ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা) : কর্মসংস্থানের সুযোগ কম থাকার কারণে বর্তমানে অনেক শিক্ষিত যুবকরা গড়ে তুলছেন নানা রকম খামার। আমাদের দেশে দিন দিন হাঁস মুরগি পালনে আগ্রহীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। লাভজনক এবং দ্রুত উৎপাদন পাওয়া যায় বিধায় অনেক শিক্ষিত যুবক ও গ্রামীন নারীরা অগ্রসর হচ্ছে অল্প পুজি মাধ্যমে ছোট হাঁস মুরগীর খামার স্থাপনে আগ্রহী হচ্ছে। ক্ষুদ্র খামারিরা প্রাথমিক পর্যায়ে সে সমস্যা বেশি পড়ে সেটা হচ্ছে ভালো মানের বাচ্চা সংগ্রহ করতে না পারা। হাঁস মুরগির খামার লাভজনক হওয়ার ক্ষেত্রে বাচ্চা ভালো মানের এবং কম দামে পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর কমদামে হাঁস মুরগীর বাচ্চা সাধারনত পাওয়া যায় সরকারী হাঁস মুরগী প্রজনন খামাগুলোতে । কিন্ত বিপত্তি দেখা দেয় তখনই যখন ক্ষুদ্র ও প্রান্তীক খামারীরা সরাসরি সরকারী খামারে হাঁসের বাচ্চা ক্রয় করতে যায় তখন। স্থানীয় সিন্ডিকেট ছাড়া হাঁসের বাচ্ছা সংগ্রহ করা দুরহ ব্যাপার । যেখানে সরকারী হাঁস প্রজনন খামারে বাচ্চা বিক্রি মুল্য ২০ টাকা সেই বাচ্চাই খামারের বাহিরের সিন্ডিকেট করে বিক্রি করে ৪/৫গুন বেশি দামে । এমনই একটি হাঁস প্রজনন খামার খালিশপুর নতুন রাস্তা পাবলা এলাকায় অবস্থিত ।
জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকে পাবলায় ১০ একর জমির ওপর সরকারি আঞ্চলিক হাঁস প্রজনন খামার গড়ে তোলা হয়। স্থানীয় ও দূর দূরান্ত থেকে আসা খামারিদের অভিযোগ, খামারে গিয়ে ডিম, বাচ্চা ও হাঁস দূরে থাক কর্মকর্তাদেরই পাওয়া যায় না। কর্তৃপক্ষের দাবি, এটি খামারিদের উপকারের জন্য তৈরি। উৎপাদনের বিপরীতে চাহিদা বেশি থাকায় অনেক সময় ডিম, বাচ্চা ও হাঁস সরবরাহ করা যায় না। এ খামার থেকে প্রতিটি ডিম সাড়ে ৮ টাকা, পূর্ণ বয়স্ক হাঁস ১৭০ টাকা এবং হাঁসের বাচ্চা ২০ টাকায় বিক্রি হয়। সরকারি হাঁস খামারে ২০টাকার বাচ্চা পাওয়া না গেলেও খামারের সীমানার মাত্র বিশ ফুট দূরত্বে খালিশপুর নতুন রাস্তা মোড়ে একই জাতের হাঁসের বাচ্চা বিক্রি হয় ৮০ থেকে ১০০ টাকায়।
খামারিরা জানান, বাজারমূল্যের চেয়ে দাম কম হওয়ায় দালালরাই খামারে উৎপাদিত বাচ্চা, ডিম ও হাঁস কিনে নেন। এ কারণে প্রকৃত খামারিরা গেলে খালি হাতে ফেরত পাঠানো হয়। অনেক সময় খামারে গিয়ে কর্মকর্তাদেরও পাওয়া যায় না।
আহাদ আলী নামের এক খামারি বলেন, অধিকাংশ সময় পাবলা আঞ্চলিক হাঁস প্রজনন খামারের অফিসে বাচ্চার জন্য অর্ডার দিতে গিয়ে রুম তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। কোনো কোনো সময় দেখা পেলেও তখন কর্মকর্তারা বলেন, পরের চালানে আসেন, এ চালানের সব বাচ্চার অর্ডার হয়ে গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী সিন্ডিকেট সরকারি হাঁস খামার থেকে কম টাকায় হাঁসের বাচ্চা কিনে সেটা সরকারি প্রতিষ্ঠানের সামনেই বেশি দামে সিন্ডিকেট করে বিক্রি করে। আর এই সিন্ডিকেট সদস্যদের বাইরে হাঁসের বাচ্চা খামার থেকে ক্রয় করতে ক্ষুদ্র খামারীরা গেলে বাচ্চা পাওয়া যায়না। খামারের কর্মকর্তারা জানিয়ে দেন হাঁসের বাচ্চার অর্ডার হয়ে গেছে। প্রভাবশালী সিন্ডিকেট সদস্যরা সরকারি হাঁস খামারের কর্মকর্তাদের সম্বনয়ে বাচ্চা ফুটানোর আগেই বাচ্চা বুক হয়ে গেছে জানিয়ে দেন। ফলে ক্ষুদ্র খামারীরা বাধ্য হয় দাললদের সিন্ডিকেটের কাছ থেকে ২০ টাকার বাচ্চা ৮০ থেকে ১০০ টাকায় ক্রয়ে।
খামারের সহকারী পরিচালক ও পিডিও হ্যাচারী থেকে বাচ্চা এবং খামারের ডিম বিক্রির সিন্ডিকেটের সাথে সরাসরি জরিত বলে জানান এক ক্ষুদ্র খামারী। খুলনার প্রত্যন্ত জনপদ কয়রা থেকে আসা এক ক্ষুদ্র খামারী জানান, আমি আঞ্চলিক এ হাঁস প্রজনন খামারে সহকারী পরিচালক এবং পিডিও কাছে বাচ্চা সংগ্রহের জন্য গেলে তারা আমাকে জানিয়ে দেন, পরের চালানে আসেন, এ চালানের সব বাচ্চার অর্ডার হয়ে গেছে। এ ভাবে ভুল বুঝিয়ে পাঠিয়ে দেন খামারীদের। পরে খামারের বাহির থেকে উচ্চ মুল্য হাঁসের বাচ্চা ক্রয় করে নিয়ে আসি । খামারের কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাচ্চা বিক্রি করে নিজেদের পকেট ভারী করে বহাল তবিয়াতে তারা এ কাজ করে আসছে যেন দেখার কেহ নেই ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, খামারে বর্তমানে আড়াই হাজার লেয়ার হাঁস রয়েছে, যা নয়টি শেডে রাখা হয়েছে। এ খামারে প্রতি মাসে ১৭ হাজার থেকে ২০ হাজার বাচ্চা উৎপাদন হয়। সরকারিভাবে হ্যাচারিতে ৫০ শতাংশ ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এখানে এ হার ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খামারে ১ লাখ ৪৪ হাজার বাচ্চা উৎপাদন হয়েছিল। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ১ লাখ ৫৮ হাজার। চলতি অর্থবছরে বাচ্চা উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দুই লাখ। বাচ্চা উৎপাদন লক্ষমাত্রার চেয়ে বেশি বাচ্চা উদপাদন হয়েছে।
সরকারি হাঁস খামারগুলোতে উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বেশি হওয়ায় সিন্ডিকেট ব্যাবসায়ীরা বেশি সক্রিয় । চাহিদা অনুযায়ী সরকারি প্রতিষ্ঠানটি সবসময় বাচ্চা দিতে পারে না। এই সুযোগটি নেয় স্থানীয় সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা। তারা সরকারি খামারের হাঁসের জাত (জিনডিং) ৩০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি করে। তবে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, খামার থেকে গড়ে বিভিন্ন ধরণের হাঁস খামারীদের দেয়। কিন্তু আমরা হাঁস বিক্রি করি বাঁছাই করে, যে কারণে দাম বেশি রাখি। তবে এই জাতের হাঁস কোথায় পায়? এ বিষয়ে তারা কোন মন্তব্য করেননি।
এ ব্যাপারে খুলনার আঞ্চলিক প্রজনন খামারের সহকারী পরিচালক মো. মোশিউর রহমান বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের সম্মুখে হাঁসের বাচ্চা বিক্রি করা হয়। যার ফলে খামারীরা সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমনকি প্রতিষ্ঠানে না এসে অনেক খামারী সরকারি নির্ধারিত মূল্য থেকে তিন চারগুণ বেশি মূল্য দিয়ে বাচ্চা নিয়ে যায়। এ ব্যাপারে আমাদের কিছুই করার নেই।