ড. মো. আনোয়ার হোসেন : জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে বর্তমান করোনা মহামারি পরবর্তী খাদ্য সংকট মোকাবেলায় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই। তারজন্যে প্রয়োজন কৃষি উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সকল ক্ষেত্রে টেকসই যান্ত্রিকীকরণ। গবেষণায় দেখা গেছে, চাষাবাদে শক্তির ব্যবহার বাড়লে ফসলের ফলন বৃদ্ধি পায়। তাই চাষাবাদে শক্তির ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন। তাছাড়া কৃষির মানোন্নয়ন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, পুষ্টি এবং নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থা নিশ্চিতকল্পে ফসল উৎপাদনে লাগসই কৃষি যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির ব্যবহার এখন সময়ের দাবি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, আর কমছে কৃষি জমি। অল্প জমি থেকে ক্রমবর্ধমান জনগণের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা মেটানোর জন্য প্রয়োজন অল্প সময়ে বেশি পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন। খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ভালো বীজ, সার, সেচ ও বালাই ব্যবস্থাপনাই যথেষ্ট নয়, পাশাপাশি প্রয়োজন লাগসই কৃষি যন্ত্রপাতি। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রকৃতি নির্ভর কৃষিকে প্রযুক্তি অর্থাৎ যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে কৃষির উৎপাদনশীলতা ও শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধি করে তা টেকসই করতে হবে। কৃষিকে লাগসই যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করতে হবে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিইটউট ইতোমধ্যে ব্যাপক ভিত্তিক আমন ধান আবাদের বিশদ পরিকল্পনা গ্রহন করত: কাজ করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফার্ম মেশিনারি এন্ড পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ উদ্ভাবিত কৃষি যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি দেশের কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখে আসছে। বিশেষ করে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধানের চারা রোপণ যন্ত্রের মাঠ প্রদর্শনী, ম্যাট টাইপ চারা উৎপাদন কলাকৌশল উদ্ভাবন এবং অপারেটর প্রশিক্ষণ অন্যতম। তাছাড়া দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্রি উদ্ভাবিত ম্যানুয়াল এবং শক্তি চালিত রাইস ট্র্যান্সপ্লান্টারের মূল্যায়ন এবং মানোন্নয়নের কাজ চলমান আছে। বিভিন্ন সরকারী এবং বেসরকারী সংস্থার উদ্যোগে মাঠ পর্যায়ে প্রায় ৯০০-১০০০ রাইস ট্রান্সপ্লান্টার বিদ্যমান আছে। আমন মওসুম শুরু হওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় মেরামত করে নিতে হবে যাতে রোপণকালীন সময়ে সমস্যায় পড়তে না হয়। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে কার্যকর রোপণের পূর্বশর্ত হলো সঠিক ভাবে মেশিনের উপযোগী ধানের চারা উৎপাদন। মেশিনে রোপণের উপযোগী চারা বিশেষ ভাবে উৎপাদন করতে হয় যা “ম্যাট টাইপ” চারা হিসাবে পরিচিত।
আমন মওসুমে ধান চাষাবাদের জন্য সাধারণত ১৫ আষাঢ় – ১৫ শ্রাবণ (২৫ জুন – ২৫ জুলাই) বীজ বপন করা হয়। উক্ত সময়ে আবহাওয়া উষ্ণ থাকায় ম্যাট টাইপ চারা তৈরিতে কোনো সমস্যা হয় না। তথাপি ম্যাট টাইপ চারা তৈরির কিছু প্রয়োজনীয় কারিগরী বিষয় জানা থাকা দরকার। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধানের চারা লাগানোর জন্য ট্রে অথবা পলিথিনের উপর আমন মওসুমে ১৫-১৮ দিন এবং বোরো মওসুমে ২৫-৩০ দিন বয়সের চারা উৎপাদন করতে হয়। যে কারণে ধানের জীবনকাল মাঠে বেশীদিন দীর্ঘায়িত হয়। ফলে ধানের গোছায় বেশি সংখ্যক কার্যকরী কুশি উৎপন্ন হয়।
প্লাষ্টিকের রিজিড/ফ্লেক্সিবল ট্রে অথবা পলিথিনের উপর ম্যাট টাইপ চারা তৈরি করতে হয়। ঝুরঝুরে দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটি ম্যাট টাইপ চারা তৈরির জন্য উপযোগী। প্রয়োজনমতো জৈব সার মাটির সাথে মিশ্রণ করা যেতে পারে। ট্রে অথবা পলিথিনের উপর ২০ মিলি অথবা পৌনে এক ইঞ্চি গভীরতায় ঝুরঝুরে মাটি ছড়িয়ে দিতে হবে। ছড়িয়ে দেয়া মাটির উপর ধানের জাত এবং অঙ্কুুরোদগমের হার অনুযায়ী ১২০ থেকে ১৪০ গ্রাম পরিমাণ বীজ প্রতি ট্রেতে সমঘনত্বে ছিটিয়ে দিতে হবে। চিকন ও লম্বা ধানের ক্ষেত্রে ১২০, মাঝারি ধানের ক্ষেত্রে ১৩০ এবং মোটা ও খাটো ধানের ক্ষেত্রে ১৪০ গ্রাম বীজ বপণ করতে হবে। একটি ট্রের ক্ষেত্রফল পৌনে দুই বর্গ ফুট (১.৭৫ বর্গফুট)। পলিথিনে বীজ বপনের ক্ষেত্রে ১.০ বর্গফুট জায়গায় চিকন ও লম্বা ধানের ক্ষেত্রে ৭০, মাঝারি ধানের ক্ষেত্রে ৭৫ এবং মোটা ও খাটো ধানের ক্ষেত্রে ৮০ গ্রাম হিসেবে বীজ বপণ করতে হবে। ট্রের উপর বীজ ছড়িয়ে দেয়ার পর ঝুরঝুরে মাটি দ্বারা হালকা করে ঢেকে (৩-৫ মিলি গভীরতায়) দিতে হবে। তারপর ঝরনার মাধ্যমে হালকাভাবে সেচ দিতে হবে যাতে ট্রের সম্পূর্ণ মাটি সিক্ত হয়। তবে ট্রে/পলিথিনের উপর কাঁদা মাটির মাধ্যমে চারা তৈরির ক্ষেত্রে বপনকৃত বীজ মাটি দ্ধারা ঢাকার প্রয়োজন নেই। আমন মওসুমে শুকনা ঝুরঝুরে মাটি সংগ্রহ সমস্যা বিধায় মূল জমিতে কাঁদা মাটি দিয়ে চারা উৎপাদন করাই শ্রেয়। কাঁদা মাটির মাধ্যমে ট্রে/পলিথিনের উপর ম্যাট টাইপ চারা তৈরির জন্য প্রথমে সমতল এবং শক্ত ভূমিতে পলিথিন বিছাতে হবে বা ট্রে স্থাপন করতে হবে, পলিথিন/ট্রের উপর এক ইঞ্চি গভীরতায় কাদা মাটি ছড়াতে হবে অথবা পৌনে এক ইঞ্চি গভীরতায় শুকনো মাটি ছড়াতে হবে, সম-ঘনত্বে উল্লেখিত মাত্রায় বীজ বপন করতে হবে এবং বীজ বপনের ৭ দিন পর হতে চারার গোড়া পর্যন্ত সেচ প্রয়োগ করতে হবে।
চারা তৈরির জন্য ব্যবহৃত বীজ ধানের অঙ্কুরোদগমের হার ৯০ ভাগ বা আরো বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয়। বীজ ধানের অঙ্কুুরোদগমের হার কম হলে আনুপাতিক হারে বীজের পরিমান বাড়াতে হবে। সমভাবে সেচ দেয়ার জন্য প্লাষ্টিকের রিজিড/ফ্লেক্সিবল ট্রে অথবা পলিথিন সমান জায়গায় স্থাপন করতে হবে। মূল জমিতেই ট্রে অথবা পলিথিন স্থাপন করা উত্তম। চারার উচ্চতা, ঘনত্ব এবং ট্রে/পলিথিনের উপর মাটির পুরুত্ব যান্ত্রিক পদ্ধতিতে রোপণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধানের চারা রোপণের জন্য ২-৩ পাতা বিশিষ্ট ১২০-১৫০ মিমি উচ্চতার চারা, প্রতি বর্গ সেমি এ ৩-৪টি চারা এবং ট্রে/পলিথিনের উপর ২.০-২.৫০ সেমি মাটির পুরুত্ব রাখলে রোপনের সময় কোন মিসিং হয়না।
বাংলাদেশের কৃষিতে বর্তমান শ্রম সংকট বিবেচনা করে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার একটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রযুক্তি। উক্ত প্রযুক্তির সফল প্রয়োগের মাধ্যমে ধান চাষাবাদ টেকসই যান্ত্রিকীকরণের দিকে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
লেখক: ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফার্ম মেশিনারি এন্ড পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট, গাজীপুর-১৭১০