মো. এমদাদুল হক (রাজশাহী) : ফুলকপি আমাদের দেশের শীতকালের অন্যতম জনপ্রিয় সবজি। বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান ও কৃষি বিশেষজ্ঞদের সঠিক দিক নির্দেশনায় শীতকালের ফুলকপি এখন গ্রীস্মকালেও চাষ করে কৃষকেরা বেশ লাভবান হচ্ছে। ফুলকপিতে যথেষ্ট পরিমাণে সালফার, পটাশিয়াম , ফসফরাস ও খনিজ উপাদান রয়েছে।
ফুলকপি চাষের জলবায়ু ও মাটি : ফুলকপি চাষের জন্য সুনিকাশিত উর্বর দোআশ ও এটেল মাটি সবচেয়ে উত্তম। ফুলকপির জন্য ঠান্ডা ও আর্দ্র জলবায়ু ভালো। উঁচু জমি যেখানে পানি জমে না এবং সবসময় রোদ পায় এরূপ জায়গা ফুলকপি চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে। ফুলকপি চাষের মাটিতে যত বেশি জৈব পদার্থ থাকবে ফলন ততই ভালো হবে। মাটির অম্লমান বা পিএইচ ৬.০-৬.৫ ফুলকপি চাষের জন্য উত্তম।
ফুলকপির জাত: আমাদের দেশে এখন ফুলকপির বেশি জাত পাওয়া যাচ্ছে, আসছে নিত্য নতুন স্বল্প জীবনকালের অধিক ফলনশীল হাইব্রিড জাত। শীতকালের আগাম, মধ্যম ও নাবী মৌসুমে বিভিন্ন জাতের ফুলকপি আবাদ করা যায়। এ ছাড়া গ্রীষ্মকালে চাষের জন্য উপযোগী জাত রয়েছে।
ফুলকপির বিভিন্ন জাত
* আগাম জাত অগ্রাহনী, সুপার স্নোবল, ট্রপিক্যাল স্নো-৫৫, সামার ডায়মন্ড এফ ১, স্নো কুইন এফ ১, হিট মাস্টার ও হাইব্রিড জাত। এসব জাতের বীজ শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে বুনতে হয়।
* মধ্যম আগাম জাত পৌষালী, রাক্ষুসী, হোয়াইট টপ, স্নো ওয়েভ, বিগটপ, বিগশট, মোনালিসা এফ ১, চন্ড্রিমা ৬০ এফ ইত্যাদি। ভাদ্র ও আশ্বিন মাস হলো এসব জাতের বীজ বোনার উপযুক্ত সময়।
* নাবী জাত ইউনিক স্নোবল, হোয়াইট মাউন্টেন, ক্রিস্টমাস ও হাইব্রিড জাত। এসব জাতের বীজ বোনার উপযুক্ত সময় হলো আশ্বিন-কার্তিক মাস।
এ জাতগুলো ছাড়াও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক বারি ফুলকপি-১ (রোপা) ও বারি ফুলকপি-২ (অগ্রদূত) নামে মধ্যম আগাম জাতের ফুলকপির উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবিত হয়। বারি ফুলকপি-১ জাতের প্রতিটি ফুলকপির ওজন ৮৫০ থেকে ১০০০ গ্রাম হয়। এ জাতের ফুলকপি চারদিকে পাতা দিয়ে ঢাকা থাকে।
বীজের হার: এক শতক জমিতে রোপণের জন্য ২ থেকে ২.৫ গ্রাম বীজের চারার প্রয়োজন হয়। সে হিসাবে একর প্রতি ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
চারা রোপণ ও রোপণ দূরত্ব : চারায় পাতা ৫-৬ টি হলেই তা রোপণের উপযুক্ত হয়। সাধারণত ৩০-৩৫ দিন বয়সের চারা রোপণ করা হয়। সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬০ সেন্টিমিটার বা ২ ফুট এবং প্রতি লাইনে চারা থেকে চারার দূরত্ব দিতে হবে ৪৫ সেন্টিমিটার বা দেড় ফুট। চারা রোপণের সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যেন শিকড় মুচড়ে অথবা বেঁকে না যায়। কেননা বেকে গেলে মাটিতে চারার বাড়বাড়তি হতে দেরি হয় ও বৃদ্ধি কমে যায়। সারের পরিমাণ: সারের পরিমাণ প্রতি বিঘায় ইউরিয়া ৩০ কেজি, টি এস পি ২৫ কেজি, এমওপি ৩০ কেজি (গোবর সার ২-৩ টন)
সার প্রয়োগের নিয়ম: জমি তৈরির সময় অর্ধেক গোবর সার, পুরো টিএসপি সার, অর্ধেক এমওপি সার এবং বোরন সার প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক গোবর সার চারা রোপণের ১ সপ্তাহ আগে মাদায় দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর চারা রোপণ করে সেচ দিতে হবে। ইউরিয়া এবং বাকি অর্ধেক এমওপি ও বোরন সার ৩ কিস্তি-তে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম কিস্তির সার দিতে হবে চারা রোপণের ৮-১০ দিন পর, দ্বিতীয় কিস্তি সার দিতে হবে চারা রোপণের ২৫ দিন পর এবং শেষ কিস্তির সময় সার দিতে হবে ৪০-৪৫ দিন পর। তবে পুরো বোরাক্স বা বোরন সার জমি তৈরির সময় দেওয়া যেতে পারে। আর সে সময় দিতে না পারলে পরবর্তীতে ১ম ও ২য় কিস্তিতে সার দেওয়ার সময় প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১০-১৫ গ্রাম বোরিক পাউডার গুলে পাতায় স্প্রে করে দেওয়া যায়। আর সকালে শিশির ভেজা অবস্থায় কোন দানা সার দেওয়া যাবে না। সার দেওয়ার পর কোদাল দিয়ে হালকা ভাবে মাটি কুপিয়ে দিতে হবে এবং সার ভালভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনা: সার দেওয়ার পরই সেচ দিতে হবে। জমিতে পানি বেশি সময় যেন জমে না থাকে সেটাও খেয়াল করতে হবে। সার দেওয়ার আগে আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে। আগাছা হচ্ছে যে কোন ফসলের প্রধান শত্রু। ক্ষেতে আগাছা থাকলে ফসলে বাড়-বাড়তি কমে যায়, রোগ ও পোকা-মাকড়ের আক্রমন বেশী হয়। যার জন্য ভাল ফলন থেকে বঞ্চিত হতে হয়। তাই ক্ষেতে আগাছা দেখা দিলে তা দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিশেষ পরিচর্যা: ফুলকপি গাছের সারির মাঝে সার দেয়ার পর সারির মাঝখানের মাটি দুপাশ থেকে তুলে গাছের গোড়ায় মাটি টেনে দিতে হবে। এতে সেচ ও নিকাশের সুবিধা হয়। আর ফুলকপির ফুল সাদা রাখার জন্য কচি অবস্থায় পাতা চারদিক থেকে টেনে বেঁধে ফুল ঢেকে দিতে হবে। সূর্যের আলো সরাসরি ফুলে পড়লে ফুলের রং তথা ফুলকপির রং হলদেটে হয় এতে বাজার দর কমে যায়।
পোকামাকড় ও রোগ বালাই দমন ব্যবস্থাপনা: ফুলকপির লেদা পোকা: লেদা পোকা গাছের কচি পাতা, ডগা ও পাতা খেয়ে নষ্ট করে।
প্রতিকার : পোকার ডিম ও লেদা হাত দারা বাছাই করে নষ্ট করে ফেলতে হবে। ফুলকপি চাষের জমি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখ তে হবে। পোকার আক্রমণ বেশি হলে অনুমোদিত কীটনাশক ব্যবহার করা। যেমন- সাইপারমেথ্রিন( রিপকট/ কট/রেলোথ্রিন) ১ মিলি/ প্রতি লিটার পানি অথবা ক্যারাটে ১ মিলি/ প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
ফুলকপির কাটুই পোকা: কাটুইপোকার কীড়া চারা গাছের গোড়া কেটে দেয়।
প্রতিকার: জমিতে সন্ধ্যার পর বিষটোপ ব্যবহার করতে হবে অর্থাৎ (১ কেজি চালের কুঁড়া বা গমের ভূসির সাথে ২০ গ্রাম সেভিন নামক কীটনাশক পানি বা চিটাগুড়ের সাথে ব্যবহার কার যেতে পারে)।
জমিতে চাষের সময় দানাদার কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। যেমন-ডায়াজিনন ২ কেজি প্রতি বিঘায় অথবা কার্বোফুরান ২ কেজি দিতে হবে। এছাড়াও ক্লোরপাইরিফস (ডার্সবান/ লর্সবান) ২ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
ফুলকপির গোড়া পচা রোগ : আক্রান্ত চারার গোড়ার চারদিকে পানিভেজা দাগ দেখা যায়। আক্রমণের দুই দিনের মধ্যে চারা গাছটি ঢলে পড়ে ও আক্রান্ত অংশে তুলার মতো সাদা দেখা যায় ও অনেক সময় সরিষার মত ছত্রাকের অনুবীজ পাওয়া যায়। শিকড় পচে যায়, চারা নেতিয়ে পড়ে গাছ মারা যায়। রোগটি মাটিবাহিত বিধায় মাটি, আক্রান্ত চারা ও পানির মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে । চারা টান দিলে সহজে মাটি থেকে উঠে আসে।
প্রতিকার : পরিমিত সেচ ও পর্যাপ্ত জৈব সার প্রদান করা ও পানি নিস্কাশনের ভালো ব্যবস্থা রাখা। এছাড়া সরিষার খৈল প্রতি বিঘায় ৪০ কেজি হারে প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে ইপ্রোডিয়ন বা কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন: রোভরাল ২ গ্রাম বা অটোস্টিন ১ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করে মাটিসহ ভিজিয়ে দিতে হবে। ম্যানকোজেব + কার্বেন্ডাজিম (কম্প্যানিয়ন) ২ গ্রাম/ প্রতি লিটার পানিতে দিয়ে গাছের গোড়ায় স্প্রে করতে হবে।
ফুলকপির কার্ড বা মাথা পচা রোগ: লক্ষণ: ফুলকপির কার্ডে প্রথমে বাদামি রঙের গোলাকৃতি দাগ দেখা যায়। পরবর্তীতে একাধিক দাগ মিশে বড় দাগের সৃষ্টি করে।ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে কার্ডে দ্রুত পচন ধরে নষ্ট হয়ে যায়।আক্রান্ত কার্ড বা মাথা থেকে খুব কম পুষ্পমঞ্জরি বের হয়। ফলে এটি খাওয়ার অযোগ্য হয়ে যায়।
প্রতিকার: সুস্থ গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। বীজ বপনের আগে প্রোভ্যাক্স বা কার্বেনডাজিম বা নইন প্রতি কেজি বীজে ২ গ্রাম হারে দিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। ইপ্রোডিয়ন এবং কার্বেনডাজিম ছত্রাকনাশক প্রতিটি পৃথক পৃথকভাবে ০.২% হারে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে,ওষুধ প্রয়োগের ৫ দিন পর পর্যন্ত ফসল তোলা যাবে না।
ফসল সংগ্রহ : সাদা রঙ ও আঁটো সাঁটো আবস্থা থাকতেই ফুলকপি তুলে ফেলা উচিত। মাথা ঢিলা ও রঙ হলদে ভাব ধারন করলে ফুলকপির দাম কমে যায়।