বৃহস্পতিবার , নভেম্বর ২১ ২০২৪

স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা প্রণয়নের দাবি জানিয়েছে ক্যাব

চট্টগ্রাম সংবাদদাতা: সকলের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে খাদ্যে ট্রান্সফ্যাটের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে জরুরি ভাবে নীতিমালা প্রণয়ন করা না হলে চরম হুমকির মুখে পড়বে ভোক্তা স্বাস্থ্য। চট্টগ্রাম অঞ্চলে মানুষ গরুর মাংশ ভুজী মানুষের আধিক্য বেশী থাকায় হ্দৃরোগসহ নানা জঠিল রোগে আক্রান্তের হার বেশী। খাদ্যে অতিমাত্রায় ট্রান্সফ্যাট মানুষের হৃদরোগ ঝুঁকি বাড়ায়। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে সব ধরনের ফ্যাট, তেল এবং খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ সীমা মোট ফ্যাটের ২ শতাংশ নির্ধারণ এবং তা কার্যকর করার দাবি জানিয়েছেন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। রবিবার (৫ নভেম্বর) চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ মিলনায়তনে ‘খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট, হৃদরোগের ঝুঁকি এবং করণীয়: পরিপ্রেক্ষিত ভোক্তা’ শীর্ষক বিভাগীয় সেমিনারে উপরোক্ত দাবি জানানো হয়।

চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন)মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সভাপতিত্বে সোমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার এ বি এম আজাদ, এনডিসি। ক্যাব চট্টগ্রাম বিভাগীয সাধারণ সম্পাদক কাজী ইকবাল বাহার ছাবেরীর সঞ্চালনায় সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ক্যাব কেন্দ্রিয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন। সেমিনারে বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়া কবীর, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রফেসর ও হ্দরোগ বিভাগের প্রধান ডা. প্রফেসর প্রবীপ কুমার দাস, কৃষি সম্প্রসারণ অধিধপ্তরের বিভাগীয় অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ মঞ্জুরুল হুদা, আনসার ১৫ ব্যাটেলিয়ানের পরিচালক এস এম আজিম উদ্দীন, বিএসটিআই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পরিচালক প্রকৌশলী সেলিম রেজা, জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মুহাম্মদ ফয়েজউল্যাহ।

আলোচনায় অংশনেন চট্টগ্রাম চেম্বারস অব কর্মাসের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ, পরিচালক অহিদ সিরাজ স্বপন, চট্টগ্রাম ইউমেন চেম্বারস অব কর্মাসের ভাইস প্রেসিডেন্ট রেখা আলম চৌধুরী, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সুব্রত কুমার চৌধুরী, চট্টগ্রাম ডায়বেটিস জেনারেল হাসপাতালের প্রধান পুষ্ঠিবিদ হাসিনা আকতার লিপি, অতিরিক্ত জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ফেরদৌসী আকতার, জেলা শিশু কর্মকতা নার্গিস আকতার, জেলা নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা নাজমুস সুলতানা শীমা, চট্টগ্রাম সিটিকরপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর আঞ্জুমান আরা বেগম, সরকারী মহসিন কলেজের অধ্যাপক ইদ্রিস আলী, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি এম নাসিরুল হক, সাবেক উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট রেহেনা আকতার, বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি হাজী সালামত আলী, বাংলাদেশ রেস্তোরা মালিক সমিতি চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি ইলিয়াছ ভুইয়া, ফুলকলির জিএম এম এ সবুর, বনফুলের জিএম আনামুল হক, গ্রীণ গেইনের আসাদুল্লাহ গালিব, সাবেক বিভাগীয় স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা খাইরুল বাশার প্রমুখ।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ এর প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর ডা. মো. মাহবুবুস সোবহান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করে প্র্রজ্ঞা’র ট্রান্সফ্যাট বিষয়ক প্রকল্প সমন্বয়ক মাহমুদ আল ইসলাম শিহাব ও ক্যাবের প্রাজেক্ট কো-অর্ডিনেটর খন্দকার তৌফিক আল হোসাইনী।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিভাগীয় কমিশনার এবিএম আজাদ বলেন নিরাপদ খাদ্যের বিষয়ে তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতার অভাব আছে। ট্রান্সফ্যাট নিয়ে দেশে এখনও নীতিমালা প্রনীত হয়নি। আর নীতিমালা না হলে এক্ষেত্রে সরকারী বিভিন্ন দপ্তরগুলি কার্যকর উদ্যোগ নিতে সক্ষম হবে না। তাই ট্রান্স ফ্যাট নিয়ে নীতিমালা প্রণয়ণে সরকারের সংস্লিষ্ঠ মহলে বিষয়টি উত্থাপনের বিষয়ে আশ^াস দেন। তিনি ট্রান্স ফ্যাটসহ নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে চাহিদা ও যোগানের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্ঠি জরুরী বলে মত প্রকাশ করেন।  যদি অনিরাপদ খাদ্য বিষয়ে ভোক্তারা সচেতন হয়, তাহলে ঐ খাদ্যের চাহিদা কমে যাবে এবং ব্যবসায়ীরা ঐ খাদ্য উৎপাদনে অনাগ্রহী হবে। তাই ভোক্তা পর্যায়ে আরও বেশী করে গণসচেতনতামুলক কর্মসুচি গ্রহনে ক্যাবসহ সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতি আহবান জানান।

সভাপতির বক্তব্যে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে ভোক্তা পর্যায়ে সচেতনতা ও ভোক্তা হিসাবে দায়িত পালনের বিকল্প নাই। ভোক্তারা সচেতন নয় বলে খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলিও দায়িত্বহীন আচরণ করে থাকেন। দায়িত্বশীল ভোক্তারা যদি দায়িত্বপুর্ণ আচরণ করেন তাহলে এখাতে স্বনিয়ন্ত্রিত রেগুলেশন আসতে বাধ্য।

সেমিনারে জানানো হয়, খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাটের প্রধান উৎস হচ্ছে পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল (পিএইচও), যা ডালডা বা বনস্পতি ঘি নামে পরিচিত। ভেজিটেবল অয়েল বা উদ্ভিজ্জ তেল (পাম, সয়াবিন ইত্যাদি) যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেশন করা হলে তেল তরল অবস্থা থেকে মাখনের মতো জমে যায়, এই প্রক্রিয়ায় ট্রান্সফ্যাটও উৎপন্ন হয়। এই শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাট জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট গ্রহণ উচ্চহারে হৃদরোগ, হৃদরোগজনিত মৃত্যু, স্মৃতিভ্রংশ ( dementia) এবং স্বল্প স্মৃতিহানি (cognitive impairment) জাতীয় রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর হিসেব অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতিবছর ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫,৭৭৬ জন মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ি ট্রান্সফ্যাট। ডব্লিএইচও প্রকাশিত ““WHO REPORT ON GLOBAL TRANS FAT ELIMINATION ২০২০” শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বিশ্বে ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই ঘটে ১৫টি দেশে, যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

অতিসম্প্রতি, ঢাকার শীর্ষস্থানীয় পিএইচও (পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল) ব্র্যান্ডসমূহের নমুনার ৯২ শতাংশে ডব্লিউএইচও সুপারিশকৃত ২% মাত্রার চেয়ে বেশি ট্রান্সফ্যাট (ট্রান্স ফ্যাটি এসিড) পেয়েছেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট এর গবেষকগণ। গবেষণায় ঢাকার পিএইচও নমুনা বিশ্লেষণ করে প্রতি ১০০ গ্রাম পিএইচও নমুনায় সর্বোচ্চ ২০.৯ গ্রাম পযন্ত ট্রান্সফ্যাট এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে, যা ডব্লিউএইচও এর সুপারিশকৃত মাত্রার তুলনায় ১০ গুণেরও বেশি। বাংলাদেশে ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা না থাকায় মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে জনস্বাস্থ্য। এমতাবস্থায়, দ্রুততম সময়ের মধ্যে সবধরনের ফ্যাট, তেল এবং খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ সীমা মোট ফ্যাটের ২ শতাংশ নির্ধারণ এবং তা কার্যকর করার দাবি জানায় ক্যাব। পাশাপাশি সহায়ক পদক্ষেপ হিসেবে মোড়কজাত খাবারের পুষ্টিতথ্য তালিকায় ট্রান্সফ্যাটের সীমা উল্লেখ বাধ্যতামূলক করা, উপকরণ তালিকায় পিএইচও এর মাত্রা উল্লেখ বাধ্যতামূলক করা, ফ্রন্ট অব প্যাকেজ লেবেলস বাধ্যতামূলক করা যা খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটের উপস্থিতি নির্দেশ করবে, এবং “ট্রান্সফ্যাট-মুক্ত” বা “স্বল্পমাত্রার ট্রান্সফ্যাট” এ জাতীয় স্বাস্থ্যবার্তা ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা বলা হয়। এ ধরনের পদক্ষেপের ফলে খাদ্যপণ্যের উপাদান সম্পর্কে ভোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি পায় বলে আলোচনা সভায় জানানো হয়।

স্বাগত বক্তব্যে ক্যাব কেন্দ্রিয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ক্যাব দীর্ঘদিন যাবৎ সকলের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে আন্দোলন করে যাচ্ছেন। ট্রান্সফ্যাট নতুন একটি উপসর্গ আর্বিভুত হয়েছে। আর এই ট্রান্স ফ্যাটের কারনে হ্দরোগসহ নানা অসংক্রমন রোগের প্রার্দুভাব প্রতিনিয়তই বাড়ছে। আর “ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে কোনো নীতি না থাকায় ভোক্তা স্বাস্থ্য চরম হুমকির মধ্যে রয়েছে। ভোক্তা স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ট্রান্সফ্যাট নির্মূল করার জন্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, উৎপাদক ও ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলোকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।

This post has already been read 3567 times!

Check Also

আন্তর্জাতিক ওয়ান হেলথ ডে উদযাপিত

নিজস্ব প্রতিবেদক:পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, …