মাহফুজুর রহমান (চাঁদপুর) : দেশের অন্যতম ব্রান্ডিং জেলা ‘ইলিশের বাড়ি খ্যাত খোদ চাঁদপুরেই এবার দেখা দিয়েছে ইলিশের আকাল। মা ইলিশ সংরক্ষণে টানা ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে চাঁদপুরের জেলেরা নদীতে ইলিশ শিকারে নেমে হতাশ হচ্ছেন। আশানুরূপ মাছ না পেয়ে তাদের কষ্ট বৃথা যাওয়ার মতো অবস্থা।
নিষেধাজ্ঞা শেষের এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষনে উঠে এসেছে এমন হতাশাব্যঞ্জক খবর। দীর্ঘদিন অলস সময় বসে থাকা জেলেরা নদীতে মাছ ধরছেন। তবে জালে কাঙ্খিত ইলিশ না পেয়ে হতাশ হচ্ছেন তারা। যে পরিমাণে মাছ উঠছে, তাতে নৌকার জ্বালানি খরচও উঠছে না।
জেলেরা বলছেন, ২২ দিন নিষেধাজ্ঞা শেষে নদীতে নেমেছি জাল নিয়ে। রাতভর জাল টেনে যেই পরিমাণে মাছ পেয়েছি তাতে আমাদের খরচের টাকাই উঠছে না। অনেক আশা নিয়ে ইলিশ ধরতে নেমে আমাদের হতাশ হতে হচ্ছে। আগামী দিনগুলোতেও নদীতে ইলিশ না পেলে আমাদের পরিবার নিয়ে চলাটাই কষ্ট করে হয়ে যাবে।
হরিনাঘাটের জেলে আলমগীর বলেন ‘অভিযানের সময় আমরা নদীতে আসিনি। ওই সময় বেশি মাছ পাওয়া যেত। অভিযান শেষে নদীতে নাইম্মা দেহি কোনো মাছ নাই। রাতভর তিন ক্ষেপ দিইয়া মাত্র ২০-২৫ কেজি মাছ পাইছি। তাও সব ছোট মাছ। অহন কি আর করমু। মনডা বেশি ভালা নাই। তাই চুপচাপ বইসা আইছি।’
এদিকে চাঁদপুর বড়স্টেশন মাছঘাট ঘুরে দেখা গেছে ইলিশের সরবরাহ একেবারেই কম যা ক্রেতাদের চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। যেখানে বিগত বছরে আড়তে তিল ধারণের ঠাঁই ছিলো না, ছিলো ইলিশের ছড়াছড়ি, সেখানে আজ শূণ্যতা।দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতারা এসে দাম শুনে ভিমড়ি খেয়ে উঠছেন। রপ্তানিও কমেছে ব্যাপকহারে এতে ভেঙ্গে পড়েছেন আড়ৎদাররা।
চাঁদপুর মৎস্য ব্যবসায়ী বনিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী মোঃ শবে বরাত আক্ষেপের সাথে জানান, ‘এ মৌসুমে নদীতে ইলিশ ধরা পড়েছে কম। অভয়াশ্রম শেষে জেলেরা নদীতে নামছে ইলিশ ধরতে। কিন্তু জেলেদের জালে মাছ কম পাওয়ায় আড়তে ইলিশের আমদানিও হচ্ছে কম। তাই আমাদের বেশি দামে ইলিশ কিনে বিক্রিও করতে হচ্ছে বেশি মূল্যে। আগে যেখানে দেড় থেকে দুই হাজার মন মাছ আসতো বর্তমানে সেখানে প্রতিদিন ২০-২৫ মন মাছ আসে। তাও পুরোনো মাছই বেশি। এবার আমাদের বিনিয়োগ বৃথা যাবার পথে। তারপরও শেষ পর্যন্ত অপেক্ষায় আছি’।
বিক্রেতারা বলছেন, বর্তমানে চাঁদপুরে এক কেজি ওজনের ইলিশ ৯শ’ টাকা থেকে এক হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া এক কেজি থেকে দেড় কেজি ওজনের ইলিশ ১২শ’ থেকে ১৫শ’ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর সপ্তাহ দু’য়েক পড়ে দাম আরো দ্বিগুন হবে। আমরা নিরুপায়; চাহিদা আর আমদানি বিবেচনা করেই আমাদের ব্যবসা করতে হয়।
ইলিশ কিনতে আসা ক্রেতারা বলেন, দীর্ঘদিন পর ইলিশ ধরা শুরু হওয়ায় মাছ ঘাটে এসেছি ইলিশ কিনতে। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে ইলিশের সংকট লেগেছে। ব্যবসায়ীরা যেই পরিমাণে দাম চাচ্ছে তা আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যদের নাগালের বাইরে। দাম বেশি থাকায় অনেকেই ইলিশ কিনতে পারছেন না।
জেলা মৎস্য অফিস জানায়, ‘অভিযানের আগে যে পূর্ণিমা ছিল ওই সময় অধিকাংশ মাছ এসে ডিম ছেড়ে গেছে। ওই সময় উজানের দিকে কিছু মাছ ধরাও পড়েছে। যে কারণে এখন নদীতে মাছ নেই বললেই চলে। জেলেরা মাছ না পেয়ে হতাশ হয়ে যাচ্ছে।’ এখন পানির গভীরতা অনেক কমে গেছে। এর কারণে কম পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার মাছের সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম’
চাঁদপুর মৎস্য ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রখ্যাত ইলিশ গবেষক ড. আনিছুর রহমান বলেন, এখন শীতের আগমন ঘটছে। এই সময়টাতে নদীতে ইলিশের চলাচল অনেকটাই কমে যায়। তাই জেলেরা ইলিশ কিছুটা কম পাচ্ছে। তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আশা করি আগামী জানুয়ারি ফেব্রুয়ারির দিকে জেলেরা তাদের কাঙ্খিত ইলিশের দেখা পাবে।
ইলিশ অভয়াশ্রম কর্মসূচির আওতায় মা ইলিশ রক্ষায় গত ১৪ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের উপকূলীয় ১৯টি নদ-নদীসহ চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনা নদীতে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা ছিল। জেলার মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল থেকে হাইমচর উপজেলার চরভৈরবী পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার এলাকা নিষেধাজ্ঞার আওতায় ছিল।
মৎস্য অফিসের দেওয়া তথ্যমতে নিষেধাজ্ঞার এই সময়টাতে চাঁদপুরে ২৮৫টি অভিযান চালিয়ে ৭০৪ লাখ মিটার কারেন্ট জাল, ৫ টন ইলিশ জব্দ করা হয়।এ সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতে দুইশতাধিক জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।চাঁদপুরে পদ্মা-মেঘনা নদীতে মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত রয়েছে ৫২ হাজার জেলে। এদের মধ্যে ৫০ হাজার জেলেকে নিষেধাজ্ঞার সময়টাতে সরকারি ভাবে ২০ কেজি করে চাল সহায়তা দেওয়া হয়।