মোন্তারিনা হোসেন মৌরি: মাটির গুনাগুন ও স্বাস্থ্য রক্ষায় ভার্মিকম্পোস্ট (কেঁচোসার) এর ব্যবহার ও ভুমিকা অনেক। কেঁচোসার সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্যে চলুন ধাপে ধাপে ভার্মিকম্পোস্ট (কেঁচোসার) কী , কেঁচোসার কিভাবে তৈরী করা হয়, এর উপকারিতা কি কি , ভালো ফলনের জন্যে কেঁচোসারের প্রয়োজনীয়তা জেনে নিই।।
ভার্মিকম্পোস্ট ( কেঁচোসার ) কী ?
উদ্ভিদ ও প্রানীজ বিভিন্ন প্রকার জৈব বস্তুকে কিছু বিশেষ প্রজাতির কেঁচোর সাহায্যে কম সময়ে জমিতে প্রয়োগের উপযোগী উন্নত মানের জৈব সারে রুপান্তর করাকে ভার্মিকম্পোস্ট বা কেঁচো সার বলে।
একেবারে সহজ পদ্ধতিতে বাড়িতে ভার্মিকম্পোস্ট (কেঁচোসার) তৈরির পদ্ধতি
- প্রথমে কেঁচোসার তৈরির ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে প্রয়োজনীয় উপাদান তথা কাঁচামালের উপর । কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যায় ফসলের দেহাংশ ,কৃষিজ বর্জ্য যেমন –পাতা,ডাটা,কান্ড,খোসা, তুষ, কাঠের গুড়া,ধঞ্ছে পাতা, গাছের পাতা,সজনে পাতা, ফুলকপি,বাধাঁকপি,ট্মেটো,আলু ইত্যাদির পাতা খোসা,কচুরিপানা,টোপাপানা ইত্যাদি।
- কাঁচামাল গুলো একটি পাত্রে নিয়ে তাতে পানি দিয়ে ৭/৮ দিন রেখে কাঁচামাল গুলো পচাঁতে হবে। পানি মিশ্রিত কাঁচামাল প্রতিদিন ২/৩ বার নাড়াতে হবে যাতে করে কাঁচামালে অক্সিজেন প্রবেশ করতে পারে এবং পচাঁতে সাহায্য করে।
- ৭/৮ পর কাঁচামাল থেকে পানি অপসারণ করতে হবে। একটি পাত্রে পচনশীল দ্রব্য এবং অপর পাত্রে পানি রাখতে হবে।
- গোবর মিশ্রিত মাটি সংগ্রহ করে গোছিয়ে নিতে হবে । উতকৃষ্ট মানের কেঁচোসার তৈরীর জন্যে পচনশীল দ্রব্য ও গোবরের অনুপাত ৩ঃ১ হওয়া উচিত।
- তারপর একটি পাত্র বা এমন একটি উচু জায়গা বাছাই করতে হবে যেখানে পানি জমে না থাকে।
- গোবর মিশ্রিত মাটিতে পচনশীল দ্রব্য মিশ্রিত করে সেখানে বেশি পরিমানে খাদ্য গ্রহন করতে পারে এবং বেশি মল ত্যাগ করতে পারে এমন কয়েকটি কেঁচো সংগ্রহ করে দিতে হবে। তারপর পাত্রটিকে কাপড় দিয়ে ঢেকে ছায়াযুক্ত স্থানে রেখে দিতে হবে। কারণ কেঁচো স্যাঁতসেতে জায়গা পছন্দ করে । কয়েকদিন পর পর কাপড়ের উপর পানি ছিটিয়ে দিতে হবে যাতে আদ্রতা বজায় থাকে।
- এভাবে ৩০/৪০ দিন রেখে দিতে হবে । ৩০/৪০ দিনে কয়েকটা কেঁচো থেকে অনেক গুলা কেঁচো হবে এবং অনেক মল ত্যাগ করবে । তারা মূলত খাবার খাওয়া শুরু করে উপর থেকে নিচের দিকে এবং উপরে মল ত্যাগ করে। আর এই মল ই হচ্ছে ভার্মিকম্পোস্ট ( কেঁচোসার ) ।এটি দেখতে অনেকটা চা-পাতার মতো।
এভাবেই তৈরি হয়ে গেল কেঁচোসার।
অন্যদিকে পচনশীল দ্রব্য থেকে যে পচন পানি বের হয়েছে সে গুলা ও ব্যবহার করা যায় । তবে পচন পানি গুলো সরাসরি গাছে ব্যবহার করলে গাছ পুড়ে যাবে তাই অল্প পরিমাণ পচন পানির সাথে সাধারন পানি মিশ্রিত করে গাছে ব্যবহার করা যাবে।
ভার্মিকম্পোস্ট (কেঁচোসার) এর পুষ্টিমৌল
খাদ্য উপাদান | কেঁচোসার (শতকরা পরিমাণ) |
নাইট্রোজেন | ১-১.৬০ |
ফসফেট | ২-২.৪৫ |
পটাশ | ০.৮০-১.১০ |
ক্যালসিয়াম (পি.পি.এম.) | ০.৪৪ |
ম্যাগনেসিয়াম (পি.পি.এম) | ০.১৫ |
আয়রন (পি.পি.এম) | ১৭৫.২০ |
ম্যাঙ্গানিজ (পি.পি.এম) | ৯৬.৫০ |
জিঙ্ক (পি.পি.এম) | ২৪.৪৫ |
কপার (পি.পি.এম) | ৪.৮৯ |
কার্বন : নাইট্রোজেন | ২৫.৫০ |
ভার্মিকম্পোস্ট ( কেঁচোসার ) এর ব্যবহার
ভার্মিকম্পোস্ট সব প্রকার ফসলে যে কোন সময়ে ব্যবহার করা যায়। সবজি এবং কৃষি জমিতে ৩-৪ টন প্রতিহেক্টরে ও ফল গাছে গাছ প্রতি ৫-১০ কিলোগ্রাম হারে ব্যবহার করা হয়। ফুল বাগানের ক্ষেত্রে ব্যবহারের পরিমাণ আরো বেশি ৫-৭.৫ কুইন্টাল এক হেক্টর জমিতে। জমির স্বাস্থ্য ও উর্বরতা বজায় রাখার জন্য জৈব সার ব্যবহারের প্রবণতা ক্রমশঃ বাড়ছে। এদেশের মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন এ ব্যাপারে। তাই ভার্মি-কম্পোস্ট উৎপাদন ও তার ব্যবহার এক মূলবান ভুমিকা পালন করতে চলেছে আগামী দিনগুলিতে। রাসায়নিক সারের তুলনায় ভার্মিকম্পোস্ট এর ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে।
এই সার পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যবহার করলে যেসব সুবিধাপাওয়া যায় –
১ কেঁচোসার মাটিতে জৈব কার্বন ও অন্যান্য উপাদানযুক্ত করে মাটির জৈব, রাসায়নিক এবং মাটির ভৌত গুনাগুন চরিত্রের মানের উন্নয়ন ঘটায়।
২. এই সারে জলে দ্রবণীয় উদ্ভিদ খাদ্য উপাদান অন্য যেকোনো সারের তুলনায় বেশী পরিমাণে থাকে যা অনেক সহজলভ্য।
৩. মূল সারের পাশাপাশি অনেক অনুখাদ্য যেমন ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, মলিবডেনাম ইত্যাদি এই সারের মধ্যে থাকে।
৪. এতে অনেক অ্যান্টিবায়োটিক থাকার কারণে রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
৫. উৎপাদিত ফসলের গুণগত মান ভালো হয়।
৬. মাটিতে ফাঁপ তৈরী করে ফলে শিকড়ের বৃদ্ধি যেমন ভালো হয় তেমন প্রয়োজনীয় জল, উদ্ভিদ খাদ্য এবং বায়ু ধরে রাখতে সাহায্য করে।
৭. পচনশীল, অব্যাহত বা বর্জ্য পদার্থে সুষ্ঠ ব্যবহার হয় বা তাদের পুনরায় কাজে লাগানো সম্ভব হয়, দূষণও কমে।
৮. জল ধারণ ক্ষমতা বাড়ায়।
৯. এই সারে বিভিন্ন হরমোন যেমন জিব্বারোলিক অ্যাসিড, অক্সিন সাইটোকাইনিন, হিউমিক অ্যাসিড থাকে যা অঙ্কুরোদগম ও গাছের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে।
১০. সর্বোপরি মাটিকে শক্তিশালী করে ও মাটিকে উর্বর করে।
লেখক: শিক্ষার্থী, বিএসসি ইন এগ্রিকালচার ( অনার্স ), সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।