মো: এমদাদুল হক : আমাদের দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে একদিকে যেমন বাড়ছে খাদ্যের চাহিদা অপরদিকে তেমন বাড়ছে পুষ্টির সমস্যা। বর্তমানে খাদ্য ঘাটতি পূরণে দেশ অনেক এগিয়ে। তাই আমাদের কেবল মাত্র বাজারে পাওয়া শাক-সবজির উপর নির্ভর করে থাকা উচিত নয়। আমাদের চাহিদা অনুসারে উৎপাদন করে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। খাদ্য ও পুষ্টির সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের শাক-সবজির উৎপাদন বাড়াতে হবে। কৃষকগণ এখন মাঠে শীতকালীন সবজির মাঠ পরিচর্যা নিয়ে প্রচুর ব্যস্ত সময় পার করছেন। পাশাপাশি সবজি সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা ও বাজারজাতকরণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হয়। সবজি চাষে ব্যাপক মনোযোগী হয়ে পরিচর্যা করতে হয় নতুবা উৎপাদন ভাল হয না। শীতকালে আমাদের দেশে প্রধানত আলু, সীম, টমেটো, বরবটি, বেগুন, মূলা, বাঁধাকপি, ফুলকপি, গাজর, শসা, লালশাক, মরিচ এসব সবজি বেশি চাষ হয়ে থাকে। সবজি চাষে প্রতিদিইন যার বিশেষ যত্ন ও পরিচর্যা করতে হয়। তা না হলে সবজি উৎপাদন আশানুরুপ হয় না। সবজি চাষের ক্ষেত্রে বিশেষ যেসব পরিচর্যা করতে হয় তা হলো নিয়মিত প্রয়োজন অনুসারে পানি সেচ দেওয়া নিড়ানী দেওয়া, মালচিং করা বা জাবড়া দেয়া, আগাছা দমন, পার্শ্ব শাখা ও পাতা অপসারণ করা, গোড়ার মাটি তোলা, সার প্রয়োগ,বাউনি দেয়া, পরাগায়ন করা এবং রোগ ও পোকামাকড় দমন করা।
আগাছা দমন: সবজি ফসলে আগাছা দমন করে রাখতে হয়। কারণ আগাছা সবজি ফসলের সাথে পানি, আলো ও খাদ্য উপাদান নিয়ে প্রতিযোগিতা করে থাকে। তাছাড়া আগাছা রোগ ও পোকামাকড়ের আবসস্থল। এতে ভাল ফলন পাওয়া যায় না। কোন ভাবেই সবজি ক্ষেতে আগাছা জন্মাতে দেয়া যাবে না। আগাছ দমনের জন্য আচড়া বিঁদা,খন্তা নিড়ানি ব্যবহার করা যেতে পারে।
পানি সেচ: শীতকালে সবজি চাষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন বিষয় হচ্ছে পানি সেচ। কারণ এসময় মাটির আদ্রতা দ্রুত হ্রাস পায়। পানি সেচের জন্য নদী ,খাল, ক্ষুদ্র জলাশয়, নলকুপে, পাম্প এসব উৎস ব্যবহার করা যেতে পারে। সবজির জাত আবস্থা বুঝে পানি সেচ প্রদান করতে হয়। আলু, বাঁধাকপি, ফুলকপি এসব ফসলে নালা করে সেচ দিতে হয় এসব ফসলে পানির পরিমান বেশি লাগে। আবার সীম, টমেটো, লালশাক, বেগুন এসব ফসলে ঝাঁঝারি দিয়ে মাদায় বা শিকড়ে সেচ দেওয়া যায় এতে পানির পরিমান কম লাগে। সবজির চারা রোপণের ৩-৪ দিন পর্যন্ত হালকা সেচ এবং অতিরিক্ত বৃষ্টির বা সেচের পানি দ্রুত বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
সার প্রয়োগ : সবজি চাষের জন্য প্রচুর পরিমান জৈব সার ব্যবহার করতে হয়। তাছাড়া সুষম সার প্রয়োজন অনুসারে ব্যবহার করা। গাছের বয়স ও মাটির উর্বরতা ভেদে সারের মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। সবচেয়ে ভালো হলো মাটি পরিক্ষা করে ফসলে সার দেওয়া। সবজি ফসলে জমি তৈরির সময় সার দেওয়ার পরও দুই কিস্তিতে সার দিতে হয়। প্রথম কিস্তিতে সার দিতে হয় চারা লাগানোর ১৫-২০ দিন পর এবং দ্বিতীয় কিস্তি মূলত গাছে ফুল আসার পূর্বে মাদায় খুব ভালোভাবে সার মাটির সাথে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হয়। সার প্রয়োগের সাথে সাথে হালকা সেচ দিতে হয়।
মালচিং করা: সবজি ফসলে মালচিং ব্যবহার করে সেচের পরিমান কমানো যায়। এতে একদিন যেমন পানি কম লাগে অন্যদিকে আগাছা দমন হয়ে থাকে। মালচিং হচ্ছে খড়কুটা, কচুরিপানা, পলিথিন দিয়ে মাটি ঢেকে দেওয়া। যাতে পানি বাস্পায়িত কম হয় এবং আগাছা জন্মাতে না পারে। মালচিং দ্রব্যের মধ্যে পচনশীল দ্রব্য খড়কুটা কচুরিপানা দিয়ে করা ভাল। কারণ এক সাথে মালচিং ও পরবর্তিতে তা পচে জৈব দ্রব্য মাটিতে যোগ হয় মাটির উরর্বরতা বৃদ্ধি করে। সবজি ক্ষেতে প্রয়োজন অনুসারে গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে।
পার্শ্ব শাখা ও পাতা অপসারণ: পার্শ্ব শাখার ফলে ফলন কমে যায়। তাই সময় সময় পার্শ্ব শাখা ও অতিরিক্ত পাতা সরিয়ে ফেলতে হবে। মিস্টিকুমড়া, লাউ, করলা গাছের পার্শ্ব শাখা ও পুরাতন পাতা কেটে দিলে গাছে আলো বাতাস প্রবেশ করে এবং রোগ বালাই কম হয় সর্বোপরি ফলন বেড়ে যায়।
প্যাচ খোলা ও ফুল বাছাই: লতানো সবজি যেমন সীম ও বরবটির প্যাচ খোলা ও ফুল বাছাই অতান্ত্য জরুরি। জমি থেকে উচ্ছিস্ট ফুলগুলো হাতবাছাই করে জমিকে পরিস্কার রাখতে হবে। কারণ এসব উচ্ছিষ্ট ফুলগুলোতে এবং অতিরিক্ত প্যাচ তৈরি হলে সেই প্যাচের গোড়া কুয়াশায় ভেজা থাকে, ফলে সহজেই জীবানুর আবাসস্থল পাশাপাশি পোকামাকড়ের ডিম পাড়ার উৎকৃষ্ট স্থান হয়।
পরাগায়ন: সবজি ফসল পরাগায়নের মাধ্যেমে ফল উৎপাদন করে তাই প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম পরাগায়নের ব্যবস্থা করতে হয়। প্রাকৃতিক পরাগায়নের জন্য প্রজাপতি, বোলতা, মৌমাছি এসব পতঙ্গ আসার ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য অযাচিতভাবে কীটনাশক ব্যবহার হতে বিরত থাকতে হবে। আবার সকাল৯.০০ টার আগে কৃত্রিম পরাগায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। এত ফসলে ফলন বেড়ে যায়।
রোগ ও পোকামাকড় দমন: সবজি ফসলে বিভিন্ন ধরনের রোগ ও পোকার আক্রমণ হয়ে থাকে। রোগের মধ্যে ছত্রাক, ভাইরাস, ব্যাক্টেলিয়াজনিত কারনে রোগ বেশি হয়ে থাকে। সবজি ফসলে বেশী দেখা যায় তার মধ্যে রয়েছে ছত্রাকজনিত গোড়া পঁচা, ঢলেপড়া, এনথ্রাকনোজ, ফল পঁচা এসব রোগ ছাড়া ব্যাক্টেরিয়াজনিত গোড়া পঁচা, ঢলে পড়া আর ভাইরাসজনিত মোজাইক রোগ। মোজাইক রোগ দেখা মাত্রই গাছটি তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। পঁচা জাতীয় রোগের জন্য ম্যানকোজেব বা কার্বেন্ডাজিম জাতীয় ছত্রাকনাশক সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। সবজি ফসলে জাব পোকা পাতাখেকো লেদাপোকা, মাছি পোকা, শিকড় কাটা পোকা, ফলছিদ্রকরী পোকা আক্রমন করে। এসব পোকা দমনের জন্য পোকার জাতভেদে নির্ধারিত কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। সবজি ফসলের পরিচর্যার উপর নির্ভর করে ফলনের পার্থক্য হয়ে থাকে। কারণ, সবজি ফসলে প্রতিদিন পরিচর্যার প্রয়োজন। ভাল ফলন পেতে হলে সবজি চাষে সঠিক পরিচর্যা করতে হবে।
রোগে ও পোকার আক্রমন যাতে কম হয় সে জন্য সবজি ক্ষেত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। সবজি বাগানে পর্যাপ্ত পরিমানে গোবর সার বা জৈব সার ব্যবহার করতে হবে এতে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমন কম হয়। রোগ আক্রমনের শুরুর দিকে রোগে আক্রান্ত অংশ সংগ্রহ করে মাটির নিচে পুঁতে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। পোকার আক্রমন হলে পূর্নাঙ্গ পোকা ও ডিমের গাদা সংগ্রহ করে ধ্বংস করে ফেলতে হবে বা জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে সহজেই পোকা দমন করা যায়। রোগও পোকার আক্রমন বেশী হলে আপনার কাছাকাছি যেসমস্ত উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তা আছেন তাদের সাথে আলোচনা করে বালাইনাশক ব্যবহার করবেন। তবে বালাইনাশক ব্যবহারের আগে যে সকল সবজি সংগ্রহের উপযোগী হয়ে যাবে তা সংগ্রহ করে নিতে হবে। এবং বালাইনাশক ব্যবহারের অন্ততঃ এক দেড় সপ্তাহ পর্যন্ত কোন সবজি খাবার বা বিক্রয়ের জন্য সংগ্রহ করা যাবে না। এতে সবজিতে প্রয়োগকৃত কীটনাশকের বিষ ক্রিযা থেকেই যায়। ফলে এই সবজি খেলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষের শরীরের ক্ষতির সম্ভবনা রয়েছে। তাই আমাদের খাবারের জন্য বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করতে হবে। এতে নিজে বাঁচবো, দেশ বাঁচবে।
সবজি চাষের সবশেষে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি নিয়মিত আমাদের করতে হয় সেটি হল ফসল সংগ্রহ : ফসল পরিপক্ক অথবা খাবার উপযোগী হলে শাকসবজি সংগ্রহ করতে হবে। সংগ্রহের পর পরিস্কার করে সাইজ অনুসারে বাছাই করে টাটকা অবস্থায় বাজার জাত করতে হবে এতে বিক্রি মূল্য ভাল পাওয়া যাবে ।
শাক-সবজি চাষের সফলতা পেতে হলে এর পরিচর্যাকে বেশী করে গুরুত্ব দিতে হবে, কারণ আমরা জানি যে “যত্ন নিলে রত্ন মেলে”। কৃষি ক্ষেত্রেও কথাটি শতভাগ সত্য। এজন্য সবজি চাষের ক্ষেত্রে সঠিক পরিচর্যা পদ্ধতিকে অনুসরন করে পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরনের পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারব। কৃষি বিষয়ে যে কোন পরামর্শের জন্য আপনি আপনার নিকটস্থ উপজেলা কৃষি অফিস অথবা উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
লেখক: এআইসিও,কৃষি তথ্য সার্ভিস,রাজশাহী।