ডা. মো. শাহীন মিয়া : ঘাসের জমির স্বল্পতার কারণে যেমন হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ঘাস চাষ করা হয় তেমনি সবুজ শৈবাল বা এ্যালজি চাষ করে ঘাসের অভাব মেটানো যায়।
এ্যালজি একটি সম্ভাবনাময় খাদ্য যা আমরা পশু খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। এ্যালজি হচ্ছে এক থরনের ক্ষুদ্র এককোষি উদ্ভিদ যা কৃত্রিমভাবে পানিতে চাষ করে গরুকে সবুজ পানীয় হিসেবে খাওয়ানো হয়। গরুকে এ্যালজি খাওয়ানোর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই।
এ্যালজির বৈশিষ্ট: এ্যালজি এক ধরনের উদ্ভিদ যা আকারে এককোষী থেকে বহুকোষী বিষাল বৃক্ষের মত হতে পারে। তবে আমাদের আলোচ্য এ্যালজি এককোষী এবং দৃই ধরনের যথা ক্লোরেলা ও সিনেডেসমাস। এরা পানিতে দ্রবিভূত অক্সিজেন, কার্বনডাই-অক্সাইড ও জৈব নাইট্রোজেন আহরণ করে সূর্যালোকে সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় বেঁচে থাকে। এরা অত্যন্ত দ্রুত বর্ধনশীল।
এ্যালজির পুষ্টিমান: শুষ্ক এ্যালজিতে শতকরা ৫০-৭০ ভাগ আমিষ, ২০-২২ ভাগ চর্বি ও ৮-২৬ ভাগ শর্করা থাকে। এছাড়া এ্যালজিতে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন সি ও বিভিন্ন ধরনের বি-ভিটামিন থাকে। কেবলমাত্র ‘সিসটিন’ ছাড়া এ্যালজির প্রোটিনে বিভিন্ন ধরনের এমাইনো এসিডের অনুপাত প্রায় ডিমের প্রোটিনের সমান। জাবর কাটে এমন প্রাণিতে প্রোটিনের পাচ্যতা ৭০-৭৩%।
এ্যালজির উৎপাদন পদ্ধতির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা
১. প্রথমে ছায়াযুক্ত জায়গায় একটি কৃত্রিম পুকুর তৈরি করতে হবে। পুকুরটি ১০ ফুট লম্বা, ৪ ফুট চওড়া এবং ০.৫ ফুট গভীর হবে। পুকুরের পাড় ইট বা মাটির তৈরি হবে। এবার ১১ ফুট লম্বা, ৫ ফুট চওড়া একটি স্বচ্ছ পলিথিন বিছিয়ে কৃত্রিম পুকুরের তলা ও পাড় ঢেকে দিতে হবে। তবে পুকুরের আয়তন প্রয়োজন অনুসারে ছোট বা বড় হতে পারে। এছাড়া মাটির বা সিমেন্টের চাড়িতেও এ্যালজি চাষ করা যায়।
২. ১০০ গ্রাম মাসকলাই বা অন্য ডালের ভূষিকে ১ লিটার পানিতে সারা রাত ভিজিয়ে কাপড় দিয়ে ছেঁকে পানিটুকু সংগ্রহ করতে হবে। একই ভূষিকে অন্তত ৩ বার ব্যবহার করা যায় ও পরে গরুকে খাওয়ানো যায়।
৩. এবার কুত্রিম পুকুরে ২০০ লিটার পরিমান কলের পরিষ্কার পানি, এ্যালজির ঘনত্বের উপর নির্ভর করে ১৫-২০ লিটার পরিমান এ্যালজির বীজ ও মাসকলাই বা ভূষি ভিজানো পানি ভাল ভাবে মিশাতে হবে। অতঃপর ২-৩ গ্রাম পরিমান ইউরিয়া উক্ত পুকুরের পানিতে ভালভাবে মিশাতে হবে।
৪. এরপর প্রতিদিন সকাল, দুপুর ও বিকালে কমপক্ষে তিনবার উক্ত পুকুরের এ্যালজির কালচারকে নেড়ে দিতে হবে। পানির পরিমান কমে গেলে পরিমানমত নতুন পরিষ্কার পানি যোগ করতে হবে। প্রতি ৩ দিন পরপর পুকুর প্রতি ১-২ গ্রাম পরিমান ইউরিয়া ছিটালে ফলন ভাল হয়।
৫. এভাবে ১২-১৫ দিসপর এ্যালজির পানি গরুকে খাওয়ানোর উপযক্তি হয়। এ সময় এ্যালজির পানির রং গাঢ় সবুজ বর্ণের হয়। এ্যালজির পানিকে পুকুর থেকে সংগ্রহ করে গরুকে খাওয়ানো যায়।
৬. একটি পুকুরের এ্যালজির পানি খাওয়ানোর পর উক্ত পুকুরে নিয়ম অনুযায়ী পরিমানমত পানি, সার ও মাসকলাই ভূষি ভিজানো পানি দিয়ে নতুন করে এ্যালজির চাষ শুরু করা যায়। এ সময় নতুন করে এ্যালজির বীজ দেয়ার প্রয়োজন নেই।
৭. যখন এ্যালজি পুকুরে পানির রং স্বাভাবিক গাঢ় সবুজ রং হয়ে যায় তখন বুঝতে হবে যে উক্ত চাষটি কোন কারনে এ্যালজি উৎপাদনের ক্ষেত্রে নিম্নবর্ণিত সাবধানতা অবলম্বন করা উচিৎ।
সাবধানতা
১. এ্যালজির পুকুরটি সরাসরি সূর্যালোকে না করে ছায়াযুক্ত স্থানে করতে হবে।
২. কখনই মাসকলাই ভূষি ভিজানো পানি পরিমানের চেয়ে বেশি দেয়া যাবে না।
৩. এ্যালজি পুকুরের পানিতে নিয়মিত নাড়াচাড়া করতে হবে।
৪. যদি কখনও এ্যালজি পুকুরের পানি গাঢ় সবুজ রং এর পরিবর্তে হালকা নীল রং ধারন করে তবে তা ফেলে দিয়ে নতুন করে চাষ শুরু করতে হবে।
ফলন ও খরচ
উপরোক্ত নিয়মে এ্যালজি উৎপাদন করলে প্রতি ১০ বর্গমিটার পুকুর থেকে প্রতিদিন প্রায় ৫০ লিটার এ্যালজির পানি বা ১৫০ গ্রাম শুষ্ক এ্যালজি উৎপাদন করা সম্ভব। এ হিসেবে এক বছরে উপরোক্ত আয়তনের পুকুর থেকে প্রায় ১৭.৫ টন এ্যালজির পানি উৎপাদন সম্ভব। উৎপাদন করতে সর্বোচ্চ ৫ পয়সা খরচ হতে পারে।
গরুকে এ্যালজি খাওয়ানো
এ্যালজির পানি সব ধরনের গরুকে অর্থাৎ বাছুর, বাড়ন্ত গরু, দুধের গাভী, গর্ভবতী গাভী, হালের বলদ সবাইকেই খাওয়ানো যায়। এ্যালজি খাওয়ানোর কোন বাধা ধরা নিয়ম নেই। এটাকে সাধারণত পানির পরিবর্তে সরাসরি খাওয়ানো যায়। এ ক্ষেত্রে গরুকে আলাদা করে পানি খাওয়ানোর প্রয়োজন নেই। দানাদার খাদ্য ও খড়ের সাথে মিশিয়েও খাওয়ানো যায়। সাধারণত দুই-এক দিনের মধ্যেই পশু এতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। গরু সাধারণত তার ওজনের প্রায় ৮ ভাগ অর্থাৎ ১৫০ কেজি ওজনের গরু ১২ কেজি পরিমান এ্যালজির পানি পান করে। তবে গরমের দিনে এর পরিমান বাড়তে পারে। এ্যালজির পানি গরম করে খাওয়ানো উচিৎ নয়। যদি বেশি গরু যদি সংখ্যাং বেশি হয় তবে পূর্বে বর্ণিত আকারের ৫টি কৃত্রিম পুকুরে এ্যালজি চাষ করতে হবে যাতে একটির এ্যালজির পানি শেষ হতে হতে পরবর্তীটি খাওয়ানোর উপযুক্ত হয়। এ্যালজি চাষের বড় সুবিধা হচ্ছে এর জন্য কোন আবাদী জমির প্রয়োজন নেই। বাড়ীতে যেকোন ছায়াযুক্ত সমতল স্থানে ঘরের ভেতর বা ছাদেও চাষ করা যায়।
কিছু প্রশ্ন এবং তার উত্তর
১/প্রশ্ন :ক্লোরেলা ও সিনেডেসমাস এর বীজ কোথায় কিনতে পাওয়া যায়?
উত্তর:শ্যাওলার বীজ পাবেন সাভারস্থ বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষনা ইন্সটিটিউট (BLRI) থেকে।
২) প্রশ্ন:পুকুরের গভীরতা কি সবসময় ০.৫ ফুট হতে হবে? কারন গভীরতা বেশী করার সুযোগ থাকলে হলে একই পরিমান জমি থেকে শুধু গভীরতা বাড়িয়ে পুকুরের আয়তন বৃদ্ধি করা সম্ভব। একই ভাবে পুকুরের আয়তন যদি ভিন্ন হয় তবে কি পরিমান এ্যালজি বীজ, কি পরিমান মাসকলাই কতটুকু পানির সাথে মিশিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে এবং কি পরিমান বিশুদ্ধ পানি ও মাসকলাই মিশ্রিত পানি পুকুরে সরবরাহ করতে হবে?
উত্তর:পুকুরের গভীরতা বাড়ানোর সুযোগ নেই। কেননা, শ্যাওলাগুলো পানির উপরে ভাসে আর তারা সূর্যালোক ব্যবহার করে, গভীরতা বাড়ালে তারা ঠিকমত সূর্যালোক পাবে না।
গভীরতা না বাড়িয়ে দৈর্ঘ্য-প্রস্থ বাড়িয়ে হিসেব করে দেখুন, কোনটা কতটুকু লাগবে।
৪/প্রশ্ন:এ্যালজি পানি খাওয়ানোর পরও কি গরুকে আগের মতই দানাদার খাদ্য ও খড় খাওয়ানোর প্রয়োজন আছে?
উত্তর:শ্যাওলা কাঁচাঘাসের বিকল্প হিসেবে খাওয়াতে পারবেন। সেক্ষেত্রে দানাদার খাদ্য ও খড়ও খাওয়াতে হবে। তবে মনে রাখবেন, গো-খাদ্যের মধ্যে খড় হচ্ছে সবচেয়ে নিম্নমানের খাদ্য।লেখক: ভেটেরিনারি সার্জন, বিসিএস প্রাণিসম্পদ, চৌদ্দগ্রাম কুমিল্লা। ০১৭১৬ ১৬২০৬১