নোমান ফারুক: বঙ্গদেশে বর্ষাকালে শাকসবজীর আকাল বেশ পুরনো। ছোটবেলায় গ্রামে দেখতাম, বর্ষাকালে মাছের আধিক্য থাকলেও শাকসবজি ছিল সীমিত। সাধারনত পানিতে জন্মে এ ধরনের শাকসবজির প্রাচুর্য্য ছিল। যেমন, নানপদের কচু, কচুর শাঁক, কচুর লতি, কচুর ফুল, পানিকচু, কলমিশাক, পাটশাক, হেলঞ্চাশাক, মালঞ্চশাক, শাপলা, ঠোঁয়াস প্রভৃতি। এখন অবশ্য চিত্র ভিন্ন, পয়সা হলে সারাবছর অনেক ধরনের শাকসবজী মেলে। এখন বর্ষাকালে এগুলোর পাশাপাশি ঝিঙা, চিচিঙ্গা, করলা, শসা, বরবটি, ঢেঁড়শ, পুঁইশাক, ডাটাশাক, কুমড়াশাক, শশা, কাঁকরোল, কাঁচকলা, পেঁপে, বেগুন, পটল, চাল কুমড়া, মিষ্টিকুমড়া প্রভৃতি সবজি পাওয়া যায়। তবে আমার শৈশবে খাওয়া প্রিয় সবজিগুলোর মধ্যে ঠোঁয়াস ছিল অন্যতম।
ঠোঁয়াস একটি অপ্রচলিত আঞ্চলিক সবজি। এটা একটি জলজ সব্জি। সচরাচর বর্ষাকালে পাওয়া যায়। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের একটি বিলুপ্তপ্রায় সব্জি। পূর্বে কুমিল্লা, ফেনি, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও চট্রগ্রামের কিছু কিছু এলাকায় বর্ষাকালে ঠোঁয়াস পাওয়া যেত। এখনো কিছুকিছু এলাকার গ্রাম্য বাজারে আটিপ্রতি ১০ থেকে ২০ টাকা করে পাওয়া যায়। ফেনীর সোনাগাজীতে জমি, পুকুর, খাল-বিলে পানিতে এর বানিজ্যিক চাষ হয়।
এটি সবজি হিসেবে অনেকের কাছে জনপ্রিয়। এটি সুস্বাদু এবং স্বাদ কিছুটা শাপলার কাণ্ডের মত। ফেনীর মানুষের কাছে এ্টি সবজি খুবই পরিচিত৷ তারা মশুর/বুটের ডাল দিয়ে ঠোঁয়াস রান্না করে খায়। নোয়াখালী অঞ্চলে সব্জি হিসেবে মাছের সাথে কিংবা ভেজে অথবা কখনো কখনো ভর্তা হিসেবে খাওয়া হয়। রান্নার আগে এটিকে শাপলার মতই কুটে বেছে নিতে হয়। তারপর পানিতে ধুয়ে মাছ বা ডাল দিয়ে রান্না করা যায়। অথবা শাপলার মত শুকনো ভাজি করে খেতেও অনেক স্বাদ। এটা আঁশ সমৃদ্ধ হওয়ায় খাবার হজমে বেশ উপকারী।
রান্না অথবা ভাজি সব ক্ষেত্রেই ঠোঁয়াস অতুলনীয়। ঠোঁয়াস কেটে এনে উপরের শক্ত চামড়া ফেলে দিয়ে ভিতরের নরম অংশ শাপলার মত সিদ্ধ করতে হয়। সিদ্ধ হলে কালচে বর্ণ ধারণ করে। পরে জালিতে ঢেলে চিপে পানি ঝরাতে হয়। এটা ডাল বা চিংড়ি দিয়ে রান্না করা যায়। আবার ঠোঁয়াস এর কচি অংশ কুচি কুচি করে কেটে পিয়াজ, শুকনা মরিচ, সরিষার তৈল দিয়ে ভর্তা করা যায়।
পুকুর, ডোবা, জলাশয়, খালখাল-বিল, পুকুর পাড় বা পরিত্যক্ত নিচু জমিতে ঠোঁয়াস চাষ করা যায়। কাদামাটিতে এর ফলন ভালো হয়। বর্ষার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভালো ফলন দেয়। তবে পানি শুকিয়ে গেলেও এটি মাসের পর মাস মাটিতে বেঁচে থাকতে পারে। এ সব্জি চাষের জন্য বিশেষ কোন যত্ন, পরিশ্রম বা খরচ নেই। ঠোঁয়াস গাছ সাকার তৈরি করে। এর গীটসহ কান্ড বা সাকার একবার কাদামাটিতে লাগিয়ে দিলেই হলো। পর্যন্ত পরিমান পানি পেলে এর কান্ড দ্রুত বৃদ্ধি পায়। কিছুদিন পরপর কান্ডগুলো কেটে এনে পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করে বাজারে বিক্রি করা যায়। এভাবে পতিত জমিতে, বিশেষকরে বর্ষায় যেখানে কোন ফসল করা যায়না, সেখানে ঠোঁয়াস চাষ করে অতি অল্প খরচে রোজগারের ভালো ব্যবস্থা করা যায়।
সবজি হিসেবে গ্রামে ও শহরে ঠোঁয়াস এর চাহিদা রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ফেনী’র কিছু এলাকায় এর বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়েছে। সোনাগাজী উপজেলার সেনেরখিল গ্রামের চাষিরা ঠোঁয়াস চাষে আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতা অর্জন করেছেন। এ গ্রামের অহিদা খাতুন (১৮ শতক), সিরাজুল ইসলাম (১৫ শতক), চরসাহাভিকারী গ্রামের বজলের রহমান (১০ শতক), আরব আলী (৮ শতক), আবুল হোসেন(১৫ শতক), পূর্ব মির্জাপুর গ্রামের জামাল উদ্দিন (১৪ শতক) প্রমুখ ঠোঁয়াস চাষে আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতা অর্জন করেছেন। মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের পূর্ব মির্জাপুর গ্রামের কৃষক জহিরুল ইসলাম জানান, ১৫ শতক জমিতে ঠোঁয়াস চাষ করে গত বর্ষায় ৩০,০০০/ (ত্রিশ হাজার টাকা) আয় করেছেন। কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, সোনাগাজী উপজেলায় প্রতিবছর প্রায় ৩৫০ শতক জমিতে ঠোঁয়াস চাষ করা হয়।
লেখক: অধ্যাপক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।