সৈয়দা সাজেদা খসরু নিশা: বিষমুক্ত সবজি চাষে একটি পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি হল মালচিং। মালচিং সম্পর্কে বিশদভাবে জানার জন্য চলুন ধাপে ধাপে জেনে নিই মালচিং কী এবং কীভাবে এটি ব্যবহার করে আমরা দ্বিগুণ ফসল ঘরে তুলতে পারি।
মালচিং কী?
মাটিতে ফসলের ক্ষেতে বা গাছের গোড়ায় খড়কুটা, আগাছা, গাছের বড় বড় পাতা, ছাই, ধানের ভূষি, ডালজাতীয় ফসলের উচ্ছিষ্ট অংশ বিছিয়ে দিয়ে ঢেকে দেয়ার পদ্ধতিকে সহজ ভাষায় মালচিং বলে। তবে বর্তমানে চাষাবাদ বাণিজ্যিক ও আধুনিকীকরণ হওয়ায় এ পুরোনো প্রথা বর্জন বা ত্যাগ করে এক ধরনের প্লাস্টিকের ব্যবহার হচ্ছে, যা ‘মালচিং’ নামে পরিচিত। মালচিং আধুনিক চাষাবাদের এক উন্নত পদ্ধতি, যা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে ফসলের দ্রুত বৃদ্ধি হয়। তাছাড়া এ পদ্ধতির মাধ্যমে চাষের অনুকূল পরিবেশও তৈরি করা সম্ভব।
মালচিং আমাদের দেশে খুব একটা পরিচিত নয়। তাই মালচিং পদ্ধতিতে চাষাবাদ হয় না বললেই চলে। মূলত জমিতে চাষের জন্য প্রথমে সারি তৈরি করে তার ওপর এক ধরনের পাতলা প্লাস্টিকের থান বিছিয়ে সেই থানের ওপর ফসল অনুযায়ী ছিদ্র করতে হয়। এরপর এ ছিদ্রের ভেতর দিয়ে বীজ বা চারা রোপণ করে ফসল উৎপাদন করা হয়।
মাটির রস সংরক্ষণে মালচিং
ফসলের ক্ষেতে আর্দ্রতা সংরক্ষণে মালচিং বিশেষভাবে উপকারী। কারণ, মালচিং ব্যবহারের ফলে মাটির রসের বাষ্পায়ন প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ ফসল ক্ষেতের পানি সূর্যের
তাপ ও বাতাসে দ্রুত উড়ে যায় না। এতে জমিতে রসের ঘাটতি পড়ে না। ঘাটতি না হওয়ায় সেচ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বর্ষাকালে শুধু বৃষ্টির পানি হলেই চলে। কারণ, এ পানি প্লাস্টিকের ছিদ্র দিয়ে শেকড়ে পৌঁছায়। এর মাধ্যমে পানির যথাযথ ব্যবহার ও সংরক্ষণ সম্ভব। তখন আর সেচ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। মালচিং ব্যবহারের ফলে জমিতে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ আর্দ্রতা সংরক্ষণ হয়।
ব্যবহারে যত সুবিধা
- বর্তমানে কৃষিজমিতে সেচ দেওয়ার জন্য অধিক পরিমাণে বিদ্যুৎচালিত মোটর ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে বিদ্যুতের বেশ অপচয় হয়। তবে মালচিং পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন করা হলে পানি ও বিদ্যুতের অপচয় রোধ করা যাবে। এ পদ্ধতিতে উৎপাদন খরচ কমিয়ে দ্বিগুণ লাভবান হওয়া যায়।
- মালচিংয়ের ছিদ্র দিয়ে রোপণ করা গাছ বেরিয়ে আসে। আর বাকি অংশটুকু ঢেকে থাকায় আগাছা বের হতে পারে না। অর্থাৎ, প্লাস্টিকে ঢেকে থাকার কারণে সেখানে সূর্যালোক পৌঁছাতে পারে না। ফলে সালোকসংশ্লেষণ সংগ্রহ করতে না পারায় ওই অংশে আগাছা জন্মায় না। এতে মাটির পুরো খাদ্য গাছ একাই পায়। ফলে ভালো হয় ফলন।
- মালচিংয়ের ফলে পোকার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। নিমাটোড বা ফসলে কৃমির আক্রমণ রোধ হয়। পলিথিন-জাতীয় এ শিটের ওপরের রঙ সিলভার, নিচের রঙ কালো। সিলভারে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়। ফলে পোকা বসতে পারে না। গাছে পোকা ধরে কম। এতে গাছ ও ফল নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
- এ পদ্ধতি ব্যবহারে জমি ও গাছে তুলনামূলক কম সার দিতে হয়। এতে চাষির খরচ কমে যায়।
- প্লাস্টিক শিট দিয়ে মাটি ঢেকে রাখার ফলে ঢাকা অংশের উষ্ণতা রাত ও শীতকালে তুলনামূলক তপ্ত থাকে। ফলে বীজ থেকে অঙ্কুরোদ্গম দ্রুত হয়। এছাড়া শীতকালে মালচ ব্যবহার করলে মাটিতে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা ধরে রাখা সম্ভব।
- প্লাস্টিক মালচিংয়ের প্রতিফলিত আলো ফলের রঙ ধারণে সহায়তা করে।
- শীতকালে মালচ ব্যবহার করলে মাটিতে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা ধরে রাখা সম্ভব হয় এবং গরমকালে মাটি ঠাণ্ডা থাকে।
- সবচেয়ে বড় কথা হল মালচিং প্রযুক্তি ব্যবহার করলে পানি লাগে অনেক কম।সেচ খরচ বাঁচে,লাভ হয় বেশি।
মালচিং তৈরির পদ্ধতি
নানাভাবে মালচিং করা যায়। মালচিংয়ের প্রধান উপকরণ পলিথিন। সাধারণ পলিথিন থেকে আলাদা এটি। বিশেষ ধরনের পলিথিন দিয়ে মালচিং করা হয়। এ পলিথিন বিছানোর কাজটি হাতেই যেমন করা যায়, তেমনি ছোট বড় মেশিন বা ট্রাক্টরের মাধ্যমেও করা যায়। তবে বাংলাদেশে মালচিং এখনও জনপ্রিয় হয়নি। তাই মেশিন তেমন একটা ব্যবহার করা হয় না বা পাওয়া যায় না। তাই চাষিরা হাত দিয়েই করে থাকেন।
সবজি চাষে মালচিং পদ্ধতির ব্যবহার বেলে ও দোঁআশ মাটির ক্ষেত্রে উপযোগী। এ পদ্ধতিতে চাষ করতে হলে প্রথমে জমি তৈরি করে নিতে হবে। মালচিং করার আগে মাটির সঙ্গে প্রয়োজন মতো জৈব সার মিশিয়ে বেড তৈরি করতে হবে। এক বেড থেকে আরেক বেডের দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার হওয়া উচিত। এরপর তৈরি করা বেডে বিশেষ এ পলিথিন বিছিয়ে দিতে হবে। বিছানোর সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এ সময় পলিথিন টানটান করে বিছিয়ে দেওয়া উত্তম। এতে আগাছা জন্মানোর কোনো সুযোগ থাকবে না। পলিথিনের নিচে যাতে পানি প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য বেডের দুই ধারের পলিথিন চার থেকে ছয় ইঞ্চি মাটির গভীর ঢুকিয়ে মাটি চাপা দিতে হবে, যা প্লাস্টিকগুলোকে মাটির সঙ্গে ধরে রাখতে সাহায্য করে। এখন পলিথিন বিছানো বেডে মাপযোগে ফুটো করে তাতে বীজ বপন বা চারা রোপণ করতে হবে। প্লাস্টিকগুলো একাধিকবার একই ধরনের ফসলের চাষের ক্ষেত্র ব্যবহার করা সম্ভব।
মালচিং কেন করবেন
মালচিং পদ্ধতিতে চারা রোপণের পর থেকে শুধু দেখভাল করা ছাড়া আর তেমন কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন পড়ে না। তাই পরিশ্রম হয় কম। মাটির সারিগুলো পলিথিনে ঢেকে থাকার কারণে বাইরে থেকে কোনো ছত্রাক কিংবা রোগবালাই সবজি চারায় আক্রমণ করতে পারে না বলে কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় কম। এ পদ্ধতিতে চাষ করা সবজির গাছ ঢলে পড়া রোগে আক্রান্ত হয় না। ক্ষেত পরিচর্যার জন্য শ্রমিকের প্রয়োজন হয় না বলে উৎপাদন খরচও তুলনামূলক কম হয়। এছাড়া এ পদ্ধতিতে যেমন সবজি গাছ সঠিকভাবে বেড়ে ওঠে, তেমনি ফলন হয় দ্বিগুণ।
লেখক: শিক্ষার্থী, বিএসসি ইন এগ্রিকালচার, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।