মো. এমদাদুল হক (রাজশাহী) : আমাদের দেশে ঋতু বা মৌসুম ছ’টি। আর কৃষির মৌসুম তিনটি- খরিফ-১, খরিফ-২ ও রবি। উৎপাদনের ওপর ভিত্তি করে যদিও কৃষি মৌসুমকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে, আমাদের প্রয়োজনের তাগিদে প্রতি মাসের প্রতিটি দিনই কিছু না কিছু কৃষি কাজ করতে হয়। আর কৃষিতে প্রতি দিনই কৃষির কার্যক্রমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। চাষি ভাইরা নিজস্ব চিন্তা ধারা, চাহিদা ও আর্থিক দিক বিবেচনা করে নিজের মত করে প্রতিদিনের কাজ গুলোকে সাজিয়ে নিতে হবে ও বাস্তবে রূপ দিতে হবে। তাহলেই লাভবান হওয়া যাবে। রবি বা শীতকালের জন্য যেসব সবজির চারা তৈরী করতে হবে সেগুলো সাধারনত: ফুলকপি, বাঁধাকপি, শালগম, টমেটো, বেগুন এসব। টেকসই ফসল উৎপাদনে গুণগত মানসম্পন্ন বীজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। শুধু গুণগত মানসম্পন্ন বীজই কেবল উৎপাদন শতকরা ১৫-২০ ভাগ বাড়িয়ে দিতে পারে। এটি সবজিসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য।
জাত ও বীজ নির্বাচন : যে কোনো ফসল চাষ করার আগে সে ফসলের সবচেয়ে ভালো জাতের বীজ সংগ্রহ করতে হবে। বীজের মধ্যে অন্য জাতের মিশ্রণ যেন না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শুধুমাত্র রোগ-জীবানু মুক্ত, চকচকে বীজই চাষের জন্য ব্যবহার করতে হবে। সরাসরি বীজ বপন করে যেসব শাকসবজি চাষ করা হয় তা হলো মুলা, লালশাক, ডাঁটা, ঢেঁড়স, পুঁইশাক, কুমড়া, শিম জাতীয় ইত্যাদি। অন্য দিকে চারা উৎপাদন করে যেসব সবজি চাষ করা হয় বাঁধাকপি, ফুলকপি, বেগুন ও টমেটো উল্লেখযোগ্য।
বীজতলার স্থান নির্বাচন : বীজতলার জমি অপেক্ষাকৃত উঁচু হওয়া প্রয়োজন যাতে বৃষ্টি বা সেচের পানি দ্রুত নিষ্কাশন করা যায়। ছায়াবিহীন, পরিষ্কার এবং বাতাস চলাচলের উপযোগী স্থানে বীজতলা করা প্রয়োজন। বীজতলা পানির উৎসের কাছাকাছি হতে হবে। বীজতলার মাটি বেলে দোআঁশ বা দোআঁশ এবং উর্বর হতে হবে।
বীজতলা তৈরি : একক বীজতলা বেড সাধারণত ১ মিটার চওড়া ও ৩ মিটার লম্বা হবে। জমির অবস্থা ভেদে দৈর্ঘ্য বাড়ানো কমানো যেতে পারে। পাশাপাশি দুটি বীজতলার মধ্যে কমপক্ষে ৬০ সেমি. গভীর করে ঝুরঝুরা ও ঢেলা মুক্ত করে তৈরি করতে হবে। বীজতলা সাধারণত ১০-১৫ সেমি. উঁচু করে তৈরি করতে হবে। মাটি, বালি ও পচা গোবর সার বা কম্পোস্ট মিশিয়ে বীজতলার মাটি তৈরি করতে হবে। যারা বাণিজ্যিকভাবে চারা উৎপাদন করেন তাদের জন্য স্থায়ী বীজতলা তৈরি করাই ভাল।
বীজতলার মাটি শোধন : বীজ বপনের পূর্বে বীজতলার মাটি বিভিন্ন উপায়ে শোধন করা যায়। এতে অনেক মাটিবাহিত রোগ, পোকামাকড় আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে দমন করা যায়। যেমন-সৌরতাপ ব্যবহার করে, জলীয়বাষ্প ব্যবহার করে, ধোঁয়া ব্যবহার করে, রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে, কাঠের গুঁড়া পুড়িয়ে। তবে সবচেয়ে সহজ ও কার্যকরী পদ্ধতি হলো সৌরতাপ ব্যবহার করে বীজতলার মাটি শোধন করা। এক্ষেত্রে বীজ বপনের ১২-১৫ দিন পূর্বে বীজতলার মাটি যথাযথভাবে তৈরি করে ভালোভাবে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে। পরে স্বচ্ছ অথবা রঙিন পলিথিন দিয়ে বায়ূ নিরোধক করে ঢেকে রাখতে হবে। এতে সারা দিনের সূর্যালোকে পলিথিনের ভেতরে বীজতলার মাটির তাপমাত্রা যথেষ্ট বৃদ্ধি পাবে ও অনেকাংশে মাটিবাহিত রোগজীবানু দমন করবে। এছাড়াও অনেক ক্ষতিকারক পোকামাকড় ও আগাছা দমন হয়।
বীজ শোধন : বীজতলায় বপনের পূর্বে সবজি বীজ কয়েকটি পদ্ধতিতে শোধন করা যায়। যেমন- এগুলোর মধ্যে গুঁড়া রাসায়নিক ওষুধ দ্বারা বীজ শোধন পদ্ধতি বর্তমানে সর্বাধিক প্রচলিত ও সহজ। প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম ভিটাভেক্স-২০০ ব্যবহার করে ভালোভাবে ঝাকিয়ে বীজ শোধন করা যায়। বীজ শোধনের ফলে বিভিন্ন সবজির অ্যানথ্রাকনোজ, পাতায় দাগ, ব্লাইট ইত্যাদি রোগ ও বপন পরবর্তী সংক্রমণ রোধ সম্ভব হয়।
বীজের অঙ্কুরোদগম বা গজানো পরীক্ষা : শাকসবজির বীজ বপনের পূর্বে গজানো পরীক্ষা করে নেয়া প্রয়োজন। এজন্য ছোট থালা বা বাটি নিয়ে তার ওপর বালি পানি দিয়ে ভিজিয়ে ৫০-১০০টি বীজ কয়েক দিন রেখে অঙ্কুরোদগমের শতকরা হার বের করে নিতে হবে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, মুলা, মিষ্টিকুমড়া ইত্যাদির ক্ষেত্রে কমপক্ষে শতকরা ৭৫ ভাগ এবং গাজর, পালংশাক, ঢেঁড়স ইত্যাদির ক্ষেত্রে কমপক্ষে শতকরা ৫৫-৬০ ভাগ বীজ গজানোর ক্ষমতা থাকতে হবে। অঙ্কুরোদগম হার বের করার মাধ্যমে মূল্যবান বীজের সঠিক পরিমাণ, চারার সংখ্যা ইত্যাদি নির্ধারণ করা সহজ হয়।
বীজ বপন : বীজতলায় সারি করে বা ছিটিয়ে বীজ বপন করা যায়, তবে সারিতে বপন করা উত্তম। সারিতে বপনের জন্য প্রথমে নির্দিষ্ট দূরত্বে (৪ সে.মি.) কাঠি দিয়ে ক্ষুদ্র নালা তৈরি করে তাতে বীজ ফেলে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। ছোট বীজের সময় বীজের দ্বিগুণ পরিমাণ শুকনো ও পরিষ্কার বালু বা মিহি মাটি বীজের সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে মাটিতে বীজ বপন করতে হবে। উপযুক্ত ‘জো’ অবস্থায় বীজ বপন করতে হবে। যেসব বীজের আবরণ শক্ত, সহজে পানি প্রবেশ করে না, সেগুলোকে সাধারণত বোনার পূর্বে পরিষ্কার পানিতে ১৫-২০ ঘণ্টা অথবা শতকরা একভাগ পটাশিয়াম নাইট্রেট দ্রবণে এক রাত্রি ভিজিয়ে বপন করতে হয় (যেমন- লাউ, চিচিংগা, মিষ্টিকুমড়া, করলা, উচ্ছে ও ঝিঙ্গা)।
চারা উৎপাদনের বিকল্প পদ্ধতি : প্রতিকূল আবহাওয়াতে চারা উৎপাদনের জন্য বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে কাঠের বা প্লাস্টিকের ট্রে, পলিথিনের ব্যাগে, অন্যান্য মাধ্যমে চারা তৈরি করে রোপণ করা যায়।
বীজতলায় আচ্ছাদন: আবহাওয়া এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে বীজতলার ওপরে আচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে হবে যেন বৃষ্টির পানি ও অতিরিক্ত সূর্যতাপ থেকে বীজতলাকে রক্ষা করা যায়। আচ্ছাদন বিভিন্নভাবে করা যায়। তবে কম খরচে বাঁশের ফালি করে বীজতলার প্রস্থ বরাবর ৫০ সেমি. পরপর পুঁতে নৌকার ছৈ এর আকার তৈরি করে বৃষ্টির সময় পলিথিন দিয়ে এবং প্রখর রোদে চাটাই দিয়ে বীজতলার চারা রক্ষা করা যায়।
চারার যত্ন : চারা গজানোর পর থেকে ১০-১২ দিন পর্যন্ত হালকা ছায়া দিয়ে অতিরিক্ত সূর্যতাপ থেকে চারা রক্ষা করা প্রয়োজন। পানি সেচ একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচর্যা। তবে বীজতলার মাটি দীর্ঘ সময় যাবত বেশি ভেজা থাকলে অঙ্কুরিত চারা রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। চারা গজানোর ১০-১২ দিন পর বীজতলায় প্রয়োজনমতো দূরত্বে চারা রেখে অতিরিক্ত চারাগুলো যতœ সহকারে উঠিয়ে দ্বিতীয় বীজতলায় সারি করে রোপণ করলে মূল্যবান বীজের সাশ্রয় হবে।
বীজতলায় চারার রোগ দমন : বীজ রোগআক্রান্ত হলে তা থেকে চারা গজায় না। গজানোর পর রোগের আক্রমণ হলে চারার কা- মাটি সংলগ্ন স্থানে পচে গিয়ে নেতিয়ে পড়ে। একটু বড় হওয়ার পর আক্রান্ত চারার শিকড় দুর্বল হয়ে যায়। চারা এভাবে নষ্ট হওয়াকে ড্যাম্পিং অফ বলে। বিভিন্ন ছত্রাক এর জন্য দায়ী। বীজতলার মাটি সব সময় ভেজা থাকলে এবং মাটিতে বাতাস চলাচলের ব্যাঘাত হলে এ রোগ বেশি হয়। এজন্য বীজতলার মাটি সুনিষ্কাশিত রাখা রোগ দমনের প্রধান উপায়। প্রতিষেধক হিসেবে মাটিতে কপার অক্সিক্লোরাইড বা ডায়থেন এম-৪৫ দুই গ্রাম এক লিটার পানিতে মিশিয়ে বীজতলার মাটি ভালোকরে ভিজিয়ে কয়েক দিন পর বীজ বপন করতে হবে।
মূল জমিতে চারা রোপণ : বীজতলায় বীজ বপনের নির্দিষ্ট দিন পর চারা মূল জমিতে রোপণ করতে হয়। সবজির প্রকারভেদে চারার বয়স ভিন্নতর হবে। কপি জাতীয় সবজি, টমেটো, বেগুন ইত্যাদির চারা ৩০-৪০ দিন বয়সে রোপণ করতে হয়। চারা উঠানোর পূর্বে বীজতলার মাটি ভিজিয়ে নিতে হবে। যতœ করে যতদূর সম্ভব শিকড় ও কিছু মাটিসহ চারা উঠাতে হবে। মূল জমিতে চারা লাগানোর পরপরই গোড়ায় পানি দিতে হবে এবং কয়েক দিন পর্যন্ত নিয়মিত সেচ দিতে হবে। চারা সাধারণত বিকাল বেলায় লাগানো উচিত।