ড. মো.শাহজাহান কবীর : ধান উৎপাদনে বোরো মওসুম সর্বাধিক উৎপাদনশীল। একথা অনস্বীকার্য বোরোর উপর ভিত্তি করেই দেশের খাদ্য নিরাপত্তার ভিত্তি রচিত হয়েছে। দেশের মোট উৎপাদনের ৫৮ ভাগ আসে এ মওসুম থেকে। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বোরো ধানের গড় ফলন হেক্টর প্রতি ১.৫ থেকে ২.০ টন পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব যা জাতীয় উৎপাদনে বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে। স্বাধীনতার পর পরই সদ্য স্বাধীন দেশের ৩০ লাখ টন খাদ্য ঘাটতিপূরণে বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিক আমদানির মাধ্যমে এবং স্বল্প মেয়াদে উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ, উন্নত বীজ, সেচ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ সরবরাহ করেন এবং কৃষি ঋণ মওকুফ, সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার ও খাসজমি বিতরণ করে কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের চেষ্টা করেন। বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘একটা স্বল্প সম্পদের দেশে কৃষিখাতে অনবরত উৎপাদন হ্রাসের পরিস্থিতি অব্যাহত থাকতে পারে না। দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধির সব প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। চাষিদের ন্যায্য ও স্থিতিশীল মূল্য প্রদানের নিশ্চয়তা দিতে হবে।’
তিনি কৃষিতে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের জন্যে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। উন্নত বীজ ও প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নেন, উচ্চতর কৃষি গবেষণা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য ১৯৭৩ সালের মধ্যেই ধ্বংসপ্রাপ্ত কৃষি-অবকাঠামো পুনর্নিমাণ ও কৃষি-যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্যে হ্রাসকৃত মূল্যে ৪০ হাজার টি শক্তিচালিত লো-লিফট পাম্প, ২৯০০টি গভীর নলকূপ ও ৩০০০টি অগভীর নলকূপ স্থাপনের মধ্য দিয়ে দেশে বোরো আবাদ বাড়ানোর ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এক সময় দেশের বোরোর আবাদ কম হলেও সেচ ব্যবস্থা প্রবর্তনের সাথে সাথে আবাদ বাড়তে থাকে। এর সাথে যোগ হতে থাকে অব্যাহতভাবে ফলন বৃদ্ধির নতুন নতুন উন্নতর জাত। ফলশ্রুতিতে উৎপাদনের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে থাকা বোরো ক্রমশ প্রথম অবস্থানে উঠে আসে যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে আরো সুদৃঢ় করেছে এবং করছে।
বোরো ধান নিয়ে এক ধরনের নেতিবাচক প্রচারণা আছে যে, বোরো ধানের আবাদে পানি বেশি লাগে। অনেকে বলেন, এক কেজি ধান উৎপাদন করতে ৩০০০-৫০০০ লিটার পানি লাগে। কিন্তু ব্রি ও অস্ট্রেলিয়ান সেন্টার ফর এগ্রিকালচারাল রিসার্চ কর্তৃক এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, সেচের পানির হিসেবে কৃষক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রিত সেচ ব্যবস্থাপনায় প্রতি কেজি ধান উৎপাদন করতে ১২০০-১৫০০ লিটার পানি লাগে। অপচয় বাদ দিয়ে শুধু ধানের উৎপাদনে প্রকৃত পানির খরচ হিসাব করলে প্রতি কেজি ধান উৎপাদন করতে ৫৫০-৬৫০ লিটার পানিই যথেষ্ট। বোরো আবাদ বাড়ানোর জন্য এ ধরনের নেতিবাচক প্রচারণা বিপরীতে জন-সচেতনতা গড়ে তোলার কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে এবং পাশাপাশি বোরো চাষে পানির অপচয় রোধে কৃষকদের সচেতনতা বাড়াতে হবে।
আরেকটি নেতিবাচক প্রচারণা আছে, বোরো চাষে কৃষকের লোকসান হয় কিন্তু ২০০১-২০১৯ পর্যন্ত গত ১৯ বছরের বোরো ধান চাষের অর্থনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কৃষকরা বোরো ধান চাষ করে প্রতি বছর হেক্টর প্রতি গড়ে ৫০২ টাকা হারে লাভ করছেন। যদিও কোন কোন বছরে লাভের তারতম্য আছে, কিন্তু কৃষকরা সাধারণত বোরো ধান অর্থকারী ফসল (Cash Crop) হিসেবে চাষ করেন। যা তারা প্রয়োজন মাফিক বিক্রি করে দৈনন্দিন চাহিদা মিটিয়ে থাকেন। কৃষকদের আয়ের একটি বড় অংশ বোরো ধান থেকে আসে। যদি বোরো ধান চাষ না করা হয় তাহলে কৃষকের আয় অনেকাংশে কমে যাবে এবং তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা দারিদ্র্য সীমার নীচে নেমে যেতে পারে। তাই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বোরো ধান চাষ অত্যন্ত জরুরি।
এ বছর অতিবৃষ্টিতে ছয় দফা বন্যায় ৩৫টি জেলার আমন ধানের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে দেশে খাদ্য ঘাটতির আশংকা নেইই বরং সারা বছরের উৎপাদন বিবেচনা করলে আগামী জুন পর্যন্ত দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণ করে প্রায় ৩০ লক্ষ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। এ বিষয়ে গত একমাস ধরে দেশের ১৪টি কৃষি অঞ্চলে কৃষক, সম্প্রসারণ কর্মী, এনজিও, মিলার, ও ভোক্তা পর্যায়ে জরিপ করে এই তথ্য পেয়েছে ব্রি। এই প্রথম উৎপাদন নির্ণয়ের জন্য স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করে ফলন ও উৎপাদনের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সুতরাং সারা দেশে চালের উৎপাদন কম এবং খাদ্যঘাটতি হওয়ার আশংকার কথা যেভাবে ফলাওভাবে প্রচার করা হচ্ছে তা আদৌ ঠিক নয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে মাননীয় কৃষিমন্ত্রীকে বোরোর উৎপাদন বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছেন এবং বোরোর চাষযোগ্য কোন জমি যাতে খালি না থাকে সে ব্যাপারে কৃষকদের উৎসাহ দেয়ার কথা বলেছেন। বোরোর উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে মাঠ থেকে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত সব কর্মকর্তাকে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান জানিয়ে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, “যে করেই হোক চলতি বোরোর যে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তা অর্জন করতে হবে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কৃষকের পাশে থাকতে হবে। এমনিতেই এ বছর ধানের ভালো দাম পাওয়ায় চাষিরা খুশি ও উৎসাহ-উদ্দীপনায় আছে। অন্যদিকে আমরা কৃষকদের যে বোরো ধানের উন্নত বীজ, সার, সেচসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণ এবং বন্যার ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় যে প্রণোদনা দিচ্ছি তা সুষ্ঠুভাবে বিতরণ নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে”।
এরই প্রেক্ষিতে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন আগামী মওসুমে বোরো ধানের আবাদ ৫০ হাজার হেক্টর বাড়ানো হবে। এ ব্যাপারে মাঠ পর্যায়ে ইতোমধ্যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যাতে চাষযোগ্য কোনো জমি খালি না থাকে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সে ব্যাপারে কৃষকদের উৎসাহ দিতে বলা হয়েছে। সরকার কৃষকদের বোরো ধানের উন্নত বীজ সরবরাহ করছে। সার, সেচসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণ এবং বন্যার ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় প্রণোদনা দিচ্ছে। তা সুষ্ঠুভাবে বিতরণ নিশ্চিত করতে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বোরো উৎপাদন নির্বিঘœ করার জন্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ইতোমধ্যে সম্ভাব্য সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বোরো আবাদে সঠিক জাত নির্বাচন, কৃষিতাত্ত্বিক ও সার ব্যবস্থাপনা, রোগ-বালাই ও সেচজনিত প্রতিবন্ধকতাসমূহ এবং সম্ভাব্য প্রতিকার ব্যবস্থা বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ও কৃষক প্রতিনিধিদের নিয়ে ব্রি ইতোমধ্যে ঢাকা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল, ফরিদপুর, কুমিল্লা, সিলেট, রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া এবং রাজশাহী অঞ্চলে এখন পর্যন্ত ১২ (বারো) টি অঞ্চলিক কর্মশালা সম্পন্ন করেছে। দক্ষিণাঞ্চলের অনাবাদি জমির প্রায় ৩০%
গত তিন বছরে পর্যায়ক্রমে চাষের আওতায় এসেছে। এ বছর আরও এলাকা আবাদেও আওতায় আনার জন্য ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, গত বোরো মওসুমে ৪৭ লাখ ৫ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছিল। চলতি বোরো মওসুমে গত বছরের চেয়ে ৫০ হাজার হেক্টর জমি বাড়িয়ে ৪৮ লাখ ৪ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অঞ্চল হিসাবে সিলেটে, বরিশাল, ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, ফরিদপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও ময়মনসিংহে ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ সম্প্রসারণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। লক্ষ্য অর্জনে হাইব্রিড চাষও বাড়ানো হচ্ছে। গত বছর ৯ লাখ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড ধান চাষ হয়েছিল। এবার ১১ লাখ হেক্টরে হবে হাইব্রিড ধানের চাষ। এ বছর দুই লাখ হেক্টরে বাড়তি হাইব্রিড জাতের ধান চাষের জন্য ১৫ লাখ কৃষককে মাথাপিছু এক বিঘা জমির জন্য দুই কেজি করে বীজ বিনামূল্যে প্রদান করা হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, এবার বোরো মওসুমে হাইব্রিডসহ দুই কোটি ছয় লাখ টন চাল উৎপাদন হবে। যা গত বছরের তুলনায় ৫ লক্ষ টন বেশি।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বোরো ধানের গড় ফলন হেক্টর প্রতি ১.৫ থেকে ২.০ টন পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব, যা জাতীয় উৎপাদনে বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের কৃষকরা বোরো আবাদে নানা ধরনের প্রতিবন্ধতার সম্মুখিন হন। ফলে অনেক সময় কাঙ্খিত ফলন পান না। তাই ফলন বাড়াতে এলাকা, মওসুম, জমির ধরন অনুসারে লাগসই জাত নির্বাচন করা জরুরি। গুণগত মানসম্মত বীজ ব্যবহার করে সুস্থ সবল চারা উৎপাদন করতে হবে। অধিক ফলন প্রাপ্তির জন্য জাত নির্বাচনের সাথে সাথে সঠিক ফসল ব্যবস্থাপনা একান্তই অপরিহার্য। ভালো বীজে ভালো ফলন, ভালো বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে ২০% পর্যন্ত ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব।