ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা) : চলছে বর্ষাকাল। তরমুজের সময় নয় এখন তবুও গাছে গাছে ঝুলছে তরমুজ! দেখতে ছোটও নয়, প্রতিটি ওজন হবে ৫-৮ কেজি। তরমুজের মৌসুম না থাকলেও অসময়ে তরমুজ চাষ হচ্ছে উপকুলের লবণাক্ত এলাকা খুলনায়। অফ সিজনের তরমুজ চাষ করে কৃষকরা পেয়েছে ব্যাপক সফলতা। মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের মাটি ও সার ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাফল্য পাচ্ছে কৃষকরা, কৃষক পরিবারে যোগ হচ্ছে বাড়তি আয়ও। অফ সিজন তরমুজ চাষ লাভজনক হওয়ার কারণে উপকুলীয় লবণাক্ত এলাকায় দিন দিন আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের মাঝে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আড়াই লক্ষাধিক মাছের ঘেরের আইলে অসময়ে এ তরমুজ চাষ সম্প্রসারিত করা গেলে এ অঞ্চলের কৃষির বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পাশাপাশি অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়াও পর্যায়ক্রমে প্রযুক্তিটি দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া গেলে বাড়তি আয়ে লাভবান হবে কৃষকরা। ঘেরে নিচে মাছ চাষ হলেও পাড় থেকে ৮-১০ হাত পর্যন্ত পানির ওপরে মাচা করে এ তরমুজ চাষ হচ্ছে। আর বাঁশ ও নাইলন সুতো দিয়ে তৈরি মাচাতে ঝুলছে অসংখ্য তরমুজ। আর নিচে পানিতে ঘুরে বেড়ায় মাছ। খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আড়াই লক্ষাধিক চিংড়ি ঘেরের পতিত আইলে তরমুজ চাষ সম্প্রসারিত করা গেলে কৃষিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
জানা গেছে, আশির দশক থেকে খুলনাঞ্চলে ব্যাপকভাবে চিংড়ি চাষ সম্প্রসারিত হয়। কিন্তু চিংড়ি ঘেরগুলোর বেড়ি বাঁধ পতিত পড়ে থাকত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘেরের বেড়ি বাঁধ বা আইলে ব্যাপকহারে সবজি চাষ শুরু হয়। প্রচলিত সবজি চাষের পাশাপাশি বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়ার কয়েকজন কৃষক ‘অফসিজনে’তরমুজ চাষ শুরু করে। এই চাষে খরচও যেমন কম, তেমনি বাজারে মূল্যও বেশি পাওয়ায় কৃষকরা বেশ লাভবান হচ্ছেন। মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা জানান, আমাদের মাটি ব্যবস্থাপনা সার ও পানি ব্যবস্থাপনা কৃষকের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছি। নতুন এই প্রযুক্তিতে প্রাথমিকভাবেই সফল হওয়া গেছে। লবণাক্ত এলাকায় সর্বত্র এটি ছড়িয়ে দেয়া হবে কৃষি সম্প্রসারণের মাধ্যমে যাতে কৃষকরা বাড়তি আয় করতে পারে। এটি এখন লবণাক্ত এলাকায় করা যাচ্ছে। আমরা মনে করছি সারাদেশেই এটি ছড়ানো সম্ভব হবে। তাতে কৃষকরা বাড়তি আয় করতে পারবে।
সরেজমিন দেখা গেছে,মাছের ঘেরের আইলের ধার দিয়ে বানানো হয়েছে মাচা। বাঁশ ও নাইলনের সূতা দিয়ে তৈরি সেই মাচাতে ঝুলছে অসংখ্য তরমুজ। ভারে যেন ছিঁড়ে পড়তে না পারে সেজন্য নেটের ব্যাগ দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে প্রতিটি তরমুজ। পানির ওপর সবুজ ডগায় ঝুলে থাকা রসালো তরমুজ দেখে যে কারোর-ই মন ভরে যাবে। রসালো প্রতিটি তরমুজের ওজন ৫ থেকে ৮ কেজি। ঘেরের পাশে মাচা পদ্ধতিতে তরমুজ চাষের এ দৃশ্য এখন খুলনাঞ্চলে বেশ পরিচিত। খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া, বাগেরহাট সদর মোল্লাহাট ও পাশ্ববর্তী গোপালগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চলে এ অফসিজন তরমুজ চাষ হচ্ছে।
লবণাক্ত মাটিতে অসময়ের বর্ষাকালীন এ তরমুজ চাষে বাম্পার ফলন পেয়ে খুশি কৃষকরা। কৃষকরা জানান, প্রতি কেজি তরমুজ পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৫০- ৬০ টাকায়। আর খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭০/৮০ টাকায়। ফলে কৃষকের মুখে ফুটেছে হাসির ফোয়ারা।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট গোপালগঞ্জ-খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরা-পিরোজপুর কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প (এসআরডিআই অংগ) সূত্র জানিয়েছে, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট গ্রীষ্মকালীন তরমুজের পাশাপাশি বর্ষাকালীন তরমুজ চাষ পদ্ধতি কৃষকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। গত বছর খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়া উপজেলার তিন কৃষক প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে তরমুজ চাষ করে সফলতা অর্জন করেন। এ বছর দ্বিতীয় বারের মতো চাষ করা হচ্ছে অসময়ের বর্ষাকালীন তরমুজ। গত বছরের তুলনায় চলতি বছর বেড়েছে কৃষকের সংখ্যার পাশাপাশী বারছে অপসিজন তরমুজের চাহিদা ।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট কর্মকর্তারা জানান, চলতি বছর ১৫ কৃষক ৪৯৫ শতক জমিতে বর্ষাকালীন তরমুজ চাষ করেছেন। এর মধ্যে খুলনার ডুমুরিয়া-চাঁদগড় গ্রামে ৪টি, বটিয়াঘাটার বয়ারভাংগা গ্রামে ৫টি, গোপালগঞ্জ সদরে ৪টি এবং বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলায় ২টি করে মোট ১৫ টি গবেষণা প্লাট স্থাপন করা হয়েছে।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, গত ১ জুন বর্ষাকালীন তরমুজের বীজ বপন করা হয়। যা ১৩ আগস্ট থেকে কাটা শুরু করেছেন তারা। প্রথম পর্যায়ে তরমুজ কাটা শেষ হলে তারা দ্বিতীয়বার বীজ বপন করবেন। শীত পড়লে আবার তরমুজ কাটা হবে।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট মাটি ,সার ও পানি ব্যবস্থাপনা, কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে নতুন নতুন উদ্ভাবনী প্রযুক্তি। এসআরডিআই এ প্রকল্প লবণাক্ত এলাকায় ঘেরের পাশে পতিত জমিতে অসময়ের বর্ষাকালীন তরমুজ চাষ করার জন্য কৃষককে উদ্ধুদ্ধ করে। মাটি ও পানি পরীক্ষা করে এ তরমুজের চাষ করা হয়। এবার হাইব্রিড নাম্বার ওয়ান ও টপ সুইট নামের তরমুজের দুটি জাত চাষ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, গোপালগঞ্জ-খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরা-পিরোজপুর কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প (এসআরডিআই অংগ) আমন ধান কাটার পর পতিত জমিতে লবণাক্ত এলাকায় তরমুজ ও ভূট্টা চাষ করার জন্য কৃষকদের উদ্ধুদ্ধ করে সফলতা অর্জন করেছে। প্রকল্পের এ সফল কার্যক্রম কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ, কীটনাশক, সার, বীজ ও মাচা তৈরির প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, নগদ অর্থ এবং করোনা সুরক্ষায় মাস্ক বিতরণ করা হয়।
ডুমুরিয়ার বাগাড়দাইড় গ্রামের চাষি মিলটন রায় ও বিশ্বজিৎ রায় বলেন, ‘আমরা প্রথমবার চাষ করেছি। ফলন ভালো হয়েছে। ভালো দামে বিক্রি করছি। চলতি মাসের শেষ পর্যন্ত বিক্রি করতে পারবো। গোপালগঞ্জ-খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরা-পিরোজপুর কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প (এসআরডিআই অংগ) এর পরামর্শ ও যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং মাটি ও সার ব্যবস্থাপনার ফলে তরমুজের বাম্পার ফলন সম্ভব হয়েছে। অফসিজন তরমুজ চাষ করতে আমাদের খরচ হয়েছে ৩০ হাজার টাকা করে ৬০ হাজার টাকা। বিক্রি হবে প্রায় ২ লাখ করে ৪ লাখ টাকা।’
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের এসআরডিআই’র পরিচালক শচীন্দ্র নাথ বিশ্বাস জানান, ঘেরের পাড়ে তরমুজ চাষ করায় বর্ষাকালে সেচের প্রয়োজন হয় না। পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পাওয়া যায়। এতে করে কৃষকরা আইপিএম (ওষুধ ব্যবহার না করে) পদ্ধতিতে ফসল আবাদ করছেন। ফলে পোকা মাকড়ের আক্রমণও কম হচ্ছে। তিনি আরও জানান, গোপালগঞ্জ, পিরোজপুর, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় বর্ষাকালীন তরমুজ, শিম, টমোটো, হলুদ, মানকচু, লাউ, মিষ্টি কুমড়া ও ধানের ওপর গবেষণা চলমান রয়েছে। এই প্রকল্পের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত এলাকায় ছড়িয়ে দিতে পারলে কৃষিতে নতুন দিগন্ত উম্মোচিত হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন তারা।