বৃহস্পতিবার , ডিসেম্বর ১৯ ২০২৪

সামুদ্রিক স্থানিক পরিকল্পনা : সাগরের টেকসই ব্যবহারের জন্য একটি বাধ্যবাধকতা

আফিফাত খানম রিতিকা: বাংলাদেশ একটি সামুদ্রিক দেশ, যার সামুদ্রিক আয়তন ১,১৮৮১৩ বর্গ কিলোমিটার এবং যা, তার স্থলভাগের তুলনায় কম বেশি সমান। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ১৮.২ শতাংশ সমুদ্রের অর্থনীতির উপর নিভরশীল (বিশ্ব ব্যাংক, ২০১৮)।

এখনকার দিনে, “সুনীল অর্থনীতি” অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সবচাইতে উদীয়মান একটি শব্দ। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গিয়েছে যে- তেল, গ্যাস ও খনিজ, সামুদ্রিক পর্যটন, সামুদ্রিক বন্দর, শিপিং ইত্যাদি সহ সুনীল অর্থনীতির প্রায় ২৬টি সেক্টর রয়েছে বাংলাদেশে। যদি নির্ধারিত মান ও নীতিমালা ছাড়াই এই সমুদ্রের অর্থনীতিতে উন্নয়ন, বিনিয়োগ এবং পরিচালনা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তা স্বল্পমেয়াদী লাভ বয়ে আনলেও কোন দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্ব যুক্ত করতে পারবে না। সমুদ্র সম্পদের সঠিক আহরণ এবং টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য আমাদের এই অভ্যন্তরীণ সম্পদের অবস্থান সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। জোনেশন এবং সমুদ্র সম্পদের বিস্তৃতি ভিত্তিক আচরণ না জেনে এই প্রতিযোগিতার যুগে কোন টেকসই উন্নয়ন কিংবা কাঙ্ক্ষিত সমুদ্র সম্পদ আহরন সম্ভব নয়। টেকসই সমুদ্র শাসনের জন্য সামুদ্রিক স্থানিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা এখন সময়ের দাবী।

যে প্রক্রিয়ায় সমুদ্রের একাধিক ব্যবহারকারীকে একত্রিত করে শক্তি, শিল্প, শাসন, সংরক্ষণ এবং বিনোদন সহ সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার সম্পর্কে অবগত ও সমন্বিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তাকে সামুদ্রিক স্থানিক পরিকল্পনা বলা হয়।

সামুদ্রিক স্থানিক পরিকল্পনা ভিত্তিক সর্বাধিক ব্যবহৃত এবং গ্রহণযোগ্য সংগা প্রদান করেছে ইউনেস্কোর আন্তঃসরকারী মহাসাগরীয় কমিশন (আইওসি):

সামুদ্রিক স্থানিক পরিকল্পনা হলো একটি সরকারি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে সমুদ্রের স্থানিক বিশ্লেষণ করে তাতে জনগণের ব্যবসায়িক কার্যকলাপের নিমিত্তে সামুদ্রিক পরিবেশগত, অর্থগত এবং সামাজিক বিষয়গুলোকে সাধারণ একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্দিষ্ট করা হয়। সামুদ্রিক স্থানিক পরিকল্পনার বৈশিষ্টগুলির মধ্যে রয়েছে বাস্তুতন্ত্র ভিত্তিক এবং অঞ্চল ভিত্তিক, যেটি অবশ্যই সংহত ও গ্রহণযোগ্য এবং অবশ্যই কৌশলগত ও অংশগ্রহণমূলক। সামুদ্রিক স্থানিক পরিকল্পনা কেবলমাত্র একটি পরিকল্পনাই নয়, বরং ভারসাম্য বজায় রেখে বহুমাত্রিক সমুদ্র সম্পদ ব্যবহার, সমুদ্রের পরিবেশ রক্ষা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাহিদা মিটাতে একটি উন্মুক্ত কিন্তু পরিকল্পিত প্রক্রিয়া।

সামুদ্রিক স্থানিক পরিকল্পনা সাধারণত একটি মানচিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপনা করা হয় যেখানে অঞ্চল ভিত্তিক সম্পদ বিবরণ, তাদের প্রাপ্যতা এবং মানব অনুসন্ধানের ক্ষেত্র অন্তর্ভুক্ত থাকে।

এটির কম বেশি ভূমি ভিত্তিক স্থানিক যে পরিকল্পনা ব্যবস্থা বিদ্যমান তার সাথে মিল রয়েছে। সমুদ্রের বহুমুখী ব্যবহারের দ্বন্দ এড়ানোর জন্য, উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবেশের সর্বোত্তম ব্যবহার এবং বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করার জন্য সামুদ্রিক স্থানিক পরিকল্পনা প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন।

একটি স্থিতীশীল উপায়ে সমুদ্রকে অন্বেষণের জন্য আনুভূমিক এবং উলম্ব দুই প্রক্রিয়ায় সমুদ্র শাসন হওয়া উচিত। আনুভূমিক ভিত্তিতে হওয়ার সরকারী খাত, এনজিও, শিক্ষাবীদ, বিজ্ঞানী ইত্যাদির অংশগ্রহণ ও পরিকল্পনার পাশাপাশি, উলম্ব ভিত্তিতে সরকারের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে একটি সমন্বয় সাধিত হয়।

নির্বিচারে মৎস্য আহরণ, সমুদ্রে মৎস্য হ্রাস, বিশেষ কোন প্রজাতির বিলুপ্তি ইত্যাদি এখন আমরা প্রতিনিয়ত খবর পাচ্ছি। উপকূলীয় ও সামুদ্রিক সম্পদ চিহ্নিতকরণ, তাদের টেকসই ব্যবহার এবং পুনরুদ্ধার অযোগ্য ক্ষতিকে রোধ করার জন্য সামুদ্রিক স্থানিক পরিকল্পনা এখন বাংলাদেশের জন্য একটি প্রথম এবং প্রধান কর্তব্য হয়ে দাড়িয়েছে।

সামুদ্রিক স্থানিক পরিকল্পনা সামুদ্রিক সংবেদনশীল অঞ্চল এবং বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতির উন্নত পরিচালনার জন্য ঝুঁকি চিহ্নিত করে, অঞ্চল চিহ্নিত করে এবং সম্পদ চিহ্নিত করে সহায়তা করে। এটি পরিবেশের যে কোন নিষ্কাশন ক্ষতি থেকে পুনরুদ্ধারে সহায়তা করবে।

সমুদ্র ভিত্তিক এই স্থানিক পরিকল্পনা সমুদ্র সম্পদ আহরণের মাধ্যমে অর্থনীতির বিকাশের জন্য বর্তমান সময়ে একটি বাধ্যতামূলক অংশ। বেশ কিছু ইউরোপীয় দেশ তাদের নিজস্ব উদ্যোগে বা ইউরোপীয় আইন ও নীতি দ্বারা পরিচালিত হয়ে, সামুদ্রিক স্থানিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিশ্বে নেতৃত্বে আছে।

তবে বাংলাদেশের সামুদ্রিক স্থানিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে স্টেকহোল্ডারদের চিহ্নিতকরণ, তাদের দ্বন্দ্ব বিশ্লেষণ, তাদের উক্ত প্রক্রিয়াতে জড়িতকরণসহ বহুমুখী প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।

যাইহোক, বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বেসরকারি সংস্থা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সকলেই সাগরের উন্নত ব্যবহারের জন্য সামুদ্রিক স্থানিক পরিকল্পনা সম্পর্কে খুবই সচেতন।

যেহেতু মানুষের মাঝে সচেতনতা এসেছে তাই সমন্বয় তৈরি এখন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আগের তুলনায় অনেকটাই সহজ। এই স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সমন্বয় সাধনে ব্লু ইকোনমি সেল কিন্তু এখন যথেষ্টই সক্ষম। বাংলাদেশে সমুদ্র সম্পদ আহরণের সময়, যেমন- গ্যাস অনুসন্ধানের সময় মাছ ধরা, জাহাজ চালনা, লবণ আহরণ ইত্যাদি বিষয়গুলোর মাঝে অনেক ক্ষেত্রের সমন্বয়হীনতার কারণে বহুমুখী সমস্যার তৈরি হয় স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে।

স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব নিরসনে সরকারের উচিত নিয়মিত সভার ব্যবস্থা করা। তবে বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণে, এটি অত্যন্ত স্পষ্ট যে, সমস্ত দ্বন্দ্ব নিরসন এবং উন্নত পরিকল্পনা ব্যবস্থা করার জন্য সামুদ্রিক স্থানিক পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

বর্তমানে উপকূলীয় কার্যক্রমের সম্প্রসারন এবং জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় প্রতিশ্রুতি পূরণের ক্রমবর্ধমান প্রয়োজনের ফলে টেকসই সমুদ্র ব্যবস্থাপনার হাতিয়ার হিসেবে সামুদ্রিক স্থানিক পরিকল্পনার কোনই বিকল্প নেই।

লেখক: গবেষণা কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিটাইম রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, নৌ সদর দপ্তর, বনানী, ঢাকা।

This post has already been read 6146 times!

Check Also

ডিম ও মুরগির বাজার স্থিতিশীলতায় দরকার  “জাতীয় পোল্ট্রি বোর্ড” গঠন

কৃষিবিদ অঞ্জন মজুমদার : পোল্ট্রি শিল্পের সাথে আন্ত:মন্ত্রনালয়, আন্ত:অধিদপ্তর  এবং উৎপাদন ও বিপননে ডজনের উপরে …