ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা) : আপনি নৌকায় বসে আছেন। চারিধারে পানি। চলছে ডিঙ্গি নৌকা। পানির শব্দ আসছে কানে। বইছে ঝিরঝিরে বাতাস। আকাশে মেঘ-রৌদ্রের ছন্দে কখনো রোদ কখনো বৃষ্টি। দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেনো রঙ্গের মেলা বসেছে। জলজ ফুলের রানী খ্যাত পদ্মফুল সারিসারি আর পদ্মপাতার সমারোহের মধ্যে আপনি, অনুভূতি কেমন হবে আপানার?
আকাশে পেজা তুলারমত ভাসমান পুঞ্জ মেঘ আর নীচে দিগন্ত জোড়া পদ্মফুলের মেলা দুরন্ত কৈশরকে অনুপ্রাণিত করে। এমন মনোরম পরিবেশ রয়েছে আপনার পাশেই। খুলনা জেলার তেরখাদা ভুতিয়ার বিলের কথা বলছি। কর্মব্যস্ত এক ঘেয়েমী যান্ত্রিক জীবনে প্রশান্তি আনতে একবার হলেও ঘুরে আসতে পারেন আবহ বাংলার অপুরুপ প্রকৃতির প্রতিচ্ছবি ভুতিয়ার পদ্মবিল থেকে। খুলনা জেলখানা ঘাট পার হয়ে প্রায় ১৮ কিলোমিটার পর তেরখাদা বাজার। বাস বা টেম্পুতে সেখানে যাওয়া যায়। তেরখাদা বাজারে নেমে যে কাউকে পদ্মবিলের কথা বললেই হবে। পদ্ম বিলে ঘুরে বেড়ানোর জন্য ওখানে নৌকা ভাড়া পাওয়া যায়। ওরা আপনাকে পুরোটা ঘুরিয়ে দেখাবে। ভাড়া ২০০ থকে ৫০০টাকা। ছোট নৌকাগুলোতে ২/৩ জন ওঠা যায়। কম খরচে যেতে চাইলে জেলখানাঘাট পার হয়ে সেনের বাজার থেকে তেরখাদাগামি বাসে উঠতে হবে। তেরখাদার দুই-তিনটা স্টপেজ আগেই হাড়িখালী নামক স্থানে নামতে হবে। সেখানে ইজিবাইক নিয়ে চরকুশলা গ্রাম। এভাবে যেতে সবমিলিয়ে ঘন্টা দেড়েক সময় লাগে।
বর্ষায় এ বিলে পানি থৈ থৈ করে। বিলের বুকে ডিঙ্গি নৌকো বা তালের ডোঙ্গায় করে ঘুরতে কার না ভাল লাগে। স্থানীয় বয়োযষ্ঠ্যেরা জানায়, আগেকার দিনে কোন বিয়ে-শাদীতে বা মেজবানে ডেকোরেটরের ভাড়া করা থালা-বাসন মিলতোনা। সে সময় অতিথি আপ্যায়ণ করা হতো পদ্মের পাতায় খাবার পরিবেশন করে। শুধু পদ্ম আর পাতাই নয়, দেশী মাছের ভান্ডার ছিল পদ্মবিল। কৈ, শিং, মাগুরের মজুদ থাকতো এখানে। শীতে পানি কমতেই পলুই, কোচ আর হাতড়িয়ে মাছ ধরতে জলে নেমে পড়তো সবাই। চারিদেকে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়তো সে সময়। কালের বির্বতনে যৌবনা পদ্মবিল আজ পৌঢ়ত্বে উপনীত। তবু অতীতের কথা মনে করিয়ে দিতেই বুকের রক্তে রঙ্গীন করে পদ্মফুল ফুটে আছে সেখানে।
পদ্মফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ভুতিয়ার বিলে খুলনা থেকে ঘুরতে আসেন ব্যাবসায়ী মোঃ ইয়াসিন আরাফাত রাকিব, সুমাইয়া রহমান আখি, মোঃ মারুফ গাজী, জান্নাতুল ফেরদৌস, ইমরান হোসেন, মীম ইসলাম, সামসুর রহমান সজল এবং মেসতেহাব ইয়াসিন আতিফ। তারা জানান, শুক্রবার গিয়েছিলাম ভুতিয়ার বিলে। অসাধারণ। না দেখলে বিশ^াস হয় না। ফুল ফুটে রয়েছে। পদ্মপাতার ওপরে পানি টলমল করছে। ছোট ছোট পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। হোগলাবন, কচুরীপনা মধ্য দিয়ে ছোট ডিঙ্গি নৌকা চলছে। চারি ধারে পদ্মফুল যেন দর্শনার্থীকে স্বাগত জানাচ্ছে। তবে খারাপ লাগে যখন দেখি, দর্শনার্থীরা বেশি বেশি করে পদ্মফুল তুলছে। নষ্ট করছে। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে এগুলো প্রকৃতির সৌন্দর্য। এটিকে রক্ষনাবেক্ষন করতে হবে।
গত ক’বছরে প্রকৃতি প্রেমী মানুষকে পদ্মবিলের সৌন্দর্য্য উপভোগ করাতে নৌকার মাঝি বনে গেছেন তেরখাদা এলাকার অনেকেই। এমনই একজন মো. কালাম শেখ। তিনি জানান, বছরে ৩/৪ মাস বিলে পদ্ম ফুল থাকে। তখন প্রতিদিন প্রতিটি মাঝির আয় হয় ৫শ থেকে ১৫শ টাকা। এবিলে প্রায় ২০/২৫ জন মাঝি রয়েছে। বছরের অন্য সময়ে এ নৌকা গুলো পানিতে ডুবিয়ে রাখে। আবার শ্রাবণ মাস এলেই নৌকাগুলো মেরামত করা হয়।
তেরখাদা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ শফিকুল ইসলাম জানান, ভুতিয়ার বিলটি প্রায় সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর এলাকা। যদিও এখানে মাত্র ৪০/৫০ হেক্টর জমিতে পদ্ম ফুল হয়ে থাকে। আর পুরো বিল জুড়ে রয়েছে হোগলা, শেওলা আর আগাছা। প্রতি বছর অনেক দর্শনার্থীই এখানে আসে ঘুরতে।
খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও বিশিষ্ট শিল্পপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী জানান, আমার নির্বাচনী এলাকা তেরখাদায় কোন শিল্প কলকারখানা নেই। এখানের মানুয়ের প্রধান আয়ের উৎস কৃষি, মৎস্য এবং ব্যবসা। ভুতিয়ার বিল নিয়ে সরকারের বৃহত পরিকল্পনা রয়েছে। এখানে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করা হবে। ভুতিয়ার বিলের পদ্ম ফুলে সৌন্দর্য দেখতে দুর-দূরন্ত থেকে মানুষ আসে। ফলে এখানের মানুষের আয়ও বেড়ে যায়। বেড়ে যায় তেরখাদার সুনাম। এ এলাকাকে আরও সুন্দর করে গড়ে তুলতে আমার বিশেষ নজর রয়েছে।