কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন : প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও ১৬ অক্টোবর সাড়ম্বরে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে বিশ্ব খাদ্য দিবস। ১৯৪৫ সালের ১৬অক্টোবর দিনটিতে জাতিসংঘের অন্যতম একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান খাদ্য ও কৃষি সংস্থা Food and Agriculture Organization (FAO) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মানুষের প্রধানতম মৌলিক চাহিদা হলো তার খাদ্য। মানবজাতির অস্তিত্বের প্রশ্নে খাদ্যের অপরিহার্যতা, এর ব্যাপ্তি, সীমাবদ্ধতা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিশ্ববাসির মনোযোগ আকর্ষণের লক্ষ্যে ১৬অক্টোবরকে প্রতিবছর বিশ্ব খাদ্য দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বিভিন্ন বছরে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপাদ্য নিয়ে এ দিবস পালিত হয়। বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২০ এর প্রতিপাদ্য হলো- Grow, Nourish, Sustain-together: Our actions are our future. অর্থাৎ ‘সবাইকে নিয়ে বিকশিত হোন, শরীরের যতœ নিন, সুস্থ থাকুন: আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যত।
বর্তমান বাস্তবতায় এবারের প্রতিপাদ্য সময়োপযোগী ও যথার্থ বলেই বিবেচিত হয়। শেষ অংশ দিয়ে শুরু করতে চাই। আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। ব্যক্তির কর্মফল যেমন তার ভবিষ্যৎ জীবনকে বহুলাংশে প্রভাবিত করে তেমনি মানবজাতির সামষ্টিক কর্মফলও তার ভবিষ্যৎ পথ নির্দেশ করে। কর্মের আগে আসে সুষ্ঠু পরিকল্পনা। পরিকল্পনা যদি বাস্তব ও সময়োপযোগী হয় তাহলে সফলতা আসবেই। তবে এর সাথে বিশেষভাবে দরকার মূল্যায়ন, তদারকি এবং যোগ্য নেতৃত্বের। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ও মাননীয় কৃষিমন্ত্রী কৃষিবিদ ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক এর নির্দেশনায় বাংলাদেশের কৃষির খাতওয়ারী সাফল্য ও সমৃদ্ধি বিশ^বাসীর মনে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। কৃষি উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন বিশ্ব দরবারে রোল মডেল।
মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতায় জীবনটাকে আরও একটু উন্নততর বা আয়েশি করার জন্য বিশ্বব্যাপী চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন অভিঘাত এখন সর্বত্র অনুভূত হচ্ছে। যার পরিণতিতে এ গ্রহটির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক চিন্তাবিদ, গবেষক যে আশঙ্কা করছেন তা মানবজাতির সামগ্রিক কর্মফলেরই পরিণতি। এই বাস্তবতায় জাতিসংঘ সারা পৃথিবীর সামগ্রিক উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) ঘোষণা করেছে। টেকসই উন্নয়ন বলতে ওই ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডকে বুঝায় যার মাধ্যমে বর্তমান অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাও নিশ্চিত হয় আবার প্রকৃতি, পরিবেশ এবং ইকোসিস্টেমের ওপর যেন কোন ক্ষতিকর প্রভাব না পড়ে। অর্থাৎ ভবিষ্যৎ পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করে বর্তমান উন্নয়ন চালিয়ে যাওয়া।
২০১৫ সনের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭০তম অধিবেশনে “টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০ এজেন্ডা” গৃহীত হয়। সারা বিশ্বের মানুষের শান্তি, সমৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে “২০৩০ এজেন্ডা” নামে পরিচিত এসডিজি এমন একটি কর্ম-পরিকল্পনা যা বিশ্বশান্তি জোরদার করবে এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যসহ সকল প্রকার বৈষম্যের অবসান ঘটাবে। অতি দারিদ্র্যসহ সমাজে বিদ্যমান সব ধরনের বৈষম্যের অবসান ঘটানোই এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, আর এটাই হলো টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত। আগামী এক দশক বিশ্বের সকল দেশ এই অভীষ্টগুলো বাস্তবায়নে কাজ করবে যার মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে জনগণের সকল ধরনের দারিদ্র্যের অবসান ঘটানো সম্ভব হবে; সকল ধরনের বৈষম্যের অবসান ও অসমতা হ্রাসের গুরু দায়িত্ব পালন করাসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলার কাজ এগিয়ে নেয়া যাবে। আর এসব কর্মকাণ্ডের মূলমন্ত্র হবে “কাউকে পশ্চাতে রেখে নয় (Leaving no one behind)নীতি অনুসরণ।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের অন্যতম এজেন্ডা হচ্ছে ক্ষুধার অবসান, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান অর্জন এবং টেকসই কৃষির প্রসার। দারিদ্র নিরসনের পরই দ্বিতীয় এজেন্ডা হিসেবে এটি কর্মপরিকল্পনায় সংযুক্ত করা হয়েছে। কেননা খাদ্য হল আমাদের জীবনের নির্যাস এবং আমাদের সংস্কৃতি ও সমাজের মূলভিত্তি। নিরাপদ এবং পুষ্টিকর খাদ্যের প্রাপ্যতা চলমান করোনা মহামারীর সময়ে একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাদ্যের প্রয়োজন অতীতে যেমন ছিল, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সাথে ক্রমশ এই প্রয়োজন বাড়বে।
এ বছর বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২০ এর প্রতিপাদ্যের শুরুর অংশে বলা আছে- ‘সবাইকে নিয়ে বিকশিত হোন, শরীরের যতœ নিন, সুস্থ থাকুন’। ঠিক এই কাজটিই করার চেষ্টা করছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার। বর্তমান সরকারের সবাই কে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কৌশল এখন বিশ্বের সাধারণ দেশ থেকে শুরু করে উন্নত দেশগুলো আগ্রহ সহকারে গ্রহণ করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে চরম খাদ্য ঘাটতির একটি দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পর্ণ এমনকি উদ্বৃত্ত খাদ্যের দেশে পরিণত হয়েছে। এদেশে এখন আর কেউ না খেয়ে থাকে না, আমাদের পুষ্টিহীনতা ও অনেকটা দূর হয়েছে। দৈনিক ক্যালরি গ্রহণের মাত্রা আগের তুলনায় বেড়েছে। এটি জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের দ্বিতীয এজেন্ডার পরিপূরক।
শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি সাধন ও ক্ষয়পূরণের জন্য মানুষ যা খায় তাই তার খাদ্য। পুষ্টি উপাদান অনুযায়ী খাদ্যেরও শ্রেণী বিভাগ আছে। তবে ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়তে হলে দু’টি বিষয়ের উপর অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমতঃ পুষ্টিকর খাবারের পর্যাপ্ততা (availability) নিশ্চিতকরণ, দ্বিতীয়তঃ সব জনগোষ্ঠির জন্য খাবার প্রাপ্তির সামর্থ্য (affordable) নিশ্চিতকরণ। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘শুধুমাত্র খাদ্যের পর্যাপ্ততা কোনো দেশ বা জাতিকে ক্ষুধামুক্ত করতে পারে না যতক্ষণ না সব জনগোষ্ঠীর জন্য ওই খাদ্য প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।’
আমাদের বর্তমান কৃষিমন্ত্রী কৃষিবিদ ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক প্রায়শই বলেন, খাদ্য শুধুমাত্র পর্যাপ্ত হলে হবে না এটি সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য, নিরাপদ ও পুষ্টিকর হতে হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন আমাদের দেশীয় সংস্থাগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন- FAO, IFAD, WFP, IFPRI, CIMMYT প্রভৃতি এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এসব সংস্থা তাদের নিজস্ব কর্ম পরিকল্পনার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের সরকার প্রণীত কৃষি ও খাদ্যসংশ্লিষ্ট প্রকল্প অথবা কর্মসূচিতে সহায়তার মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রাখছে।
বিশ^ব্যাপী করোনা মহমারীর কারণে এই খাদ্য নিয়েই বেশি শঙ্কিত উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশগুলো। বিশ^ খাদ্য সংস্থা ইতোমধ্যে আশংকা ব্যক্ত করেছে যে, করোনা মহামারী ক্ষুধা মহামারীতে রূপ নিতে পারে। কেননা ঠিকমতো উৎপাদন না হলে যে কোন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার (ফরেন কারেন্সি) রিজার্ভ যতই শক্তিশালী হোক না কেন খাদ্য আমদানি প্রক্রিয়া অনেক সময় ব্যর্থ হতে পারে। করোনা মহামারীর কারণে উন্নয়নশীল থেকে উন্নত সকল দেশেই কর্মসংস্থান সংকুচিত হওয়ায় মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত তথা দরিদ্র ও দুর্বল জনগোষ্ঠি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে পতিত হয়েছেন। কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্বস্বাস্থ্য এমন একটি সংকটময় সময়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে আমরা শুধু আমাদের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এবং মৌলিক চাহিদাগুলোর কথা চিন্তা করতে শুরু করেছি। সারা বিশ^ এই চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে কাজ করছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টির যোগান দিতে উৎপাদনের বৈচিত্র্যতা আনয়ন ও খাদ্য ব্যবস্থার সুষম বন্ঠনের দিকে নজর দিতে হবে। এই অনিশ্চিত সময়ে খাদ্যের টেকসই ব্যবস্থাপনাকে অটুট রেখে মানুষের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করতে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
সাম্প্রতিক দশকগুলিতে বিশ্বব্যাপি কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ্য করা গেছে। যদিও আমরা কিছু ক্ষেত্রে চাহিদার অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদনে সক্ষম হয়েছি তবে আমাদের খাদ্য ব্যবস্থাপনার পুরো প্রক্রিয়াটি ভারসাম্যহীন অবস্থায় রয়েছে। পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাবারের ভারসাম্যহীনতার অনেকগুলো কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- পরিবেশের অবক্ষয়, কৃষি-পরিবেশ বৈচিত্র্যের ক্ষতি, বর্জ্য এবং খাদ্যশৃঙ্খল কর্মীদের সুরক্ষার অভাব। করোনা পরিস্থিতি থেকে পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং প্রয়োগ শুরু করার সাথে সাথে খাদ্য বন্ঠন ব্যবস্থার বৈজ্ঞানিক ও উদ্ভাবনী পদ্ধতি প্রয়োগ করে এ খাতে টেকসই ভিত্তি তৈরির সুযোগ রয়েছে।
বিশ্ব খাদ্য দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক বিশ্বব্যাপী সংহতি শক্তিশালী করার মাধ্যমে সমগ্র জনগোষ্ঠিকে খাদ্য নিরাপত্তার আওতায় নিয়ে আসা, পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিতকরণ, পরিবেশ বিপর্যয় মোকাবেলা এবং খাদ্য ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মীদের যথাযোগ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণেও কাজ করা। উন্নত সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাপনার কৌশল প্রণয়ন, ই-কমার্স ও ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে সৃষ্ট সুযোগ কাজে লাগিয়ে টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই কাঙ্খিত ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ অর্জন করা সম্ভব।
লেখক: উর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট।
ই-মেইল: smmomin80@gmail.com মোবাইল: 01716540380