মো. আমিনুল ইসলাম : সীম বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শীতকালীন সবজি। সবজি হিসেবে সীম খুবই জনপ্রিয়। শীত মৌসুমের শুরুতেই সরবরাহ কম থাকায় দাম থাকে বেশি। সীম চাষে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে অধিক ফলন তুলে লাভবান হওয়া যায়।
আমিষসমৃদ্ধ সীম তরকারি হিসেবে খাওয়া হয়। এটি পুষ্টিকর, সুস্বাদু এবং সব শ্রেণীর মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। সীমের বীজে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন ও শ্বেতসার থাকে বলে খাদ্য হিসেবে খুবই উপকারী। তা ছাড়া এতে যথেষ্ট পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস এবং ভিটামিন ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ থাকে। আমাদের দেহের পুষ্টিসাধনে এসব পুষ্টি উপাদানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
সীম সব ধরনের মাটিতেই চাষ করা যায়। তবে দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটি সীম চাষের জন্য বেশি উপযোগী। পানি জমে না এমন উঁচু বা মাঝারি উঁচু জমি সীম চাষের জন্য সবচেয়ে ভালো।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিটিউট উদ্ভাবিত দেশী সীমের জাত বারি সীম-১ ও বারি সীম-২ চাষের জন্য বেশ ভালো। এ ছাড়া বারমাসী সাদা ইপসা-১ ও বারমাসী বেগুনি ইপসা-২ জাত দুটি প্রায় সারা বছর চাষ করা যায়।
সীমের বিভিন্ন জাতের মধ্যে ঘৃতকাঞ্চন, নলডক, আশ্বিনা, কার্তিকা, হাতিকান, বৌকানী, রূপবান, বারি সীম-১, বারি সীম-২, বারি সীম -৩, বারি সীম -৪ উল্লেখযোগ্য এ জাতগুলোর মধ্যে আপনার পছন্দের জাত বেছে নিতে হবে।
সীম চাষে মাদা তৈরি ও সার প্রয়োগ : সীম প্রধানত মাদায় বসতবাড়ির আশপাশে, পুকুরপাড়ে, পথের ধারে ও জমির আইলে চাষ করা হয়। তবে সারি করে জমিতে চাষ করা হলে ১ মিটার দূরত্বে সারি করে প্রতি সারিতে ৫০ সেমি. পর পর মাদা তৈরি করতে হয়। তারপর প্রতি মাদায় ১০ কেজি পচা গোবর, ১৫০ গ্রাম টিএসপি ও ১০০ গ্রাম এমওপি সার ভালোভাবে মিশিয়ে মাদা ভরাট করতে হবে। মাদায় যাতে পানি না জমে সে জন্য জমির সাধারণ সমতল হতে মাদার ভরাট মাটি ৫ সেমি. পরিমাণ উঁচু রাখতে হয়।
বীজ বপন : মাদায় সার প্রয়োগের ৮-১০ দিন পর প্রতি মাদায় তিন-চার টি বীজ ২.৫-৩.০ সেমি. গভীরে বপন করতে হয়। চারা গজানোর ১০-১২ দিন পর প্রতি মাদায় দু’টি সুস্থ ও সবল চারা রেখে বাকিগুলো উঠিয়ে ফেলতে হবে।
পরবর্তী পরিচর্যা : সীমের চারা ও তার আশপাশের আগাছা নিড়ানি দিয়ে নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। তা ছাড়া মাঝে মধ্যে নিড়ানি দিয়ে চারার গোড়ার মাটি খুঁচিয়ে আলগা ও ঝুরঝুরে করে রাখতে হবে। সীমের খরা সহ্য করার ক্ষমতা থাকলেও বৃষ্টির অভাবে মাটিতে রসের ঘাটতি হলে পানি সেচ দিতে হবে।
উপরি সার প্রয়োগ : সীমের জমিতে সার উপরি প্রয়োগের কাজ দুই কিস্তিতে করতে হয়। প্রথম কিস্তি চারা গজানোর এক মাস পর এবং দ্বিতীয় কিস্তি গাছে দুই-চারটি ফুল ধরার সময়। প্রতি কিস্তিতে মাদা প্রতি ২৫ গ্রাম ইউরিয়া ও ২৫ গ্রাম এমওপি সার গাছের গোড়ার চারদিকে তবে গোড়া থেকে ১০-১৫ সেমি. দূরে উপরি প্রয়োগ করে মাটির সাথে ভালো ভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগের সময় মাটিতে রসের অভাব হলে ঝাঁঝরি দিয়ে পানি সেচ দিতে হবে।
মাচা বা বাউনি দেয়া : সীমগাছ বাড়বাড়তির সুযোগ যত বেশি পায়, ফলন তত বেশি হয়। তাই সীমগাছ যখন ১৫-২০ সেমি লম্বা হবে তখন গাছের গোড়ার পাশে বাঁশের কঞ্চিসহ মাটিতে পুঁতে দিতে হবে। এতে করে সীমগাছ ছড়িয়ে পড়ে ভালো ফুল ও ফল দিতে পারে। দেশীয় পদ্ধতিতেও বাঁশের মাচা,গাছ অথবা ঘরের চালে সীমগাছ তুলে দেয়া যায়। এ ছাড়া বাঁশের চাটা ও কঞ্চির সাহায্যে জমিতে মাচা করে সীমগাছ থেকে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
রোপনের আগে পরে করনীয় ও পরিচর্যা: আষাঢ় থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত সীমের বীজ বপন করার সময়। তবে শ্রাবণ মাস উপযুক্ত সময়। যে মাসেই বীজ বপন করা হোক, অগ্রহায়ণের শেষ বা কার্তিক শুরুর আগে কোনো গাছেই ফুল ও ফল ধরে না। ব্যতিক্রম বারমাসী জাত। সীমে যেহেতু আগাম, মাঝারি ও নাবী জাত আছে, তাই জাতের সঠিক তথ্য না জেনে চাষ করলে সময় মতো ফলন পাওয়া যায় না।
মাজরা পোকা : মাজরা পোকার কীড়া সীমের ভিতর ঢোকে বীজ ও সীম খেয়ে নষ্ট করে দেয়। আক্রান্ত স্থান পচে যায়। ফলে আক্রান্ত সীম খাওয়ার অনুপযোগী হয়।
প্রতিকাররের জন্য যা করা দরকার তাহলো :
- আলোর ফাঁদ ব্যবহার করে মাজরা পোকার মথ ধরে মেরে ফেলতে হবে।
- পোকা দমনের জন্য আক্রান্ত ফুল ও ফল সংগ্রহ করে মাটির নিচে পুতে ফেলতে হবে । আক্রমনের মাত্রা বেশী হলে অন্তরবাহী বিষক্রিয়া সম্পন্ন কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১ মি:লি: হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
মাকড় : সীম গাছে মাকড়ের আক্রমন খুব বেশী হয়। ছোট ছোট মাকড় পাতার নীচে থাকে এবং ডিম পেড়ে বংশ বিস্তার করে। মাকড় পাতা ও কচি ডগার রস চুষে খায়। ফলে পাতা ও কচি ডগা কুকড়ে যায় , গাছ দুর্বল হয় এবং ফলন কম হয়। আক্রান্ত অংশ সংগ্রহ করে ধবংশ করে পোকার আক্রমন নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব। পোকার আক্রমনের মাত্রা বেশী হলে ওমাইট বা ভার্টিমেট স্প্রে করতে হবে।
জাব পোকা : পূর্ণাঙ্গ পোকা এবং নিম্ফ একত্রে গাছের পাতা, কান্ড, ফুলের কুঁড়ি ও ফল থেকে রস চুষে খেয়ে ক্ষতি করে থাকে। ফলে গাছের বৃদ্ধি কমে যায়। জাব পোকা পরোক্ষভাবে বিভিন্ন প্রকার ভাইরাস ছড়ানোর মাধ্যমেও রোগের বিস্তার ঘটায়।
প্রতিকার :
- বেশী পরিমানে নাইট্রোজেন জাতীয় সার ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে।
- ৫০ গ্রাম সাবানের গুড়া ১০ লিটার পানির সাথে মিশিয়ে সাবান গোলা পানি স্প্রে করতে হবে।
- জাব পোকা আক্রান্ত ফসলে সকাল বেলা শুকনো ছাই প্রয়োগ করতে হবে। তবে এক কেজি ছাইয়ের সাথে ২০ মিঃলিঃ কেরোসিন মেশাতে হবে।
- আতা গাছের পাতা অথবা নিম গাছের পাতার নির্যাস স্প্রে করেও একে দমন করা যায় ।
- আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে প্রতিলিটার পানির সাথে ম্যালাথিয়ন জাতীয় কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ মি:লি: হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
লেখক: এআইসিও, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাজশাহী।