বুধবার , ডিসেম্বর ১৮ ২০২৪

পোলট্রি, মৎস্য ও ডেইরি শিল্পে আমদানি নীতিমালায় সমস্যা ও করণীয়

সিব্বির আহমেদ: প্রাণিসম্পদ বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় সেক্টর। সেক্টরটি হতে পারে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম বড় উৎস। গত কয়েকবছর সেক্টরের অনেক পরিবর্তন ও উন্নয়ন হয়েছে যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে এবং অনেক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে।

যে কোন প্রাণির বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে খাদ্য। মাছ, মুরগি, হাঁস, গরু, ছাগল কোন প্রাণিই এই খাদ্য বা ফিডের বাইরে নয়। বাংলাদেশ ফিডের কাঁচামাল আমদানি নির্ভর দেশ। আমাদের দেশে ফিড তৈরির ৭০-৮০% কাঁচামাল আমদানি করতে হয় এবং এই আমদানিতে মাঝেমাঝে পোহাতে হয় নানান ঝক্কি ঝামেলা। শুধুমাত্র বিদ্যমান আমদানি নীতিমালার জন্য ফিডের কাঁচামাল আমদানি পর্যায়ে অনেক খরচ বেড়ে যায়। যুপোপযোগী আমদানি নীতির অভাবে কন্টেইনার দীর্ঘদিন পোর্ট ইয়ার্ডে পড়ে থেকে পণ্যের গুণগত মান নষ্ট হয় এবং কন্টেইনার ডেমারেজের নামে প্রতি বছর শত শত কোটি ডলার বাংলাদেশ থেকে চলে যায়। এসব অনাকাঙ্খিত ব্যায়ের কারণে পণ্যের আমদানি খরচ বেড়ে যায় এবং যার সরাসরি প্রভাব পড়ে মাছ, মাংস, দুধ উৎপাদনের খরচের উপর। খুব স্বাভাবিকভাবেই পোলট্রি, মাছ ও ডেইরি উৎপাদন খরচও বেড়ে যায়।

ফিডের কাঁচামাল যেহেতু একটি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য তাই সেক্টরের প্রবৃদ্ধিকে গতিশীল করতে কাঁচামাল আমদানি নীতিতে কিছু সংস্কার প্রয়োজন বলে সাধারণ ব্যবাসায়ীরা মনে করেন। বিশেষ করে কাঁচামাল আমদানি নীতিমালা আরো ব্যবসাবান্ধব করতে পারলে প্রাণিজ পন্য (মাছ, মাংস) উতপাদন খরচ অনেক কমে আসবে এবং রপ্তানিবাজারে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি হবে। কারণ, রপ্তানি বাজারে প্রবেশের জন্য নিরাপদ প্রোটিন উৎস (পোলট্রি, মাছ, ডেইরি) উৎপাদন যেমন জরুরি তেমনি পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক দামও গুরুত্বপূর্ণ।

বিদ্যমান আমদানি নীতিমালার জন্য ফিডের কাঁচামাল ছাড়ানোতে চিটাগাং পোর্টে কেজি প্রতি ৩-৬ টাকা খরচ হয়ে যায় অথচ এর খুব সামান্যই সরকারের খাতে যায়।

কাঁচামাল আমদানিতে প্রত্যক্ষ  সমস্যাগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

১) DLS থেকে কাঁচামাল আমদানির জন্য NOC প্রদানে অনেক সময় লেগে যায় এবং ভেজিটেবলভিত্তিক কাঁচামাল আমদানিতেও অনেক সময় NOC আবেদন বাতিল করা বা কন্ট্রাক্ট কোয়ান্টিটি কাটছাঁট করা হয়।  ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিদেশি সাপ্লাইয়াররা বাংলাদেশি আমদানিকারকদের জন্য অতিরিক্ত দাম নির্ধারণ করে। সাপ্লাইয়ারদের কাছ থেকে প্রোফরমা ইনভয়েস বা কন্ট্রাক্ট নিয়ে যথাসময় এলসি দিতে না পারায় বিদেশি অনেক ভালো সাপ্লাইয়ার বর্তমানে বাংলাদেশি কাষ্টমারদের কাঁচামাল দিতে অনাগ্রহ দেখায়। বিদেশি সাপ্লাইয়ার এর সাথে মূল্য এবং কোয়ান্টিটি কনফার্ম করার পরেও এলসি দিতে না পেরে আমদানিকারককে  অপমানিত হতে হয় এবং সম্পর্কের অবনতি হয়। কারণ, কোন ভালো সাপ্লাইয়ার মূল্য কনফার্ম করে বেশি সময় অপেক্ষা করে না। এছাড়া যথাসময় এলসি দিতে না পারলে রপ্তানিকারকও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন। এর ফলে বিদেশি সাপ্লাইয়াররা বাংলাদেশি কাস্টমারদের জন্য অনেক ধরনের শর্ত আরোপ করে যা অনেক সময় দেশের জন্যও অপমানজনক।

২) কন্টেইনার পোর্টে আসার পরে টেস্টের জন্য দীর্ঘদিন সময় ক্ষেপন হয়। ফলে উচ্চহারে প্রাইভেট পোর্টের  ডেমারেজ, কন্টেইনার ডেমারেজ ইত্যাদি খাতে আমদানিকৃত পণ্যের খরচ বেড়ে যায়। ভেজিটেবল ভিত্তিক কাঁচামালও পিসিআর টেস্ট করাতে হয়। যার ফলে বেশিরভাগক্ষেত্রে ১৫-২০ দিন সময় লাগে কন্টেইনার ক্লিয়ার করতে। ফলে মোটা অংকের পোর্ট ও কন্টেইনার ডেমারেজ চলে আসে যা স্বাভাবিকভাবেই কাঁচামালের মূল্যের ওপর প্রভাব ফেলে।

৩) কন্টেইনার দীর্ঘদিন পোর্ট ইয়ার্ডে পড়ে থাকায় আমদানিকৃত কাঁচামাল অনেকাংশ নষ্ট হয় বা কাঁচামালের মানের অবনতি হয়। আর এই ক্ষতি আমদানিকারকগন বাধ্য হয়ে ভাuলো থাকা পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। কন্টেইনার জাহাজে আসার সময় সমুদ্রে থাকাকালীন ও পোর্ট ইয়ার্ডে পড়ে থাকাকালীন সুর্যের তাপ ও আবহাওয়ার প্রভাব ভিন্ন হয়। পোর্ট ইয়ার্ডে পড়ে থাকলে খুব দ্রুতই ভেজিটেবলভিত্তিক বাই-প্রোডাক্টগুলো নষ্ট হয়ে যায় এবং আমদানিকারক আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়ে।

৪) কিছু বিধিমালা এবং নতুন উদ্যোক্তা আমদানিকারক রেজিষ্ট্রেশনে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ((DLS) -এর কিছুসংখ্যক কর্মকর্তাগণ কর্তৃক  নিরুৎসাহিত করাসহ কয়েকটি কারণে সম্ভাবনাময় এই সেক্টরের ব্যবসা প্রবৃদ্ধিতে ধীর গতি লক্ষণীয়।

– ফিডের কাঁচামাল আমদানিকারককে DLS  -এ নিবন্ধিত হতে হলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গোডাউন থাকার বিধান আছে যা বাস্তবসম্মত নয়। কারণ, পৃথিবীর কোথাও Yellow Corn, SBM, RSM, DDGS, CGM, Fish Meal ইত্যাদি কাঁচামাল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গোডাউনে রাখা হয় এমন কোন তথ্য নেই বা নিয়ম নেই যা আমাদের নীতিমালাতে আছে।

– নতুন উদ্যোক্তা আমদানিকারক রেজিস্ট্রেশন এর জন্য DLS এ গেলে কোন কোন কর্মকর্তাগণ নিরুৎসাহিত করে থাকে, যা এই সেক্টরের ব্যবসাকে কিছুসংখ্যক নির্ধারিত ব্যবসায়ী বা বড় ফিড মিলারদের সিন্ডিকেটের  নিয়ন্ত্রনে সহায়ক হয়। এর ফলে নতুন উদ্যোক্তা বা ছোট ছোট ফিডমিলকে বাজারে আসতে বা ব্যবসায়ে টিকে থাকতে বাধার সৃষ্টি করে এবং বাজার প্রতিযোগিতা নষ্ট করে সিন্ডিকেট ব্যবসাকে উৎসাহিত করে।

৫) ফিডমিল এবং কমার্শিয়াল আমদানিকারকদের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক ব্যবধানের ফলে- ছোট ছোট ফিডমিল যাদের সরাসরি আমদানি সক্ষমতা কম বা নাই, তারা  লোকাল বাজার থেকে বেশি মূল্যে কাঁচামাল কিনে থাকেন যা কমার্শিয়াল আমদানিকারকগণ আমদানি করে থাকেন শুল্ক দিয়ে। এতে তারা  বড় ফিড মিলের সাথে উৎপাদন খরচ ও মূল্য প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না এবং অনেক সম্ভাবনাময় নতুন উদ্যোক্তা লোকসানের মুখে পড়ে ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, যা অনেক কর্মসংস্থানকে  নষ্ট করে ও সেক্টরের প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়।

দেশের এই অতি সম্ভাবনাময় খাতের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ না করে মান নিয়ন্ত্রণে বেশি মনযোগী হলে এই খাত থেকে  রপ্তানির মাধ্যমে বিশাল অংকের বৈদেশিক মূদ্রা আয়ের সম্ভাবনা তৈরি হতো এবং ব্যাপক কর্মসংস্থান এর সুযোগ সৃষ্টি হতো। মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, সিংগাপুর সহ আমাদের কাছাকাছি অনেক দেশ প্রচুর পরিমানে পোল্ট্রি, গরুর মাংস আমদানি করে থাকে অথচ আমাদের সস্তা লেবার থাকার পরেও পশুখাদ্যের মূল্য বেশি  হওয়ার কারণে মাছ, মাংস উৎপাদন খরচ বেশি হচ্ছে ফলে রপ্তানি বাজার ধরতে পারছে না।

সামান্য কয়েকজন খারাপ ব্যবসায়ী যারা মিস ডিক্লারেশনের মাধ্যমে MBM বা অন্যান্য নিষিদ্ধ কাঁচামাল আনার চেষ্টা করে তাদের আটকানোর নামে সেক্টরের সকল ব্যবসায়ীকে নিয়ন্ত্রণের নীতিমালা করে পুরো ফিড সেক্টরের প্রবৃদ্ধিতে নিয়ন্ত্রন আরোপ করা হচ্ছে। অথচ ওইসব সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীদের খুঁজে বের করে শাস্তির ব্যবস্থা করে সামগ্রিক নীতিমালা ব্যবসাবান্ধব করতে পারলে, ভালো উদ্যোক্তাগণ এই সেক্টরে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবদান রাখতে পারে এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটা বড় খাত তৈরি হতে পারে।

This post has already been read 6607 times!

Check Also

খামারীদের টাকা নিয়ে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার নয়-ছয়ের অভিযোগ!

মো. মাহফুজুর রহমান (চাঁদপুর সংবাদদাতা) : চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ ও উত্তরে ১৬০ জন খামারীর প্রত্যেকের …