ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা) : বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করে। ল্যান্ডস্কেপ উন্নয়ন ও সবুজবেষ্টনী তৈরির ম্যধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনকে বাঁচাতে ১৫৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ব্যয়ে নতুন প্রকল্প নিয়েছে সরকার। খুলনা ও বরিশাল বিভাগের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর ও বরগুনা জেলার মোট ৩৯টি উপজেলা ঘিরে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে। কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দেশের ৩০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হবে।
সুন্দরবনের আয়াতন প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। মোট আয়তনের ৬২ শতাংশ বাংলাদেশের অংশ, আর বাকি অংশ ভারতের। দেশের দুটি বিভাগের ৫টি জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর ও বরগুনা জেলার কয়েক লাখ মানুষ সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করে। এ সুন্দরবন থেকে নিয়মিত আহরণ করা হয় মধু, মৌচাকের মোম, ঘর ছাওয়ার পাতা, মাছ কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক, এছাড়া অনেকগুলো শিল্প যেমন নিউজ প্রিন্ট, দিয়াাশলাই, হার্ডবোর্ড, নৌকা, আসবাবপত্র, সুন্দরবন থেকে আহরিত কাঁচামালের উপর নির্ভরশীল। পাশাপাশি দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুযোর্গ থেকে রক্ষা করে সুন্দরবন। এই বনে ব্যাপক প্রাণবৈচিত্র্য বিদ্যমান রয়েছে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সিংহ, হরিণ ভাল্লুক ইত্যাদি। এছাড়া বনজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে সুন্দরী গেওয়া, গরান, কেওড়া এবং গোলপাতা গাছ। তবে, সুন্দরবনে মানুষের অবাধ বিচরণের কারণে প্রাণী ও বনজ সম্পদ ক্রমান্বয়ে বিলুপ্তির পথে ধাবিত হচ্ছে। সুন্দরবনে মানুষের প্রবেশের ফলে বন্যপ্রাণীর সঙ্গে মানুষের সংঘর্ষ, অপরিকল্পিতভাবে গাছ কাটার ফলে বনের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। এতে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন দেশের রাষ্ট্রীয় সম্পদ সুন্দরবন আজ বিপন্ন। মানব সৃষ্ট বিপন্ন সুন্দরবনকে নিয়ে সরকার নতুন একটি প্রকল্প গ্রহন করেছে । প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবনে জীববৈচিত্য রক্ষা পাওয়ার পাশাপাশী বাড়বে সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে জীবন জীবিকা নির্ভরশীলদের সংখ্যা । নতুন করে সৃষ্টি হবে লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান।
সুন্দরবনের ওপর আশপাশের এলাকার লাখ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্ভরশীল। তবে অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয়রা ইদানিং এ বন থেকে মাছ, মধু, মোম, গাছ, ঔষধি গাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া অতিমাত্রায় আহরণ করছে। ফলে বনটির প্রতিবেশগত ভারসাম্য হুমকির মুখে পড়েছে। এ কারণেই সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী জরিপ এবং জলজ সম্পদের পরিমাণ নিরূপণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনে মাটি ও পানির লবণাক্ততা পরীক্ষা ও জরিপ করা হবে। এ জন্য ‘সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সরকার মনে করছে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবনে জীববৈচিত্য রক্ষা পাবে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্পটি গ্রহণ করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ বন অধিদফতর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে গ্রহণ করা প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) গত মঙ্গলবারের (৫ জানুয়ারি) সভায় অনুমোদন পেয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্পের আওতায় সুন্দরবনের সব বন্যপ্রাণীর সংখ্যা ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল, রোগ-বালাই ও সংরক্ষিত এলাকার বৈশিষ্ট্য ও প্রতিবেশ নিয়ে জরিপ করা হবে। জলজ সম্পদের পরিমাণ নিরূপণ এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে মাটি ও পানির লবণাক্ততা পরীক্ষা সংক্রান্ত জরিপ সম্পাদনের মাধ্যমে বিজ্ঞানভিত্তিক সমন্বিত বন ব্যবস্থাপনা ও পরিবীক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হবে।
সুন্দরবন সংশ্লিষ্টরা মনে করে, ‘সুন্দরবন সুরক্ষা’ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বনজ সম্পদের সরবরাহ নিশ্চিত হবে। স্থানীয় জনগোষ্ঠী তাদের মৎস্য, পণ্য ও সেবা নির্ভর জীবিকা নির্বাহে সঠিক তথ্য পাবে। প্রবর্তন ঘটবে একটি বিজ্ঞানসম্মত সমন্বিত প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনার। পারমিট সিস্টেম ও পরিচয় অটোমেশন-এর মাধ্যমে নানা ধরনের সেবা সহজীকরণ হবে এবং বনায়নের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের জ্বালানির চাহিদাও পূরণ হবে। এ ছাড়া ল্যান্ডস্কেপ উন্নয়ন ও সবুজবেষ্টনী তৈরির ম্যধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করাও সম্ভব হবে। ২০২৪ সালের ৩০ জুন মেয়াদে প্রকল্পটি শতভাগ বাস্তবায়নের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে।
এছাড়া প্রকল্পের আওতায় সুন্দরবনের বন ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। বিদ্যমান অবকাঠামো ও যোগাযোগ সুবিধার উন্নয়ন করা হবে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার, উপযুক্ত কর্মপরিবেশ সৃষ্টি ও সুন্দরবনের ভেতরে টহল জোরদার করার মাধ্যমে বন ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা হবে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রকল্পটি ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দবিহীন অননুমোদিত নতুন প্রকল্প তালিকায় ১২০ নম্বর ক্রমে উচ্চ অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রকল্প প্রস্তাবনায় জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় অফিস ভবন, আবাসিক ভবন, ব্যারাক, কাঠের জেটি, পল্টুন, গ্যাংওয়েসহ অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কর্মসূচি রয়েছে।
সুন্দরবনে ইতোপূর্বে প্রতিষ্ঠিত ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রসমূহের অবকাঠামো উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার, চাঁদপাই ও খুলনায় নতুন অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। সুন্দরবনে নিয়োজিত কর্মচারীদের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। খুলনা ভিত্তিক জিআইএস ল্যাবরেটরি, ভেজিটেশন ম্যাপিং, কম্পিউটার সফটওয়ার ও সফটওয়ার লাইসেন্স এবং জিপিএস বেইজড ট্র্যাকিং সুবিধার উন্নয়ন করা হবে। রিমোট সেন্সিং এবং জিআইএস প্রয়োগের মাধ্যমে স্মার্ট পেট্রোলিং-এর তথ্যভান্ডার তৈরি ও স্মার্ট পেট্রোলিং-এর পরিসর বাড়ানো হবে।
প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগের মাধ্যমে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন কাজ সম্পাদন এবং ইকোট্যুরিজম ও বিকল্প জীবিকা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে। সুন্দরবনের বাঘসহ সকল বন্যপ্রাণীর সংখ্যা ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ও প্রতিবেশ অবস্থা ও ঝুঁকি জরিপ, জলজ সম্পদের পরিমাণ নিরূপণ করা হবে।
প্রকল্পের মাধ্যমে সুন্দরবনের ল্যান্ডস্কেপ জোনে বন পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল উন্নয়ন, বনায়ন ও সবুজ বেষ্টনী তৈরি হবে, বিজ্ঞান ভিত্তিক সমন্বিত বন ব্যবস্থাপনা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে বিদ্যমান ১০ বছর মেয়াদী ইন্টিগ্রেটেড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট পরিকল্পনা আগামী ১০ বছরের জন্য হালনাগাদ করা হবে, সুন্দরবনের নদী, খাল ও পুকুর ইত্যাদি খনন-পুনঃখননের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, বনের সম্পদ সংগ্রহকারী ও সুবিধাভোগীদের জন্য প্রচলিত পারমিট সিস্টেম এবং তাদের পরিচয়পত্র অটোমেশন করা হবে, যার পরিমাণ হবে প্রায় ৩০ হাজার এবং সুন্দরবনের জন্য ইকোট্যুরিজম পরিকল্পনা প্রণয়ন ও ট্যুরগাইডদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা হবে।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রস্তাবিত প্রকল্পের মাধ্যমে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্য সংরক্ষণ, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলের উন্নয়ন এবং জীববৈচিত্র্য পরিদর্শনের জন্য দর্শনার্থী ও পর্যটকদের অধিকতর সুযোগ সৃষ্টি করা হবে।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানিয়েছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দেশের ৩০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হবে। বনের কর্মচারী ও বনরক্ষীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বনের সম্পদ রক্ষা পাবে। সুন্দরবন হবে বৈশ্বিক পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় ।