শনিবার , নভেম্বর ১৬ ২০২৪

কৃষি শিক্ষা ও গবেষণায় আরো বেশি জোর দিতে হবে

ড. তাজুল ইসলাম চৌধুরী তুহিন : রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে সবুজ শ্যামলের গ্রাম খ্যাত শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। উপমহাদেশের প্রাচীনতম কৃষি শিক্ষার এই প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাস অনেক পুরোনো হলেও ২০০১ সালের এই দিনে (১৫ই জুলাই) এর ভিত্তি প্র¯তর স্থাপন করা হয়। কৃষি শিক্ষা ও গবেষনাকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে নিতেই রাজধানীর বুকে কৃষি শিক্ষার অন্যতম এ বিদ্যাপিঠটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ কথা অনস্বীকার্য যে, দক্ষ কৃষিবিদ তৈরি করে দেশের খাদ্য সংকট নিরসনে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। আজ এ বিশ^বিদ্যালয়টি ১৯ বছর পেরিয়ে ২০ বছরে পদার্পন করছে। করোনাকালীন এ সময়ে অনেকটা অনাড়ম্বরভাবে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপিত হলেও এ প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা দেশ-বিদেশের হাজারো কৃষিবিদ ফেসবুকের নানান ইমুজি ব্যবহার করে যেন নিজের ভালবাসার কথা জানান দিচ্ছেন।

বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হচ্ছে, খাদ্য রপ্তানি করার সক্ষমতা আমরা অর্জন করছি। ধান উৎপাদনে আমরা বৈশ্বিক গড়কে পেছনে ফেলে পৃথিবীতে তৃতীয় স্থান অর্জন করে নিয়েছে। চাল রপ্তানি করছি সার্কভুক্ত কয়েকটি দেশে। প্রবাসীরা দেশের বাইরে থেকেও স্বাদ পাচ্ছে দেশের চালের। ফল ও সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ শুধু সাফল্যই নয় বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। আমাদের সু-স্বাদু আম এখন ইউরোপে যাচ্ছে। তাছাড়া বেশ ক’বছর থেকেই বাংলাদেশ সফলতার সাথে সবজি রফতানি করছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। প্রাণীজ আমিষ উৎপাদন অনেক বেড়েছে, ডিম-দুধের যোগান বেড়েছে এই খবরগুলি আমাদের খুবই আশাজাগানিয়া।

এত সব ভাল খবরের পরেও আমরা স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরেও কৃষকের পরিশ্রমের সঠিক মূল্য দিতে ব্যর্থ হয়েছি। অন্য যেকোনো পেশা থেকে কৃষকের আয় অনেক কম বাংলাদেশে। কৃষককে আমরা তার দুর্যোগকালীন বা আপদকালীন সময়ে নিরাপত্তা দিতে পারিনা। আম্পান এর মত নানান দূর্যোগে কৃষকেরা শুধু সর্বশান্তই হয়। আর এরপর আবার নতুন আশায়, নতুন স্বপের জাল বুনে ঘুরে দাŧড়ানোর চেষ্টার-এ সংগ্রামী জীবন যেন কখনও শেষ হবার নয়। অন্যদিকে সর্বশান্ত দিয়ে ফসল ফলিয়েও অনেক ক্ষেত্রেই উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। আর এ ভাবেই প্রতিনিয়ত জীবন যুদ্ধের সাথে সংগ্রাম করে বেŧচে থাকে আমাদের প্রান্তিক কৃষকরা। এ অবস্থা হতে উত্তোরণ না হলে, কৃষককে তার প্রাপ্য জায়গায় সম্মান দিতে না পারলে কখনই তাদের মুখে হŧাসি ফোটানো সম্ভব হবেনা। এছাড়া প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে আমাদের কৃষকরা এখনও অনেক পিছিয়ে। আধুনিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষনের মাধ্যমে আমরা তাদেরকে শিক্ষিত করতে না পারলে এগিয়ে নেওয়া ও সম্ভব হবে না। আর আপামর এই কৃষকদের  উন্নয়ন সাধনে অন্যতম ভূমিকা পালন করা করছে শেরেবাংলা কৃষি বিশ^বিদ্যালয় থেকে পাস করা গ্র্যাজুয়েটরাই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান সমস্যার মাঝে যুগপোযোগি গবেষণার সমস্যা একটি মারাতœক সমস্যা। একদিকে জমির অভাব আর অন্যদিকে উন্নত বিশেষায়িত ল্যাব আজ ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই বলে কি গবেষণা কার্যক্রম থেমে আছে? না, বিশ্ব যখন এগিয়ে যাচ্ছে জ্যামিতিক গতিতে আর আমরা এগুচ্ছি গানিতিক গতিতে। তবে নানান হতাশার মাঝেও আশার কথা হলো নেদারল্যান্ডসহ উন্নত কিছু দেশের সহায়তায় আমাদের কিছু ভাল ল্যাব খুব শীগ্রই স্থাপিত হতে যাচ্ছে। যেহেতু রাজধানীর বুকে এ প্রতিষ্ঠানটি মাত্র ৮৭ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত তাই কৃষকের সমস্যা সমাধানকল্পে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন উন্নতমানের বিশেষায়িত ল্যাব কৃষি ক্ষেত্রে নতুন ধার উ¤েœাচন করবে- যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা গবেষণায় আরো বেশি সম্পৃক্ত হয়ে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। কৃষিই যেহেতু আমাদের মূল চালিকাশক্তি তাই কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে সরকারের এ বিষয়ের উপর আরো বিশেষ নজর ও আর্থিক সহযোগিতার প্রয়োজন।

সময় এসেছে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী বিশেষায়িত গবেষণা করে গবেষণালব্ধ ফলাফলগুলো কৃষকের মাঝে ছড়িয়ে দেবার। শুধু উŤপাদন বাড়ালেই হবেনা, উŤপাদিত পণ্যটির সঠিক বিপণনও যেন হয়, সেদিকে আমাদের নজর দিতে হবে। একই সাথে খাদ্যটি যেন নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত হয় তা নিয়ে আমাদের আরো বেশি ভাবতে হবে। মানুষ যেন পুষ্টিগুণ বিবেচনায় নিয়ে খাবার গ্রহন করে এবং খাদ্য নিয়ে প্রচলিত ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে বিজ্ঞান সম্মতভাবে খাবারকে বিশ্লেষণ করতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আর এসব বিষয়ে জোর দেওয়ার জন্য আমাদের শিক্ষা ও গবেষণাকে আরো বেশি ঢেলে সাজাতে হবে। এছাড়া আমাদের কৃষি সেক্টরে আরো কিছু বিশেষায়িত অ্যাক্রিডেটেড ল্যাবরেটরী (Specialized accredited lab.) এখন সময়ের দাবী। অ্যাক্রিডেটেড ল্যাবরেটরীগুলিতে আন্তর্জাতিভাবে স্বীকৃত উপায়ে গবেষণা করা হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট (বারি) এর পেষ্টিসাইড রেসিডিউ ল্যাব (Pesticide residue Lab.) এর ন্যায় রাজধানী ঢাকার শেরেবাংলা কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ে একটি অ্যাক্রিডেটেড ল্যাবরেটরী স্থাপন করে তা কার্যকরী করা গেলে হলে তা হবে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় সরকার এটিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিয়ে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করলে প্রতিষ্ঠানটি দেশের সামগ্রিক অগ্রগতিতে আরো বেশি অবদান রাখতে পারবে।

কৃষি শিক্ষায় ও গবেষণায় শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় উত্তরোত্তর এগিয়ে যাক। দক্ষ কৃষিবিদ গড়ার কাজে আরো বেশি নিয়োজিত থেকে দেশের কৃষি, কৃষক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রত্যাশাই এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের।

লেখক : সহযোগি অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান,কৃষি রসায়ন বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা-১২০৭।

ই-মেইল : mticsau@yahoo.com

This post has already been read 3324 times!

Check Also

বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভিসি হলেন প্রফেসর ড.  মোস্তাফিজ

বশেমুরকৃবি সংবাদদাতা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরকৃবি) নতুন ভিসি হলেন মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের …