বৃহস্পতিবার , ডিসেম্বর ১৯ ২০২৪

কোভিড-১৯, কৃষি ও কৃষিবিদ

ড. মো. তাসদিকুর রহমান সনেট : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি ছোট দেশ বাংলাদেশ। ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটারের এই দেশটি সমগ্র বিশ্বে উন্নয়ন ও অগ্রগতির রোল মডেল হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের উন্নয়নে যুগের পর যুগ ধরে অবদান রেখে চলেছে কতিপয় সেক্টর। এই সেক্টরগুলো হচ্ছে তৈরী পোষাক শিল্প, রেমিটেন্স ও কৃষি। দেশিও আয়ের সিংহভাগ আসে এই তিনটি খাত থেকে। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বাংলাদেশের জিডিপি-তে তৈরী পোষাক শিল্পের অবদান প্রায় ১৬%, রেমিটেন্স খাতের অবদান প্রায় ৪.৯৩% এবং কৃষি খাতের অবদান প্রায় ১৩.৬৫% । দেশটির উন্নয়নে এই তিনটি সেক্টরের দৃশ্যত অবদান ক্রমান্নয়ে বেড়ে যাবে এমনটাই ধারণা ছিল সকলের মনে। কিন্তু ২০১৯ সালের শেষভাগে চীনে যে কোভিড-১৯ সংক্রমণ হয় তা পরবর্তীতে ছড়িয়ে পরে সমগ্র বিশ্বে। আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমিও এর বাইরে নয়। ২০২০ সালের ৮ই মার্চ বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগী ধরা পরে। এর পর ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে আক্রান্তের সংখ্যা। কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন অনেকে।

জুলাই ০৮, ২০২০ পর্যন্ত বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা দাড়িয়েছে ১,৭২,১৩৪ জন ও মৃতের সংখ্যা দাড়িয়েছে ২১৯৭ জনে। বাংলাদেশের কোভিড-১৯ সংক্রমণ মোকাবেলায় এগিয়ে এসেছে সকল ন্তরের পেশাজীবীরা। যাদের মধ্যে অগ্রগন্য ভূমিকা পালন করছে ডাক্তার, নার্স, পুলিশ বাহিনী, প্রশাসন ক্যাডার ও সকল স্তরের কৃষিবিদগণ। এ সকল পেশাজীবীরা যেমন নিরলসভাবে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন সাধারণ জনগণের সেবায় তেমনি নিজেরাও আক্রান্ত হয়েছেন বা হচ্ছেন এই সংক্রামক ব্যাধিতে।

কোভিড-১৯ সংক্রমনজনিত কারনে দেশের উন্নয়নের চাকা সচল রাখতে এবং জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় সীমিত পরিসরে কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। বিশ্ব ব্যাপী কোভিড-১৯ সংক্রমনের দরুন বিশ্ব বাজারে আমাদের তৈরী পোষাক শিল্পের চাহিদা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে কোভিড-১৯ সংক্রমনের কারনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশীরা দেশে চলে আসছেন অথবা রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। তৈরী পোষাক শিল্পের চাহিদা কমে যাওয়ায় বেকার হচ্ছে দেশের শ্রমজীবীদের একটি বৃহৎ অংশ। অন্যদিকে প্রবাসীরা দেশে ফেরত আসায় বেকারত্বের পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্য দুইটি খাতের চেয়ে কৃষি ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা সহজ হবে। এই বেকার জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই থাকেন গ্রামাঞ্চলে। কৃষিতে বিশাল এই জনসংখ্যাকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে খাদ্য-নিরাপত্তার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্র তৈরীতে অবদান রাখতে পারবে।

বর্তমান সরকার কোভিড-১৯ মোকাবেলায় ও এর পরবর্তী সংকট মোকাবেলায় হাতে নিয়েছে নানাবিধ উদ্যোগ। বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশে। আজও দেশের অধিকাংশ জনগন এই আদি ও অকৃত্রিম পেশায় জড়িত। তাই বর্তমান সরকার কোভিড-১৯ আপদকালীন সময় ও এর পরবর্তী সময়ের সংকট মোকাবেলায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশের কৃষির উপর। তারই প্রেক্ষিতে ২০২০-২১ এর বাজেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কৃষি সেক্টরের জন্য। বাংলাদেশের বর্তমান কৃষি বান্ধব সরকার খুবই দ্রুত অনুধাবন করেছে যে এই আপৎকালীন সময়ে কৃষিই পারে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে। যেখানে করোনা আপৎকালীন সময়ের শুরুতে ধারণা করা হচ্ছিল যে দেশে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। সে সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলায় রেখেছে এক অনবদ্য নিদর্শন। চলতি মৌসুমে কৃষক পর্যায়ে অর্ধেক মূল্যে কম্বাইন্ড হারভেস্টার বিতরণ করা হয় যার দ্বারা অতিদ্রুত ধান উত্তোলন নিশ্চিত হয় এবং বাংলাদেশে রেকর্ড পরিমান ধান উৎপাদন হয়।

২০১৯-২০ মৌসুমে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোভিড-১৯ মোকাবেলায় কৃষির উপর জোর দিয়ে বলেছেন যে দেশের আবাদযোগ্য এক ইঞ্চি জমিও যেন বাদ না থাকে। কোভিড-১৯ সংক্রমন পরবর্তী সময়ের প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে দেশের জনগনের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বর্তমান সরকারের গৃহীত সকল পদক্ষেপ সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করা যাবে। আর এই সকল পদক্ষেপ বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে দেশের সকল কৃষিবিদ ও কৃষকগণ। দেশের বর্তমান বেকার সমস্যা সমাধানে কৃষি খাত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করতে পারবে। পৃথিবীর অনেক দেশেই অতীতের পেশা কৃষিতে আবার ফিরে গিয়েছে।

বর্তমানে দেশের কৃষির সাফল্যের নেপথ্যে যারা নিরলস শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন তারা হচ্ছেন কৃষক ও সকল স্তরের কৃষিবিদগণ। বর্তমানে আপৎকালীন সময়ে দেশের খাদ্য যোগানে কৃষিবদগণ কৃষি কাজের বিভিন্ন প্রযুক্তি কৃষকদের মাঝে পৌছানোর জন্য মাঠ পর্যায়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। কৃষিবিদগণ কৃষকদের সেবা প্রদানের জন্য কোভিড-১৯ সংক্রমনের ঝুঁকি নিয়েই নিজেদের সর্বদা নিয়োজিত রেখেছেন। ইতোমধ্যে ১৬৪ জন কৃষিবিদ কোভিড-১৯ এ সংক্রমিত হয়েছেন এবং এর মধ্যে মারা গিয়েছেন ১৪ জন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ ড. আব্দুল মুঈদসহ ৭৭জন কৃষিবিদ সুস্থ হয়েছেন। আরো ৭৪জন কৃষিবিদ বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন। দেশের অন্যান্য পেশাজীবীগণের ন্যায় কৃষিবিদগণ সম্ভাব্য খাদ্য সংকট মোকাবেলায় নিজেদের সর্বদা নিয়োজিত রেখেছেন।

কৃষিবিদ ও কৃষকরাই পারেন দেশের এই সংকটকালীন সময়ে দেশের জনগনের খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলায় সর্বোচ্চ অবদান রাখতে। দেশের জনগনের খাদ্য ঘাটতি ও সুষম খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে প্রয়োজনীয় খাদ্য শস্য ও শাক-সবজি উৎপাদনের জন্য সকল স্তরের কৃষিবিদগণ ও কৃষকরা নিরলসভাবে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন ও পরবর্তীতেও নিজেদের নিয়োজিত রাখবেন। তাই অন্যান্য পেশাজীবীদের ন্যায় কৃষিবিদদের কে সরকারি প্রণোদনার আওতায় আনা প্রয়োজন। কৃষিবান্ধব সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট আকুল আবেদন ও প্রত্যাশা তিনি সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক কাজ করতে গিয়ে যেসব কৃষক ও কৃষিবিদগণ আক্রান্ত হয়েছেন বা জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদেরকে সম্মুখযোদ্ধা ঘোষণা করে প্রয়োজনীয় সহায়তা ও প্রণোদনা প্রদান করবেন।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, কৃষিবিদ ইনিস্টিটিউট, ঢাকা মেট্রোপলিটন।

This post has already been read 4922 times!

Check Also

ডিম ও মুরগির বাজার স্থিতিশীলতায় দরকার  “জাতীয় পোল্ট্রি বোর্ড” গঠন

কৃষিবিদ অঞ্জন মজুমদার : পোল্ট্রি শিল্পের সাথে আন্ত:মন্ত্রনালয়, আন্ত:অধিদপ্তর  এবং উৎপাদন ও বিপননে ডজনের উপরে …