বৃহস্পতিবার , ডিসেম্বর ২৬ ২০২৪

সরিষার আধুনিক চাষাবাদ কৌশল

মো: দেলোয়ার হোসেন : সরিষা বাংলাদেশের অন্যতম তৈল জাতীয় ফসল। সরিষার তেল শহর গ্রাম সবখানে খুবই জনপ্রিয়। আমাদের দেশের অনেক জমিতে চাষ হয়ে থাকে। আমাদের দেশের চাষকৃত সরিষা থেকে বছরে প্রায় আড়াই লক্ষ টন তেল পাওয়া যায়। দেশের গ্রামের প্রায় অধিকাংশ মানুষ ভোজ্য তেলের জন্য সরিষার উপর নির্ভর করে। এছাড়া সরিষার খৈল গরু ও মহিষের জন্য খুবই পুষ্টিকর খাদ্য। আবার মাটির জন্য খৈল খুব উন্নতমানের জৈব সার। তাই সরিষা উৎপাদন করে পারিবারিক ভোজ্য তেলের চাহিদা পুরনের পাশাপাশি সরিষার তেল দিয়ে গবাদি পশুর খাদ্য, মাছের খাদ্য ও জমির জন্য জৈব সার তৈরী এবং বাড়তি আয় করা সম্ভব। সরিয়ার তৈল বিভিন্ন খাবার রান্না ও স্বাদ বৃদ্ধি ও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। দেশের চাহিদা মেটানোর পর অতিরিক্ত উৎপাদিত সরিষা বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

জাত
বাংলাদেশে দেশী ও উন্নত জাতের সরিষা চাষ হয়ে থাকে। সরিষার এসকল জাতগুলো হলোঃ টরি-৭, সোনালী সরিষা(এসএস-৭৫), কল্যাণীয়া (টিএস-৭২), দৌলত (আরএস-৮১), বারি সরিষা-৬ (ধলি), বারি সরিয়া-৭ (ন্যাপাস-৩১৪২), বারি সরিয়া-৭ (ন্যাপাস-৮৫০৯), রাই-৫, বারি সরিষা-৯, বারি সরিষা-১০, বারি সরিষা-১১, বারি সরিষা-১২, বারি সরিষা-১৩, বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৫, বারি সরিষা-১৬ এসব।

মাটি ও চাষের সময় 
সরিষা চাষের জন্য দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ, ও পলি মাটি উপযুক্ত। সহজে পানি নিষ্কাশন করা যায় এরকম মাটি নির্বাচন করতে হবে। বিভিন্ন অঞ্চলের আবহাওয়াগত তারতম্য এবং জমির জো অবস্থা অনুসারে কার্তিক থেকে অগ্রহায়ণ (মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য নভেম্বর) মাস পর্যন্ত সরিষার বীজ বপন করা যেতে পারে।

জমি তৈরি
 জমি ৫-৬ টি আড়াআড়ি ভাবে চাষ ও মই দিয়ে পরিপাটি করে মাটি তৈরী করতে হবে।
 সরিষার জমি এমন ঝুরঝুরে করে চাষ করতে হবে যাতে সহজেই বীজ থেকে চারা গজাতে পারে।
 সরিষার জমির বড় বড় ঢেলা ভেঙ্গে সমতল করতে হবে। যাতে জমির কোথাও পানি জমতে না পারে।
 জমির চার পাশে নালার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে পানি সেচ ও নিকাশে সুবিধা হবে।

বীজ বপন
 সরিষা বীজ সাধারণত ছিটিয়ে বপন করা হয়। এছাড়া সারিতেও বপন করা যায়।
 ছিটিয়ে বীজ বপনের ক্ষেত্রে শেষ চাষের সময় বীজ ছিটিয়ে মই দিয়ে বীজ ঢেকে দিতে হবে।
 সারিতে বীজ বপন করা হলে সারি থেকে সারির দুরত্ব ৩০ সে.মি. রাখতে হবে।
 ২-৪ সে.মি. গভীরতায় সরিষার বীজ বপন করতে হবে।
 সরিষার বীজ খুব ছোট। তাই বপনের সুবিধার জন্য বীজের সাথে ঝুরঝুরে মাটি বা ছাই মিশিয়ে নিতে হবে।
 সারিতে বীজ বপন করা হলে জমিতে সার প্রয়োগ, সেচ প্রদান ও নিড়ানী দিতে সুবিধা হবে।
 বীজ বপনের সময় জমিতে পর্যাপ্ত রস থাকা প্রয়োজন যাতে বীজের অংকুরোধগমের কোন অসুবিধা না হয়। মাটিতে প্রয়োজনীয় রস থাকলে ২-৩ দিনের মধ্যে চারা গজাবে।

সার প্রয়োগ
সরিষা চাষে গুনগত মানসম্পন্ন ভালো ফলন পেতে জমিতে পর্যাপ্ত পরিমান জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। মাটির পরিক্ষার মাধ্যমে মাটির ধরন অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে। তবে মাটিতে জৈব সার প্রয়োগ করা হলে মাটির গুনাগুন ও পরিবেশ উভয়ই ভাল থাকে। সরিয়ার ভাল ফলন পেতে আবর্জনা পঁচা সার ব্যবহার করা যেতে পারে। বাড়ির আশেপাশে গর্ত করে সেখানে আবর্জনা, ময়লা, ঝরা পাতা এসব স্তুপ করে আবর্জনা পচাঁ সার তৈরী করা সম্ভব।

পরিচর্যা
 সরিষার বীজ বপনের পর চারা খুব ঘন হলে পাতলা করে দিতে হবে। পাতলা করণের কাজ চারা গজানোর ১০-১৫ দিনের মধ্যে করতে হবে।
 জমির কোথাও একদম চারা না গজালে প্রয়োজনে সেখানে আবার বীজ বপন করতে হবে।
 সরিষার জমিতে আগাছা দেখামাত্র নিড়ানী দিয়ে তুলে ফেলতে হবে। বীজ বপনের ১৫-২০ দিন পর একবার ও ফুল আসার সময় একবার নিড়ানী দিতে হবে।

সেচ প্রদান
সরিষার জমিতে প্রয়োজনমত সেচ প্রদান করতে হব্।ে সোনালী সরিষাসহ উফসী জাতে সরিষা ক্ষেতে পানি সেচ প্রদান করা হলে ভাল ফলন পাওয়া সম্ভব। সরিয়া শুষ্ক মৌসুমের ফসল তাই সেচের উপর ফলন অনেকাংশে নির্ভরশীল। তাই বীজ বপনের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে (গাছে ফুল আসার আগে) প্রথম বার এবং ৫০-৫৫ দিনের মধ্যে (ফুল আসার সময়) দ্বিতীয় সেচ দিতে হবে। বীজ বপনের সময় মাটিতে রস কম থাকলে চারা গজানোর ১০-১৫ দিনের মধ্যে হালকা সেচ দিতে হবে। সরিষা জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না তাই সেচের পানি যাতে জমিতে জমতে না পারে সেদিতে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে সেচ ও নিকাশের জন্য নালা তৈরী করে দিতে হবে।

রোগবালাই দমন

জাব পোকার আক্রমন

জাব পোকা হচ্ছে সরিষার প্রধান ক্ষতিকর পোকা। পুর্ণ বয়স্ক ও বাচ্চা পোকা উভয়ই সরিষার পাতা, কান্ড, ফুল ও ফল হতে রস শোষন করে। আক্রমনের মাত্রা বেশী হলে ফুল ও ফলের বৃদ্ধি বাধা প্রাপ্ত হয় এবং পাতা কুকঁড়ে যায়। জাব পোকা এক ধরনের রস নিঃসরণ করে, ফলে তাতে সুটিমোল্ড ছত্রাক জন্মে এবং আক্রান্ত অংশ কালো দেখায়। এজন্য ফল ঠিকমত বাড়তে পারে না এবং বীজ আকারে ছোট হয়। বীজে তেলের পরিমান কমে যায়। ফল ধরা অবস্থায় বা তার আগে আক্রমন হলে সম্পুর্ণ ক্ষেত নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

প্রতিকার 
 জাব পোকার আক্রমন হলে শুকনো ছাই এর সাথে কেরোসিন মিশিয়ে সমস্ত ক্ষেত ছিটিয়ে দিতে হবে।
 ডিটারজেন্ট বা সাবান গোলা পানি ছিটিয়ে দিলে ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে।
 আক্রমনের মাত্রা বেশী হলে ম্যালাথিয়ন গ্রুপের কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করলে ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে।

সরিষার পাতা ঝলসানো রোগ

অল্টারনারিয়া ব্রাসিস নামক ছত্রাক সরিষার পাতা ঝলসানো রোগ সৃষ্টি করে। প্রাথমিক অবস্থায় সরিষা গাছের নীচের বয়স্ক পাতায় রোগের লক্ষন দেখা যায়। পরে ছত্রাকের আক্রমনে গাছের পাতা, কান্ড ও ফলে গোলাকার কালচে দাগের সৃষ্টি করে। আক্রমনের মাত্রা বেশী হলে পাতা ঝলসে যায় এবং সরিষার ফলন কম হয়ে থাকে।

প্রতিকার
 বীজ বপনের পুর্বে প্রতি কেজি বীজ ২.৫ গ্রাম হারে প্রোভ্যাক্স বা কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে।
 আগাম বীজ বপন করতে হবে।
 আক্রমনের মাত্রা বেশী হলে ম্যানকোজেব বা কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক পানিতে মিশিয়ে ৭- ১০ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।

বিছা পোকা 

বিছা পোকা সরিষার ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে। সরিষার পাতার উল্টো পিঠে সবুজ অংশ খেয়ে পাতাকে সাদা পর্দার মত করে ফেলে। এরা সমস্ত মাঠে ছড়িয়ে পড়ে এবং পুরো পাতা খেয়ে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে।
প্রতিকার
 পাতায় ডিমের গাদা দেখলে তা তুলে ধ্বংস করে ফেলতে হবে।
 ডিম বা আক্রমনের প্রথম অবস্থায় কীড়াগুলো পাতায় দলবদ্ধ থাকা অবস্থায় পোকা সমেত পাতাটি তুলে পায়ে মাড়িয়ে বা গর্তে চাপা দিয়ে মারতে হবে।
 ভাল ভাবে পোকা দমন করতে হলে সরিষা ক্ষেত সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে।
 আক্রমনের মাত্রা বেশী হলে কেবল তখনই কার্বারিল বা সাইবারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

লেখক: টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাজশাহী।

This post has already been read 6812 times!

Check Also

আমন ধানে ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার আক্রমণ: ফলনের ক্ষতি ও করণীয়

ড. মো. মাহফুজ আলম: বাংলাদেশে ধান প্রধান ফসল হিসেবে পরিচিত এবং এর উৎপাদন গ্রামীণ অর্থনীতির …