শনিবার , নভেম্বর ১৬ ২০২৪

বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন ও আমাদের বর্তমান কৃষি

ড. মো. গাজী গোলাম মর্তুজা : করোনা ভাইরাসের প্রভাবে সারা বিশ্ব আজ সংকটময়। এরকম মহামারি পৃথিবী কখনই দেখেনি। এই ছোয়াঁছে রোগের কারণে সারা বিশ্বে মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলছে। করোনা রোগ থেকে বাচঁতে লগডাউনের কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশে মার্চ মাস থেকে শুরু হয়েছে লকডাউন। এই লকডাউনের কারণে সাধারন খেটে খাওয়া মানুষ বিরাট অর্থনৈতিক সংকটে পরেছে। এই বিরাট অর্থনৈতিক সংকটে, আশার আলো হয়ে দেখা দিয়েছে, আমাদের কৃষি। কৃষিই পারে আমাদের বাচাঁতে। এই কৃষির ভীত রচনা করেছিলেন, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন । তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষকের সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন। স্বাধীনতা উত্তর বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, পরবর্তীতে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য আমৃত্যু চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির পথপ্রদর্শক। তিনি শোষণহীন সমাজ গঠনের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তিনি বাংলার প্রত্যেক মানুষের জীবনের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজন আহার, কাপড়, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টির জন্য নিজেকে বিসর্জন দিয়েছেন। বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ে তিনি ছিলেন আপসহীন। বিপন্ন জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তিনি জনগণের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন। এ জন্য সারা জীবন জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন।  ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলেও বঙ্গবন্ধু বিজয়ীর বেশে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ফিরে আসেন স্বাধীন বাংলাদেশে।  জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তিলাভের  জন্য শুরু করেন সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করেছেন, এ দেশের অবহেলিত দরিদ্র কৃষকের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য।

বঙ্গবন্ধু প্রথমে কৃষকদের অধিকারের কথা সাংবিধানিক রূপ দিলেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব হলো মেহনতি মানুষ-কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তি এবং জনগণের মধ্যে পিছিয়ে পড়া অন্য গোষ্ঠীগুলোকে সব ধরনের শোষণ থেকে মুক্তি দেয়া। সংবিধানের ১৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “শহর ও গ্রামের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য ধাপে ধাপে দূর করার উদ্দেশ্যে- কৃষি বিপ্লবের বিকাশ ঘটাতে হবে, শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনগণের স্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রাম অঞ্চলের আমূল পরিবর্তনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে ”

এছাড়া সংবিধানের ১৮ক নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,”রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্যে পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করবে।”

বঙ্গবন্ধু সঠিক ও সার্বিক পরিকল্পনাকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন। ১ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কৃষি সেচ সুবিধায় বেশি বিনিয়োগ ধরা হয়েছিলো। ১৯৭২ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন। সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জন্য ওই খাদ্য পর্যাপ্ত ছিল না। খাদ্য ঘাটতি সংকুলানে বঙ্গবন্ধু সরকার স্বাধীনতার পর ২ বছর খাদ্যে ভর্তুকি প্রদান করেছে।

খাদ্যে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য বঙ্গবন্ধু সবুজ বিপ্লবের সাথে কৃষিকে সম্পৃক্ত করলেন। এর জন্যে দরকার পড়ে উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও সেচ ব্যবস্থার। এইসব উপাদানকে সহজলভ্য করার জন্যে তিনি সরকারি আদলে গড়ে তুললেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৩ সালে ১০নং অ্যাক্টের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। ধান ছাড়া অন্যান্য ফসলের গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। সোনালী আঁশের সম্ভাবনাকে বিস্তৃত করতে প্রতিষ্ঠা করা হয় পাট মন্ত্রণালয়। প্রতিষ্ঠা করা হয় বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, হর্টিকালচার বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, রাবার উন্নয়ন কার্যক্রম, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ গবেষণা সমন্বয়ের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ শিল্পপ্রতিষ্ঠান (রাষ্ট্রীয়করণ) আদেশের ১০ নং অনুচ্ছেদের আওতায় (রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ নং-২৭) বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল করপোরেশন (বিটিএমসি) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭২ সালের ১লা জুলাই থেকে জাতীয়করণকৃত ৭৪ টি মিল নিয়ে বিটিএমসি আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু করে। স্বাধীনতার পূর্বে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলা দিয়ে মিলগুলো পরিচালিত হতো। স্বাধীনতার পর কাচা তুলার অভাবে বস্ত্র মিলগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়।

তুলার ঘাটতি পূরণের জন্য, দেশে তুলাচাষ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১4 ডিসেম্বর কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠা করেন তুলা উন্নয়ন বোর্ড। তিনি বোর্ড গঠন করার পাশাপাশি ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ এলাকায় ৭৯৬ একর জমি তুলা উৎপাদনের জন্য ৩২৫টি পরিবারকে দিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার ভূমিহীন কৃষকদের জন্য ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির বিশেষ আদেশে পরিবারপ্রতি জমির মালিকানা ৩৭৫ বিঘা থেকে কমিয়ে ১০০ বিঘায় নামিয়ে আনেন এবং ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন। ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নং-১৩৫ এর মাধ্যমে নদী কিংবা সাগরগর্ভে জেগে ওঠা চরের জমির মালিকানা রাষ্ট্রের হাতে নিয়ে দরিদ্র কৃষকদের মাঝে বণ্টন করেন। গরিব কৃষকদের রক্ষাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। তিনি  হাট বাজারে ইজারা প্রথার বিলোপ করেন। ১৯৭৩ সালের ৭ নং অ্যাক্টের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা হয় কৃষি ব্যাংক, যাতে কৃষক সহজেই কৃষি ঋণ নিতে পারে; গঠন করা হয় কৃষিতে জাতীয় পুরস্কার তহবিল। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দান করেন। এ জন্য প্রতিবছর ১৩ ফেব্রুয়ারীকে কৃষিবিদ দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান ও জীবনযাত্রার মান নির্ভর করে কৃষি খাতের উন্নয়নের সঙ্গে । দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৪৩ শতাংশের উৎস আমাদের কৃষি খাত। সাম্প্রতিক সময়ে কৃষি খাতে উন্নয়নের কারণে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। স্বাধীনতার ঠিক পরে ১৯৭২ সালে দেশে খাদ্যশস্য উত্পাদন হয় এক কোটি ১০ লাখ টন। এর মধ্যে ধান উত্পাদন হয় ৯৩ লাখ টন। তখন সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্যে ওই খাদ্য পর্যাপ্ত ছিল না। ৪৮ বছরের ব্যবধানে আজ দেশের মানুষ বেড়ে দ্বিগুণের ও বেশী হয়েছে। আবাদি জমি কমেছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। তবে, খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে তিনগুণ। বর্তমানে ৩.৩৮ কোটি টন ধানসহ খাদ্যশস্যের উৎপাদন প্রায় ৪ কোটি টনে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে দানা জাতীয় খাদ্যশস্য, আলু ও শাক-সবজিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ডাল, তেলবীজ, মসলা ও ফল উত্পাদনেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে রোল মডেল। মাছ, মুরগি, ডিম, দুধ ও গবাদি পশুর বাণিজ্যিক উত্পাদনের ক্ষেত্রেও অনেক দূর এগিয়েছে। উৎপাদন খরচ কমানোর জন্যে বীজ, সার, সেচসহ কৃষি উপকরণে ভর্তুকি সহায়তা, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্য গুদামের ধারণক্ষমতা বাড়ানো এবং কৃষি গবেষণা, জৈবপ্রযুক্তি, জেনেটিক প্রকৌশল ও কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীরা খরা, লবণাক্ততা ও জলমগ্নতা সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন।

কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য নিঃসন্দেহে ঈর্ষণীয়। জনসংখ্যার ঊর্ধ্বমুখী চাপ, কৃষিজমির পরিমাণ ক্রমাগত হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বন্যা, লবণাক্ততা, খরা, উচ্চ তাপমাত্রা ও বৈরী প্রকৃতির প্রভাবেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধান, গম, ভুট্টাসহ অন্যান্য শস্যে বিশ্বের গড় উৎপাদন অতিক্রম করে ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বিশ্বের গড় উৎপাদনশীলতা প্রায় ৩ টন, আর বাংলাদেশে তা প্রায় ৪ দশমিক ১৫ টন। দেশে এখন খাদ্য উৎপাদন প্রায় ৪কোটি মেট্রিক টন।

কৃষিবিদদের মর্যাদা নতুন মাত্রায় উন্নীত করতে শেখ হাসিনা ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে জমি বরাদ্দসহ দিক নির্দেশনা দেন কৃষিবিদ ও কৃষকের মর্যাদার প্রতীক পেশাজীবী সংগঠনের প্রাণকেন্দ্র কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটশন বাংলাদেশ-এর নান্দনিক ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠায়। কৃষক-কৃষিবিদ-সহায়ক নীতি ও প্রণোদনায় ধান উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ এখন ৪র্থ, সবজি উৎপাদনে ৩য়; আলু উৎপাদনে ৮ম; মৎস্য উৎপাদনে ৪র্থ।

কৃষিতে তাক লাগানো সাফল্যের নেপথ্যের প্রেরণা আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা আর স্বাধীনতা অর্জনের মহানায়ক, ইতিহাসের রাখাল রাজা, শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।  অথচ  কিছু বিপদগামী সামরিক কর্মকর্তা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি , জাতির জনক  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে।  বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, পুত্র ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, লেঃ শেখ জামাল, ছোট শিশু শেখ রাসেল, পুত্রবধু সুলতানা কামাল, রোজী কামাল, সহোদর শেখ নাসের, কৃষকনেতা আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, বেবী সেরনিয়াবাত, সুকান্ত বাবু, আরিফ, আব্দুল নঈম খান রিন্টু সহ পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে হত্যা করে। জাতীয় শোক দিবসে আমি মহান আল্লাহতায়ালার নিকট সেদিনের সকল শহীদের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।

যতকাল রবে পদ্মা, যমুনা, গৌরী, মেঘনা বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।

লেখক: প্রকল্প পরিচালক, সম্প্রসারিত তুলাচাষ প্রকল্প, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, খামারবাড়ী, ফার্মগেট, ঢাকা।

This post has already been read 5999 times!

Check Also

ডিম ও মুরগির বাজার স্থিতিশীলতায় দরকার  “জাতীয় পোল্ট্রি বোর্ড” গঠন

কৃষিবিদ অঞ্জন মজুমদার : পোল্ট্রি শিল্পের সাথে আন্ত:মন্ত্রনালয়, আন্ত:অধিদপ্তর  এবং উৎপাদন ও বিপননে ডজনের উপরে …