বিশেষ প্রতিবেদক: কোভিড-১৯ সংক্রমণের প্রায় এক বছর হতে চলেছে। খবরে পড়া বিশ্ব অথনীতির্র লাগাম টানতে যখন উন্নত বিশ্ব ব্যতিব্যস্ত ঠিক সেই মুহূর্তেই বাংলাদেশের ২য় বৃহত্তর পোল্ট্রিশিল্প এক অনিশ্চিত বেড়াজালে বন্দি। বাচ্চা ও খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে তৃনমূল খামারী পর্যন্ত গত দুই-তিন মাস ধরে পুঁজি হারাতে হারাতে নিঃস্ব হওয়ার পথে। দফায় দফায়খাদ্য তৈরীর উপকরণসমূহের মূল্য বৃদ্ধির কারণে ডিম, মাংস ও খাদ্যের উৎপাদন খরচ যে-হারে বেড়েছে ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রয়মূল্য সে-হারে বাড়েনি। বিশেষ করে ব্রয়লার মুরগীর দাম একদমই বাড়েনি। ফলে বাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্রযলার খামারীদের অবস্থা একেবারেই শোচনীয়। এভাবে চলতে থাকলে একের পর এক খামার ও ফিডমিল বন্ধ হয়ে যাবে। এমতাবস্থায় খামারীরা দায়ভার চাপাচ্ছে খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর। আর খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দায়ভার চাপাচ্ছে কাঁচামাল আমদানীকারক ও সয়াবিন মিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর। এখন সময় হয়েছে বাস্তবতার নিরিখে সমস্যাগুলোর সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা ও দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
বিগত তিন মাসে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে সয়াবিন মিলের, যা প্রায় ৫০%। এরপর ভুট্টা প্রায় ৩০%। এখানে উল্লেখ্য যে, এক কেজি খাদ্য তৈরী করতে ৭৫% প্রয়োজন হয় ভুট্টা ও সয়াবিন মিলের। সয়াবিন তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বাইপ্রোডাক্ট হচ্ছে সয়াবিন মিল, যার মূল কাঁচামাল ফূলফ্যাট সয়াবিন সিড (Full Fat Soybean seed), যা আমদানী নির্ভর। অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশে হাতেগোনা কয়েকটি গ্রুপ অব কোম্পানি সয়াবিন তেল ও সয়াবিন মিলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে-
১. সিটি গ্রুপ
২. মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ
৩. গ্লোব এডিবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড
৪. যমুনা এডিবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড
ফলে পোল্ট্রি শিল্প দিনে দিনে তাদের কাছে জিম্মি হয়ে যাচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, প্রায়শঃ আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে এসমস্ত কোম্পানিগুলো হাজার হাজার কোটি টাকা পোল্ট্রি সংশ্লিস্ট প্রতিষ্ঠান থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে। ফলে এ শিল্পে বিনিয়োগকারীরা ক্রমশঃ উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে। এভাবে চলতে থাকলে সহজলভ্য উন্নত প্রোটিন (ডিম ও মাংস) সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ হয়ে যাবে।
চলতি বছর বাংলাদেশে জানুয়ারী-জুন ২০২০ পর্যন্ত চট্রগ্রাম বন্দরে আগত সয়াবিনের ভেসেলস্ এর বিবরণ
উল্লেখ্য যে, ছয় মাসের আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ঐ সময় প্রতিটন সয়াবিন সিড এর ক্রয়মূল্য ছিল ৩৯০-৪০০ ডলার যা টাকায় রুপান্তর করলে হয় ৩৪-৩৫ টাকা প্রতি কেজি। এখানে আরো উল্লেখ্য যে, এক কেজি সয়াবিন সিড থেকে ২০০ গ্রাম তেল ও ৭৮০ গ্রাম সয়াবিন মিল পাওয়া যায়।
সুতরাং, প্রোডাক্ট বিশ্লেষন অনুযায়ী আমদানীকৃত ফূলফ্যাট সয়াবিন (Full Fat Soybean seed) হতে উৎপাদনকৃত সয়াবিন মিলের মূল্য সর্বোচ্চ ৩৪-৩৫ টাকা হতে পারে কেজি প্রতি। উল্লেখিত সয়াবিন সিড থেকে প্রায় বার লক্ষ মেট্রিক টন সয়াবিন মিল প্রস্তুত করা সম্ভব, যা প্রায় এক বছরের চাহিদা পূরন করতে পারে। সুতরাং বলা যেতেই পারে বাজারে সয়াবিন মিলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে অতি মুনাফা অর্জন করাই কোম্পানিগুলোর মূল উদ্দেশ্য।
নিম্মে গত পাঁচ মাসের সয়াবিন কেক ও সয়াবিন তেলের বাজারদর তথ্য দেওয়া হলো:
পোলট্রি সংশ্লিষ্টদের দাবী, এরুপ অনৈতিক চর্চা বন্ধ করতে না পারলে ২০২১ এর জানুয়ারিতে সয়াবিন মিলের মূল্য কেজিপ্রতি ৬৫-৭০ টাকা হলে অবাক হওয়ার মতো কিছুই থাকবেনা, কেননা বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন সিড এর মূল্য টন প্রতি ৫১০-৫২০ ডলার।
বিকাশমান পোলট্রি শিল্পকে রক্ষা এবং খামারিদের ঘুরে দাড়াতে হলে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো নেয়া জরুরি বলে মনে করছেন পোলট্রি শিল্প সংশ্লিষ্টগণ:
১. সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়, উৎপাদনকারী ও ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের সমন্বয়ে যৌথ কমিটির মাধ্যমে সয়াবিন মিল ও সয়াবিন তেলের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া।
২. জরুরী ভিত্তিতে সয়াবিন মিলের বিকল্প হিসাবে গুনগতমানসম্পন্ন বোভাইন (Bovine) মিট এন্ড বোন মিল (Meat & Bone Meal) আমদানীর অনুমোদন দেয়া।
৩. একতরফা বাজার ব্যবস্থা ও সিন্ডিকেট পদ্ধতি ভেঙ্গে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ডিউটি ফ্রিতে সয়াবিন মিল ডিডিজিএস (DDGS) ও পিনাট মিল (Peanut Meal) আমদানীর অনুমোদন দেয়া।
৪. আমদানীকারকদের পোর্ট হতে মাল খালাসের সকল প্রকার আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন করা।
৫. কোভিড-১৯ এর প্রভাব কাটিয়ে উঠতে বাচ্চা ও খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের দুই বছরের জন্য ব্যাংক ঋণের সুদ মওকুফ করা, সেই সাথে রিপেমেন্ট সিডিউল রিভাইজড করা।