর এই ভরদুপুরে চারপাশটা হঠাৎ করেই যেন কালো ছায়ায় ঢেকে গেলো। পাশেই একটা বড় তালগাছ এতটাই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে যে পাতাগুলো চোখে ঝাপসা লাগছে। অবশ্য ছোট ছোট অনেক গুলো তাল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, প্রায় সবগুলো তাল একই মাপের বলে মনে হচ্ছে। আবার সেই বিকট শব্দটা বাতাস কাঁপিয়ে দিল। মুহুর্তেই তাল পাতা গুলো জ্বলে উঠল। দাউ দাউ করে জ্বলছে, এমনভাবে জ্বলছে যেন পৃথিবীর আর কিছুই অবশিষ্ট রাখবে না। এমন এক ভয়ানক দম আটকানো পরিবেশে দু’বার ব্যাঙ ডাকার আওয়াজ পেল রবি। এই কর্কশ রিংটোন টা অনেক দিন আগে ম্যাসেজ টোন দিয়ে রেখেছিল। হঠাৎ ঘুম টা ভেঙে যাওয়ায় সমস্ত শক্তি দিয়ে মোবাইল টা চেপে ধরে এক চোখ খুলে মেসেজ টা পড়ার চেষ্টা করছে। “ শুভ পয়দা দিবস – সোহান”
ভাইজান দরজা খুলেন ?
- কে !
- আমি
- আমি কে ?
- পাশের ফ্ল্যাটের বুয়া
- ওহ, আচ্ছা ! দাড়ান একটু ।
ব্যলকুনিতে দাড়িয়ে চা খাচ্ছি আর সকালের স্বপ্ন টা নিয়ে ভাবছি। ৩ টি কাক আর একটা তাল গাছ। আর যেন কি ছিল মনে আসছে না। এত করে মনে করার চেষ্টা করছি কিছুতেই মনে আসছে না। পাশের ঘর থেকে নবাবের চিৎকার –
- রবি, শুনে যা !
- যাব না, কি হইছে বল !
- আজকে কাজি পাড়ায় ২০ টা উইকেট পড়ছে রে, সাবধান, খুব সাবধান। বাহিরে যাস না কিন্তু !
নবাবের কথায় আমার কোন ভ্রূক্ষেপ নাই, ও এমনিতেই পত্রিকা পড়ার সময় চিৎকার করে উঠে, মাঝে মধ্যে মুখ খারাপ করে গালিও দেয় ।
ততক্ষণে আমার সমস্ত মনোযোগ পাথর কুচিটার উপর পড়েছে। কী অদ্ভুত জীব সৃষ্টিকর্তা বানিয়েছেন, পাতা থেকেই জন্ম দিচ্ছে নতুনের।
আমরা যে বাসায় ভাড়া থাকছি তা ৯০ দশকের নামকরা কবজি কাটা আলু মাস্তানের । একটা সময়ে মানুষের হাত পায়ের কব্জি কাটা যার নেশা ও পেশা ছিল। বছর পাঁচেক আগে র্যবের ক্রসফায়ারে মারা গেছে। দুই মে আর এক ছেলে নিয়ে আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে লিজা আন্টি থাকেন। আলু সাহেব মারা যাবার পর থেকেই আন্টি এখানেই থাকেন। লোক মুখে শুনেছি আলু সাহেব নাকি লিজা আন্টিকে জোর করে তুলে এনে বিয়ে করেছিলেন আর খুব নির্যাতন করতেন।লিজা আন্টির সাথে যতটুকু কথা বলেছি, আন্টিকে আমার খুব ভালোই লেগেছে, খুব ভালো মনের মানুষ। তাইতো এত সকাল সকাল বুয়াকে দিয়ে আমদের জন্য ডাল আর কিছু সবজি পাঠিয়ে দিয়েছেন। করোনার এই চলমান দুর্যোগে একজন মায়ের যত খেয়াল রাখছেন। গত রমযান মাসের বাড়ি ভাড়াটাও মওকুফ করেছেন। আমাদের ফ্লাটের সবাই যে যার মত করে গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। শুধু আমি আর নবাব থেকে গেলাম। নবাব অবশ্য চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু শেষমেষ যেতে পারে নাই। কে জানে, হয়ত আমাকে একটু বেশিই আপন করে নিয়েছে। নবাব গত বিসিএস এর ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছে। দ্বিতীয়বারের মত ভাইভা দিয়েছে, তারপরও কোন এক অদৃশ্য কারণে শেষ হাসিটা আর হাসা হয় না তার। এবার মনে মনে পণ করেছে মায়ের জন্য হাসিটা কিনেই তবে বাসায় ফিরবে। সত্যিই আমাদের মত মধ্যবিত্ত পরিবারের হাসির ক্রয়মূল্য অনেক বেশী।
আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় ২৫ লাখ যুবক যুবতী জীবন জীবিকার আশায় শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। এদের মধ্যে মাত্র দেড় লাখ সরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোতে কাজের সুযোগ পায়। বিসিএস নামের সোনার হরিণের পিছনে প্রতি বছর প্রায় ৪ লাখ বেকারের জীবন যুদ্ধ চলে। আজ আমার তিরিশ পাড় হলেও এখনো হাল ছাড়ি নাই। হোম টিউশন করেই এতদিন যাবৎ আমি আর নবাব জীবন যুদ্ধে যুদ্ধ করে চলেছি নিরন্তর। আশা জাগানিয়া কথা হল, দু’জনেই আমরা হরিণটা দেখতে পেয়েছি কিন্তু এখনও আলিঙ্গন করা হয়ে উঠছে না। আমাদের মত মধ্যবিত্ত পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম পিতার কাঁধে এইভাবে নিঃশ্বাস ফেলাটা খুবই বিপদজনক, হতাশারও বটে ! করোনার থাবা অনেকের মত আমাদেরও স্বপ্ন ধূলোয় উড়িয়ে দিচ্ছে। বেকারত্বের জ্বালা থেকে মুক্তি নিয়ে কিছু একটা হওয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা পরিবারের কাছে দিয়েছি। বাবা মায়ের চোখে ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অপেক্ষা আর শেষ হয় না। ঐ দিকে নবাবের ছোট ভাই বছরের শুরুতে দালাল মারফত ৬ লাখ টাকার বিনিময়ে সিঙ্গাপুর পাড়ি জমায় মাসিক ৩৬ হাজার টাকায় নির্মাণ শ্রমিকের কাজ জোটার আশায়। করোনায় এখন নান্নুর আশায় গুড়ে বালি, অন্য শ্রমিকদের মত মরণদশা প্রায়। নান্নুর কোন মত বেঁচে থাকার জন্য তার পরিবারকেই উল্টো টাকা পাঠাতে হয় এখন । বেকারত্ব দূর করতেই হোক অথবা উন্নত জীবনের আশায় হোক সিঙ্গাপুর গিয়ে নান্নুর মত অনেকের স্বপ্নই আজ দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। তারপরও প্রতিবছর প্রায় ৮ থেকে ১০ লাখ শিক্ষিত বেকার, বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য নানা রকম বৈধ অবৈধ উপায় বেছে নিয়ে বিদেশ পাড়ি জমায়। এদের অনেকেই নৌকায় করে সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া ইতালি কিংবা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে লিবিয়া কাতার যায়। দালালদের খপ্পরে পড়ে এদের অনেকেই সর্বস্ব হারানোর পাশাপাশি জীবনও হারায়। আহারে জীবন – নোনা পানিতে দিলি জীবন।
আমার ঘরের পূর্ব দিকের ঐ কোণটায় জানালা খুললেই সূর্যের সরল হাসির সাথে ঢাকাইয়া সাতসকালের কোলাহল প্রবেশ করে। আমার পড়ার টেবিলটায় যখন আমি পুরানো বইয়ের ধূলা ঝারতাম, তখন চোখের সামনেই ধূলামাখা স্বপ্ন গুলো সূর্যের কিরণ পেয়ে চিক চিক করে আমায় আনন্দ দিত। আজকাল এই জানালাটা তেমন খোলাই হয় না। অনেকটা অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও জানালাটা খুলে কি খেয়ালে যেন স্স্ট্যাচু হয়ে দাড়িয়ে কিসের ভাবনায় পড়ে গেলাম । এক বিশাল দৈত্যাকার মেট্রো রেলের কর্মযজ্ঞ বক্র হয়ে আমার জানালার সামনের সরল কিরণকে গ্রাস করেছে। তাই আমার চিক চিক করা রঙিন স্বপ্ন গুলো আজ যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। জানুয়ারিতে মাকে ঢাকায় এনেছিলাম চোখের ভালো একজন স্পেশালিস্ট দেখানোর জন্য। মেট্রো রেলের বিশালতা হা করে দেখতে দেখতে আমাকে অবুঝের মত বলেই ফেললেন,
- হাঁ রে খোকা, এইটার উপর দিয়ে কিভাবে ট্রেন যাবে রে ! চালু হলে আমাকে একবার নিয়ে আসবি তো।
- কেন ? চড়বা !
- আরে না, দেখব, কিভাবে উড়ে !
আমার মা তার এই ৫০ বছরের জীবনে এই প্রথম বার ঢাকায় এসেছেন সেও কিনা চলমান উন্নয়ন দেখে বসবাসের অযোগ্য এই শহরে দ্বিতীয় বার আসার ইচ্ছা প্রেষণ করেছে। আসলে উন্নয়ন যদি নিভৃতে না হয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞের মত দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়, তবে যে কেউ চলমান উন্নয়নকে হা করেই গিলবে। ১৫ বছর আগে আমিও প্রথম ঢাকায় এসেছিলাম। সেকালের ঢাকা আর আজকের ঢাকার কি কোন মিল আছে ! না, একেবারেই নেই। প্রশস্ত রাস্তা, তিন চার লেন বিশিষ্ট এতসব ফ্লাইওভার, চোখ ধাঁধানো রাস্তার দুপাশে এতসব আউটলেট ছিল না। এখন উন্নয়ন তো চোখে এসে ধরা দেয়। তবে আমার খুব ভালো মনে আছে মণিপুর স্কুলের পাশে যে ছাত্রাবাসটিতে তখন থাকতাম, সেই গলিতে একটু বৃষ্টি হলেই নৌকা ভাসত। ৫ টাকা ভাড়ায় গলির মুখ পাড়াপাড়। আমার বাসার বিপরীতে ডানপাশে চাইনিজ রেস্টুরেন্টটা এখনও আছে। এখনও গভীর রাত পর্যন্ত ঝলমলে আলো জ্বলে। আমাদের মোড়ের চায়ের দোকানী জসিম চাচার ছেলেটা সেখানে চাকরি করত। সেদিন জসিম চাচা বড় আফসোস করেই ছেলের চাকরি হারানোর কথাটা বলছিলেন।জসিম চাচার ছোট মেয়েটারও বিনা নোটিশে বোনাস ছাড়াই ঈদের আগে গার্মেন্টসের চাকরি খোয়া গেছে। সেদিন জসিম চাচার চোখের নোনা জলটা দেখতে পাই নাই শুধু কষ্টটা বুঝেছিলাম।
আমাদের অর্থনীতি শহর কেন্দ্রীক যে কাঠামোর উপর দাড়িয়ে আছে তার পুরোটাই আজ অচল প্রায় । প্রায় প্রতিদিনই কলকারখানা বন্ধ হচ্ছে, শ্রমিক ছাটাই হচ্ছে, মানুষ কর্মহীন হচ্ছে, বেকারত্ব বাড়ছে। অর্থনীতি সমিতির সভাপতি শ্রদ্ধেয় আবুল বারাকাত স্যার তার গবেষণায় বলেছেন, “ করোনা মহামারির ৬৬ দিনের মাথায় প্রায় সাড়ে তিন কোটি লোক কাজ হারিয়েছেন “
সামনের দিনগুলোতে যেটা ঘটতে চলেছে তা আরও ভয়ানক মনে হচ্ছে । করোনায় শুধু মানুষ আক্রান্ত হয়ে মারা পড়ছে শুধু তা নয়, ধনী গরিব সব শ্রেণীর মানুষের প্রবাহমান আয়ের গতি কমেছে। প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে দাড়াতে যাচ্ছে। প্রতিদিন কর্মহীন মানুষের সংখ্যার অনুপাতে তীব্র বেকারত্ব বাড়ছে। চাকুরিজীবী হতে ব্যবসায়ী কিংবা বিনিয়োগকারী অথবা উৎপাদনমুখি কোন জীবিকা সবকিছুই আজ স্থবির। আমাদের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী খারাপ প্রভাব পড়তে যাচ্ছে। আমাদের দেশের প্রায় ৫ কোটি জনশক্তি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত যাদের হাত চলে তো পেট ভরে। আমাদের ছাত্রাবাসের বুয়াটাই তো দু’মাস যাবৎ কর্মহীন। চানরাতে এসেছিল ঈদ সালামি নিতে। কেমন আছেন খালা জিঞ্জেস করতেই কান্নাকাটি শুরু করে দিল। তার স্বামীটা ভাড়ায় রিক্সা চালাত, গত আম্পানের রাতে কিভাবে যেন রিক্সাটা চুরি হয়ে যায়। সেজন্য মালিকে নাকি খুব মারছে। জমানো ২৫০০ টাকা দিয়ে স্বামীকে ছাড়িয়ে আনতে হয়েছে খালার। এদের কাছে ২৫০০ টাকা পঁচিশ হাজার সমান। গ্রাম থেকে উঠে আসা সহজ সরল এই মানুষ গুলি মায়াহীন এই যান্ত্রিক শহরের বস্তিগুলোতে কিভাবে যেন খুব সহজেই নিজেদের মানিয়ে নেয়। নারীদের হাতের থেকে মনের জোরটা হয়ত সবচেয়ে বেশি। তা নাহলে ১২ হাজার ডলারের রপ্তানি আয় দিয়ে শুরু হওয়া পোষাক শিল্প ৪০ বছর পর কিভাবে ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলারে পরিণত হয়। ৪০ বছর পর এই পোষাক খাতেই এখন কয়েকশ কোটিপতি হয়েছে, বেড়েছে শুধু লাখ লাখ শ্রমিক। অথচ করোনার শুরুতে এদের জীবন জীবীকা নিয়ে মালিকপক্ষের কি নাটকটাই না দেশবাসী দেখল। চাকরি হারানোর ভয়ে শ্রমিকেরা শত কিলোমিটার পায়ে হেঁটে, ভ্যনে চড়ে কাজে যোগ দেয়। এইসব অবহেলিত শ্রমিকদের করোনা ছুতে পারে না কারণ জীবাণুনাশকের থেকেও শক্তিশালী ঘাম দিয়ে সর্বক্ষণ তাদের শরীর ভেজা থাকে। আর এখন তো ছাটাই হওয়ার উৎকণ্ঠায় রুবিনা সালমাদের শরিরের লোনা ঘাম শরীর নিজে থেকে শুষে নেয়।
জীবন বাঁচানোর আশায় জীবন সাজানোর কথা ভুলেই যায় অনেকে। আমিও হয়ত এদের দলে। অনেকদিন পেরিয়ে গেল দেখা করা হয় নাই একজনের সাথে। দেখা করেই বা কি হবে? বেশ কয়েকবছর ধরে তো অপেক্ষার প্রহর গুনছে। আর কতই বা করবে ! চাপা একটা অভিমান কাজ করছে নিজের উপর। ৪ দিন কেটে গেল কোন ফোন দেয় না।
নবাবের রান্নার হাত খুবই ভালো, রান্না ঘর থেকে ময়াবি ঘ্রাণ আসছে । আজও মনে হয় শুটকি ভুনা করছে। খিচুড়ি টা আজ যমপেশ খাওয়া হবে। এখন আমার একটা নতুন অভ্যাস হয়েছে, আঙুলের সাথে জ্বিহ্বার সুন্নত আদায় করি।
জীবনে এমন একটা ঈদ কাটালাম, যেটা আমার সারাজীবন মনে থাকবে । ঈদের নামাজ পড়েছি নিচতলার গ্যারেজ ঘরে। নমায শেষে আমি আর নবাবই শুধু কোলাকুলি করেছি আর বাকি জন সাতেক আমাদের দিকে এমন হা করে তাকিয়ে ছিল যেন পৃথিবী উল্টিয়ে ফেললাম। ঈদের দিন মানুষ সেমাই পায়েস খেয়ে নামাজে যায় আর আমরা খেয়েছি ডিম ভাজি আর ভাত। অবশ্য লিজা আন্টি দুপুরে বুয়াকে দিয়ে রুটি মাংস পাঠিয়েছিলেন। রুটি মাংস খাওয়ার সময় আমি আর নবাব একটুও কাঁদি নাই, শুধুই নিরবতা পালন করেছি।
ঢাকা ছেড়ে অনেকেই গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন। এদের অনেকেই গ্রামে পরিবার রেখে জীবিকার উদ্দেশ্যে আবার ঢাকায় ফেরতও এসেছেন। চার তলার মেজবা ভাই পরিবার গ্রামে রেখে আজ ফিরেছেন। এই বিল্ডিং এর যে কয়েকজনের সাথে আমার কথা হয় তন্মধ্যে মেজবা ভাই লোকটা অত্যন্ত ভদ্র, মিশুক আর স্রোতের বিপরীতে চলা এক সাহসী মানুষ। এজন্যই হয়ত লোকটাকে আমার নিজের বড় ভাই মনে হয়। ঢাকা ভার্সিটি থেকে ইংরেজিতে অনার্স, মাস্টার্স পাশ। ছাত্র জীবনে অনেক টিউশন করেছেন, মাঝে কিছুদিন ডেসটিনির পিছনে সময় দিয়ে প্লাটিনাম মেম্বারও হয়েছিলেন। আজ ডেসটিনি নেই ওনার মেম্বারশিপও নেই, লাখ খানেক টাকায় কেনা শত শত গাছও নেই। ঘুষ দিয়ে চাকরি করবেন না তাই চাকরির পেছন পেছন তেমন ছুটেন নাই। জমানো কিছু টাকা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেছেন,অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে ট্রেড করেন। শেয়ার পাড়ায় খুব অল্প দিনেই ভালো নাম ডাক হয়েছে তার। মেজবা ভাইয়ের স্বপ্নে করোনার ছোবল বসল, সব হিসাব যেন উলট পালট করে দিল। ক্ষুদ্র, মাঝারি বিনিয়োগকারীরা বড় বড় ব্যবসায়ীদের গ্যম্বলিং এর শিকারে সর্বস্বান্ত । বেশ কিছুদিন ধরেই শেয়ার মার্কেট বন্ধ হয়ে ইতিহাসের সর্বনিকৃষ্ট বাজারে পরিণত হয়েছে। তাই মেজবা ভাইয়ের কপালেও যোগবিয়োগের ভাজ পড়তে শুরু করেছে। বেঁচে থাকার তাগিদে মনে মনে হয়ত বিকল্প পেশার খোজ করছেন।
চারিদিকে এত অসহায়ত্ব, কষ্ট দেখে আমারও আর কিছু ভালো লাগছে না। মায়া মমতাহীন এই শহরে আমিও আর স্বপ্ন কুড়াতে চাই না ।
গ্রামেই চলে যাব,পড়ালেখা শিখে কৃষিবিদ হয়েছি না হয় শিক্ষিত কৃষকই হব । গ্রামের মানুষের চাওয়ার প্রবণতা কম, তাই পাওয়ার হিসেবেটাও সরল। আর এই কারণেই গ্রামীণ জীবন জীবিকা এখনও স্বাভাবিক।
কর্মসংস্থান বৃদ্ধি কিংবা বেকারত্ব ঘোচানো যেটাই বলি না কেন আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতির দিকে নজর দিতে হবে। আমাদের কি নেই –
ধান উৎপাদনে ইন্দোনেশিয়াকে টপকিয়ে এখন আমরা তৃতীয় অবস্থানে । সবজী উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়, মাছ উৎপাদনে ৪র্থ, আম উৎপাদনে ৭ম, ছাগল উৎপাদনে আমরা ৪র্থ, আজ আমরা মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ । গোটা বিশ্বে ফসলের জাত উৎপাদনে শীর্ষে আমরা । আমাদের আর কি লাগবে। প্রাচুর্যে ভরপুর আমাদের মাতৃভূমি।
চলমান দুর্যোগে আমাদের দেশের গ্রাম গুলোতে করোনার প্রভাব এখনও তেমনভাবে পড়ে নাই। আমাদের দেশের শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীকে গ্রামীণ অর্থনীতিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে হবে। আমরা গ্রামীণ অর্থনীতি বিকশিত করার মাধ্যমে দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যত দুর্যোগ মোকাবেলা করতে পারি। এক সময় আমরা মাছে ভাতে বাঙালী ছিলাম, আজ আমরা পুষ্টিতে বাঙালি হয়ে বিশ্বদরবারে পরিচিতি পেতে চাই।